স্মৃতি ও ইতিহাস- ঢাকায় আমার প্রথম তিন দিনের স্মৃতিরোমন্থন by আবদুশ শাকুর

ঢাকায় এ পর্যন্ত বাস আমার সাকুল্যে পঞ্চাশ বছরের। এর সবটুকুই ঢাকা শহরে। শহরটিকে প্রথমবার দেখেছি আমি বড়জোর ছবছর বয়সে, ১৯৪৫ সালে। সে-দেখার সূত্রটি কিন্তু সাধারণ ছিল না, ছিল বিশেষ তো বটেই বরং বিরল_খোলা কথায় বলতে গেলে আমার স্বভাবগত গৃহাকুলতাপ্রসূত। ব্যাপারটা ঈষৎ লজ্জার হলেও গ্রামীণ শিশু শাকুরের নাগরিক আবদুশ শাকুর হওয়ার সূচনাটিকে তো হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।
প্রাইমারি-ফাইনাল ভালো পাসের খবর পেয়ে শহুরে-চাকুরে আমার ফকফকে ফর্সা মেজো মামা তাঁর ঝকঝকে সাইকেলখানি হাঁকিয়ে আমাদের বাড়ি এসে প্রথমে ভাগ্নের পৃষ্ঠদেশে প্রবল অভিনন্দন জ্ঞাপন করলেন। অতঃপর প্রবলতর ভীতি প্রদর্শন করে বললেন যে ক্লাস ফাইভে আমাদের অখ্যাত 'চাপরাশীর হাট' স্কুলে ভর্তি হলে গোরুগাড়ির গাড়োয়ান হওয়া ছাড়া আমার গত্যন্তর থাকবে না। পরপরই অবশ্য প্রবোধ দিলেন যে এই মহাবিপদ এড়ানোর একমাত্র উপায় তাঁদের বিখ্যাত 'বামনিয়া মাইনর স্কুলে' ভর্তি হয়ে মামাবাড়িতে থাকা। মহাবিপদটির ভয়ে আমি এককথায় রাজি হয়ে গেলাম। কারণ আম্মার সঙ্গে গোরুগাড়িতে মামাবাড়িতে যাওয়া-আসার অভিজ্ঞতায় আমার ভালোই জানা ছিল যে_বোঝার চাপে ভারাক্রান্ত আর ক্ষুধার চাপে পরিশ্রান্ত, ড্যাবড্যাবে চোখের অসহায় দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকা, শান্ত-নীরব গোরুগুলিকে অনবরত প্রহাররত হিংস্র জানোয়ারটির নামই গাড়োয়ান। তার ওই বর্বর কাজটা আমার দ্বারা হবে না।
কিন্তু গাড়োয়ান না-হওয়ার সাধনায় জীবনে প্রথম আমার-মাকে ছেড়ে তাঁর মায়ের বাড়িতে থাকতে গিয়েই আমি আবিষ্কার করলাম যে মায়ের থেকে দূরে থাকার মতো বীরত্ব প্রদর্শন করা আমার পক্ষে সম্ভব না_নানাবাড়ির সার্বিক এবং সার্বক্ষণিক আদরের ছত্রছায়ায়ও না। তার পরের তিন-চারটি মাস ধরে নানাবাড়ির দিকে যাত্রা-না-করা, করেও না-পেঁৗছা, পেঁৗছেও না-থাকা, দু-একদিন থেকেও নিজের বাড়ির কাছের নানা কাজের-নানা মাপের যেকোনো লোক পাওয়া মাত্রই তার পিছু নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার হাস্যাস্পদ যত কাঁচা বাহানা আমি সবই খুঁজে পেয়েছি। অর্থাৎ সম্ভাব্য সব রকমের থিমের ওপর কমেডি, ট্র্যাজেডি, ট্র্যাজিকমেডি ইত্যাদি সব রকমের ড্রামা-মেলোড্রামাই আমি রচনা করতে পেরেছি। পারিনি কেবল মামাদের সেই 'মোটরগাড়ির ড্রাইভার বানানো'র মাইনর স্কুলে পড়াশোনা করতে।
ঢাকাবাসী মেজোখালুর বাড়িতে থেকে ঢাকা কলেজে পড়াশোনায় রত আমার অগ্রজ ছুটিতে বাড়ি এসে সব কিছু শুনেও কিন্তু অনুজের সমগ্র রচনাকে খাঁটি গ্রিক ট্র্যাজেডি বলেই রায় দিলেন। রায়ে এও উল্লেখ করলেন যে একান্ত মর্মাহত না-হলে এমন অল্পবয়সী শিশুর পক্ষে এত রকম মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি বিরচন সম্ভব নয়। অতএব মর্মে আহত শিশুটির কচি মর্মটির মেরামতকল্পে তাকে ছুটির পর ফেরার সময় তার সহৃদয় বড়ভাই সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। ঢাকায় সেই আমার প্রথম আসা_দেশের সর্বদক্ষিণের টার্মিনাল রেলস্টেশন নোয়াখালীর সোনাপুর থেকে ট্রেনে উঠে দীর্ঘতর রুটে ভৈরব ঘুরে টঙ্গী হয়ে নয়, লাকসাম ঘুরে নারায়ণগঞ্জ হয়ে।
