‘ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমরণ অনশন’ by রোকেয়া বেগম, মো. আবু জুবাইর, ড. লুৎফুন্নেসা বারি, এ কে ওবায়দুল হক, উৎপল কুমার প্রধান, মো. আজিজুল হক, ফারহানা আক্তার

যেহেতু আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কিছুদিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তাই ছাত্র-আন্দোলন, কর্তৃপক্ষের অবস্থান, আন্দোলন চলাকালীন ছাত্রদের মনোবৃত্তি, তার ফলে নানা রকম বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অপরিচিত নই। শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিকতা, ভালোবাসা, দুর্বলতা, তাদের খুশি করার চেষ্টা, তাদের প্রিয় শিক্ষক হয়ে থাকার গর্ব করতে চান না, এমন শিক্ষক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। অন্তত আমরা যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাদের সরকার নির্ধারিত স্বল্প বেতনের পাশে আর যা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়, তা হলো ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসা, সম্মান আর শ্রদ্ধা। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী, শিশুসাহিত্যিক, লেখক, গবেষক, আলোচক, জাতীয় ব্যক্তিত্ব—সবকিছুর পাশাপাশি তাঁর আর একটি পরিচয় হলো তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন অধ্যাপক। ২৫ মে প্রথম আলোয় সাদাসিধে কথায় ‘ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমরণ অনশন’ শিরোনামের লেখায় শ্রদ্ধেয় মুহম্মদ জাফর ইকবাল মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কের যে মেরুকরণ করেছেন, তার সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করছি।
শ্রদ্ধেয় স্যার শাবিপ্রবির ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগের যে পরিবর্তনের উদাহরণ দিয়েছেন, তা এবং মাভাবিপ্রবির ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স বিভাগ হুবহু এক নয়। শাবিপ্রবিতে প্রতিষ্ঠার শুরুতে বিভাগটির নাম ছিল টি টেকনোলজি। চাকরির ক্ষেত্র সীমিত হওয়ায় আপনার বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে ফুড অ্যান্ড টি টেকনোলজি রাখে এবং সর্বশেষ পরিবর্তনে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি রাখা হয়েছে। মাভাবিপ্রবিতে উল্লিখিত বিভাগটি লাইফ সায়েন্স অনুষদভুক্ত এবং ফুড টেকনোলজি ও নিউট্রিশনাল সায়েন্স বিষয়ের কোর্সের সুষম সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে এর পাঠ্যক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লিখিত বিভাগ থেকে অনার্স ডিগ্রি পাওয়া ছাত্রছাত্রীরা বর্তমানে বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বে খাদ্য ও পুষ্টি-সম্পর্কিত ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় বেতনে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে মাভাবিপ্রবির এফটিএনএস বিভাগ থেকে একটি ব্যাচও চাকরির বাজারে যায়নি, সেখানে কীভাবে তারা তাদের ক্ষেত্র সম্পর্কে সন্দিহান হলো?
২০১০ সালের ১২ জুলাই এই বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই স্মারকলিপি দেওয়ার মাধ্যমে ক্লাস বর্জন শুরু করে। বিভাগীয় একাডেমিক কমিটি একাধিকবার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্তের প্রতি ছাত্রছাত্রীরা আস্থা না দেখালে দাবির যৌক্তিকতা নিরূপণার্থে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত সংগ্রহ করা হয়। বিশেষজ্ঞরা ছাত্রছাত্রীদের দাবির বিষয়টিকে অযৌক্তিক বলে মত দেন এবং চলমান ডিগ্রিকেই যুগোপযোগী বলে মনে করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ছাত্রছাত্রীদের অবগত করানোর লক্ষ্যে একাধিকবার তাদের সঙ্গে আলোচনা করে। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বিমক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে উদ্ভূত পরিস্থিতির জটিলতা নিরসনকল্পে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিন ও চেয়ারম্যানসহ বিমক সদস্যদের সমন্বয়ে এক আলোচনা সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, মাভাবিপ্রবি কর্তৃক প্রণীত কারিকুলাম ও পাঠ্যক্রম অনুসারে বর্তমানে ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স বিভাগের অধীনে যে ডিগ্রি দেওয়ার ব্যবস্থা বিদ্যমান,তা অপরিবর্তিত থাকবে এবং ওই পাঠ্যক্রমের আওতায় ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ও রিজেন্ট বোর্ডের সভায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং উভয় কমিটি বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সিদ্ধান্তকেই যুক্তিযুক্ত মনে করে। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা এসব সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজেদের ক্লাসের বাইরে রাখে।
আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবির পক্ষে গত ২০ মার্চ আমরণ অনশনে বসে। প্রথম দিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অনশনরত ছাত্রছাত্রীদের অনশন ভঙ্গ করে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রেখে শ্রেণীকক্ষে ফিরে আসতে অনুরোধ করা হয়। অনশনের তৃতীয় দিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেননের মধ্যস্থতায় দাবির বিষয়টি পুনরায় যাচাই করে দেখার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা অনশন ভঙ্গ করে। পরে মেনন উদ্যোগী হয়ে ১১ মে বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষামন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধির আলোচনার আয়োজন করেন। আন্দোলনরত ৪০-৪৫ জন ছাত্রছাত্রী ১৪ মে থেকে টাঙ্গাইল শহরের পৌর উদ্যানে আবার অনশন কর্মসূচি শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বারবার অনশনরত ছাত্রছাত্রীদের তাদের অনশন প্রত্যাহার করে ক্লাসে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। ২২ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রী উল্লিখিত বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের অনশন প্রত্যাহার করে ক্লাসে ফিরে আসতে আহ্বান করেন। ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী, জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ ও রাজনৈতিক নেতারা অনশনস্থলে গিয়ে অনশনরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনার পর তাদের অনশন ভঙ্গ করান।
আমরা মনে করি, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই বোঝে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার, এখানে তার একান্তই অভাব। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব অভাব পূরণে অত্যন্ত তৎপর এবং আন্তরিকভাবে কাজ করে চলেছে। আমরা সবাই প্রত্যাশা করি, ছাত্র-শিক্ষকের এই সম্পর্ক দিন দিন আরও উন্নত হবে।
লেখকরা: শিক্ষক, ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.