রাজনৈতিক আলোচনা- 'আবার আসিব ফিরে!' by মামুন রশীদ

থা হচ্ছিল একটি সামাজিক ক্লাবের ‘বাষ্প-স্নানঘরে’। অগ্রজপ্রতিম শাহীন খন্দকার (প্রকৃত নাম নয়) বলেই বসলেন, যতই সামরিক আইন বা সংবিধানবহির্ভূত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় আবারও আসবে ‘বিশেষ ধরনের সরকার’। হয়তো বা নতুনরূপে, নতুন আদলে। বিশ্বের খুব কম জাতিই অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলি চিহ্নিত করে তা সমাধান করার এবং মৌলিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার সুযোগ পায়।
অনেকেই বলেছেন, আমাদের দেশে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তথা ১/১১-এর ঘটনায় তেমনই এক অবস্থা তৈরি হয়। সাধারণত সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবর্তন ধীরগতিতেই চলে এবং এমনকি পরিস্থিতির উত্তরণে বছরের পর বছরও লেগে যায়। এমনই এক অবস্থায় আমাদের দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও টানাপোড়েনের জের ধরে ১/১১-এর মতো অবস্থাটি দেখা দেয়। ১/১১-এর সরকারের অনেক ভুল ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় এক বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এই যে দেশজুড়ে প্রবল এক আশাবাদের মধ্য দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইসহ সার্বিকভাবে সংস্কার ও উন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়া হলো তা ধরে রাখতে না পারা এখন ইতিহাসেরই অংশ।
আমাদের অবশ্য এই সত্যও মেনে নিতে হবে যে ১/১১-এর মতো ঘটনা সব সময় ঘটে না এবং যে পরিস্থিতিতে এটি ঘটেছে সেটি কোনোভাবেই কাম্য বা কাঙ্ক্ষিত নয়। কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জের ধরেই কিন্তু আমাদের দেশে ১/১১-এর ঘটনা ঘটেছে। ইতিহাস ও সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা ও কার্যক্রমের সুবাদে আমাদের তেমন নৈরাশ্য দেখতে হয়নি। কারণ তাঁরা স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিদের কিছুটা হলেও ধাক্কা দিতে পেরেছেন।
মর্মান্তিক বিষয় হলো, আমাদের রাজনীতিবিদেরা কখনোই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের শোধরাননি। তাঁদের গয়রহ রাজনৈতিক ভিশন বা লক্ষ্যও যে সুদূরপ্রসারী ও স্বচ্ছ নয় সেটিও এখন প্রমাণিত। তাঁদের বিবেকতাড়িত নীতিবোধ দেখিয়ে কোনো কাজ করার দায় কিংবা কোনো কাজ না করার ভুল স্বীকার করতেও দেখা যায়নি। অথচ তাঁরা ক্ষমতার প্রকৃত মালিকদের (হায়ার এনটিটি) জবাবদিহি করতে বাধ্য। যে কারণে সেই ‘বিশেষ সময়ে’ নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত, দায়িত্বজ্ঞানহীন, আদর্শবিচ্যুত ও অদূরদর্শী রাজনীতিবিদদের অনেককেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে এবং শাস্তির পরিণতি মেনে নিতে হয়েছে।
১/১১-এর পালাবদল কি কাঙ্ক্ষিত ছিল কিংবা এমনটি ঘটতে পারে বলে কি কোনো ভবিষ্যদ্বাণী ছিল? অবশ্যই নয়। কিন্তু কেন নয়? এর আগে তো টানা ১৫ বছর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত তিনটি সরকার দেশ পরিচালনা করেছিল। তারা তো ছেলে ভোলানো গল্পের মতো একধরনের বুলি শুনিয়ে শুনিয়ে দেশের জনগণকে ঘুম পাড়িয়েই রেখেছিল। এর মধ্যেও জনগণ আরও একবার ‘তথাকথিত’ গণতান্ত্রিক নির্বাচনে পাঁচ বছরের জন্য ভোট দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যদিও ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এর রঙ্গমঞ্চে রূপকথার গল্পের তথাকথিত ‘রাজপুত্তুর’, দুর্নীতিবাজ নেতা ও তাদের সন্ত্রাসী নিকটাত্মীয়, অসাধু ব্যবসায়ী কিংবা গডফাদারদেরই সদর্পে প্রার্থী হতে দেখা যেত। আর সর্বশেষ ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রশাসনের সর্বস্তরে নিজেদের সমর্থিত ও দলীয় তাঁবেদারদের বসানো হয়েছিল, যাতে জয়ের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যায়।
অন্যদিকে আরেক বৃহৎ দলটিরও নির্বাচনের তেমন প্রস্তুতি ছিল না বলে শোনা যাচ্ছিল। তাদের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হবে না এমন একটি বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারাও শত্রুভাবাপন্ন অন্য দলটির প্রতি নেতিবাচক হয়ে ওঠে এবং ভোটের পথ ছেড়ে মারমুখী অবস্থান নেয়। দাবি না মানা পর্যন্ত তারা নির্বাচন বর্জনের হুঁশিয়ারি দেয়। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা। ব্যস, অমনি রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও সুযোগ-সন্ধানী লুটতরাজকারীরা দেশে চরম এক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। অথচ ওই সময় যদি ক্ষমতাসীন দল খানিকটা সহনশীলতা দেখাত এবং বিরোধী পক্ষও তাদের দাবিতে কিছুটা ছাড় দিত, তাহলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে (১/১১) হয়তো পালাবদলের ঘটনা ঘটত না। এতে হয়তো একদিকে আগের মতোই দায়সারা গোছের বা নামমাত্র গণতন্ত্র থাকত এবং অন্যদিকে এর তথাকথিত ধ্বজাধারীরা বরাবরের মতোই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ত।
এবারে চলুন, জনমিতির পরিসংখ্যান নিয়ে কিছু কথা বলি। আজকে সাত বছরের যে শিশুটি অশিক্ষিত, ২০ বছর পরে সে হবে ২৭ বছরের যুবক। তখনো তো সে এ দেশে অশিক্ষিতই থেকে যাবে। আর অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো দুর্ভিক্ষ বা গৃহযুদ্ধ না বাধলে ২০ বছর পরে যখন দেশের জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ৩০ কোটিতে দাঁড়াবে তখনো তো এই ছেলেটির মতো লোকেরাই (অশিক্ষিত) হবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। পরিস্থিতি না পাল্টালে তখনো প্রায় প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সর্বত্র বিদ্যুৎ ঘাটতির পাশাপাশি ৬০ শতাংশ লোক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তেমনি এক অবস্থায় এ দেশে বসবাস করাটা রীতিমতো দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। ২৭ বছরের সেই যুবকটি তখনো হয়তো অশিক্ষিত ও অদক্ষ বলে ভালো চাকরি পাবে না। বদৌলতে জীবনসংগ্রামে বারবার সে হোঁচট খাবে, ব্যর্থ হবে। আর ভাববে, রাষ্ট্রব্যবস্থা ২০ বছর আগে তাকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। এখনকার লাখ লাখ শিশুও যে তার মতো পরিস্থিতির শিকার হবে এবং ভাগ্যের উন্নতি না ঘটার জন্য একদিন কিন্তু এরা সবাই আজকের স্বার্থপর ও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদদেরই দুষবে। তাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার জন্য কোনো একসময় তারা যে নতুন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বেপরোয়া সময়ের কাজ বা পদক্ষেপও হয়ে থাকে বেপরোয়া ধরনের। কথায় আছে, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকূলে বাড়িছে সে।’ ন্যায্য অধিকার ও সুবিধা থেকে বঞ্চিতরা যেদিন জেগে উঠবে সেদিন তাদের প্রতিশোধপরায়ণ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই হয়তো বৈষম্যের সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। দেশকালভেদে কিন্তু সাধারণ মানুষের জাগরণের মধ্য দিয়ে এ ধরনের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে, বর্তমানেও ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও এর ব্যত্যয় হবে না। অর্থাৎ, এককথায় ইতিহাস বারবার ফিরে আসে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশেও ১/১১-এর মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। তবে তখন হয়তো তা সংঘটিত হবে নতুন নামে, নতুন আঙ্গিকে, নতুন মানুষের দ্বারা। দেশে রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে জনকল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত না হলে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন না ঘটলে, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ও সুশাসন না থাকলে এবং জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন না হয়ে শুধু কতিপয় লোক ফুলেফেঁপে উঠলে ভবিষ্যতের ‘১/১১’ তথা দিন বদলের অঙ্গীকারপুষ্ট নতুন আন্দোলন বা সংখ্যাগরিষ্ঠের উত্থানটা হয়তো এবারের চেয়ে বেশি কঠোর ও ক্ষমাহীন হতে পারে। এর চেয়ে বরং দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি দলগুলোতেও সর্বাত্মক সংস্কার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়ে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও দুর্নীতির গ্লানি ঘুচিয়ে, যেন ১/১১-এর মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
ইতিহাস না হয় তার নিয়মেই বারবার ফিরে আসবে, কিন্তু যেই সময়টা একবার কালের অতলে চলে যাবে, তা তো আর কোনো দিন ফিরবে না। সুতরাং বর্তমানকেই সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ধরে নিয়ে আমাদের সংস্কার ও পরিবর্তনের পথ ধরতে হবে। এদিকে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণ একটি রাজনৈতিক চক্রও দিনে দিনে বিকল্প শক্তি সঞ্চারের চেষ্টা করছে। একমুহূর্ত সময়ও আর নষ্ট না করে এদের চিহ্নিত করা উচিত। তা না হলে এরা সুযোগ বুঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। সেই সময় কিন্তু আমরা অতীতের তালগোল পাকানো ভুল শোধরানোর সুযোগ হাতছাড়া করাসহ সার্বিক ব্যর্থতার দায়ভার নিজেদের ঘাড়ে নেওয়া ছাড়া অন্য কাউকেই খুঁজে পাব না। হয়তো শাহীন খন্দকার সত্য প্রমাণিত হয়ে বলবেন, ‘আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।’
===============================
আলোচনা- 'রাজকীয় সম্মেলন'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'অসারের তর্জন-গর্জন'  আলোচনা- 'একজন নোবেল বিজয়ী, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ'  স্মৃতি ও গল্প- সেই আমি এই আমি  গল্প- 'ঘুঁটি'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি : মিয়ানমারে কি কি গণতন্ত্র আসছে?  শিল্পি- শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র  সাহিত্যালোচনা- তান তুয়ান এঙের উপন্যাস দ্য গিফট গিফট অব রেইন  খবর- বন্ধ তাবানীতে লোক নিয়োগ  ইতিহাস- আমাদের ভাববিশ্ব ও বৌদ্ধবিহার  স্মৃতি ও ইতিহাস- ঢাকায় আমার প্রথম তিন দিনের স্মৃতিরোমন্থন  আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে  আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার  গল্প- দূর গাঁয়ের গল্প  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা  পাঁচ গাড়িসহ দুই ছেলের মালপত্র বুঝে নেওয়া হলো আজ বাকিগুলো  গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে'  গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ মামুন রশীদ
ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.