ফুলবাড়িয়া স্টেশনে রেলগাড়ি থেকে নেমে রূপকথার ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে লালবাগ রোডের আমলিগোলা বরাবর পেঁৗছে গাড়োয়ানের দাম চুকিয়ে বদ্দুপাড়ার মানুষ-মাপের সরু গলিটি ধরে এঁকেবেঁকে হাঁটতে হাঁটতে নতুনের পর নতুন দেখতে দেখতে কৌতূহলে ফতুর আমি কোনো কথা না-পেয়ে একটা অকথাই বললাম : লোকটা খুব ভালো। তার নিজের গাড়িতে আমাদের খালুর বাড়িতে পেঁৗছিয়ে দিল। আসলে জন্মাবধি গোরুর গাড়িতে মায়ের সঙ্গে নানাবাড়ি যাওয়া-আসা করা বালকটি জীবনে প্রথম রেলগাড়ি এবং ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে পেরে তখন আনন্দে আত্মহারা।
যাহোক, কয়েক মিনিট হেঁটেই নদীর ধারের শাহসাববাড়ি ঢুকতেই খালুর হুকুম : হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করে তারপরে কথা_এক রাত-এক দিনের উপোস বলে কথা। তার মানে, আগের দুপুরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে খেয়ে ছেড়ে আসার পর থেকে এ-দুপুর পর্যন্ত রাস্তার নানা রকম খাওয়াকে খালু নাস্তা বলতেও নারাজ। আমিও তাঁকে খালু ভাবতে নারাজ ছিলাম তখন। কাঁধ পর্যন্ত গড়িয়ে পড়া বাবরি চুল আর জ্যান্ত নখের দ্বিগুণ মৃত নখওয়ালা, চাদরস্বরূপ ছালা গায়ে দেওয়া, শুকনো পাঠখড়ির মতো সরু দুবলা পাতলা মানুষটি কিভাবে আমার খালু হতে পারেন_সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না বলে আমি তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে আপন করে নিতে আগ্রহী হচ্ছিলাম না। ক্রমে ক্রমে অবশ্য জেনেছি যে সবই ছিল তাঁর গুরুর মারফতি সিলসিলা। এঁদের তরিকার আদর্শ সম্ভবত প্রাকৃতিক কোনো প্রবৃদ্ধিরই অন্তরায় না-হওয়া আর কৃত্রিম বস্ত্র যথাসম্ভব কম পরা। পায়ে কাঠের খড়ম, পরনে তাঁতের লুঙ্গির ওপর খালি গায়ে ছালার চাদর_এই ছিল তাঁর মোট জামাকাপড়।
খালি খালুকে নয়, বাড়িটাকে আমি আপন করে নিতে পারছিলাম না বান্দরের কারণে। এটা যেন বান্দরেরই বাড়ি, মানুষের নয়। বারান্দায়, জানালায়, কার্নিশে, দেয়ালে, ছাদে, গাছে_যেদিকে তাকাই, যেখানে যাই দেখি কেবল বান্দর আর বান্দর। পরের দিনগুলিতে প্রধানত বিভিন্ন মসজিদে বান্দরের চেয়ে অজস্র জালালি কবুতর দেখে বুঝি যে ঢাকা শুধু বান্দরেরই শহর নয়।
হাত-মুখ ধুতে ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন খালুর গুরুগৃহের ভেতরেই করিম শাহ ফকিরের বানানো অতীব সুন্দর একটি মসজিদের ওজুখানায়। চুন-সুরকিতে চিনেমাটির রেকাবি-বরতন-ভাঙা বড় বড় টুকরা দিয়ে মোজাইক করা মসজিদটির সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে বাইরেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল, গ্রামের পলেস্তারা খসা হাড়জিরজিরে মসজিদ দেখা বালকটি। হাত ধরে ভাই আমার চমক ভাঙিয়ে ভেতরে নিয়ে পানির কলের হাতলটি, মানে বিপকক্টি ঘুরিয়ে দিতেই সাপ্লাই-লাইনের পানি বেরুতে থাকল অবিরাম। জন্মাবধি আয়াসে চাপাকলের সবিরাম পানি বের করা বালকটি অনায়াসে কলের পানির অবিরাম বের হওয়া দেখে অপার বিস্ময়ে হতচকিত। পরে জেনেছি, ঢাকা শহরে পানি সরবরাহব্যবস্থা শুরু হয় আমার দাদার জন্মেরও আগে, ১৮৭৪ সালে_নবাব খাজা আবদুল গনি নির্মিত চাঁদনিঘাট পানি-বিশুদ্ধিকরণ প্লান্টের মাধ্যমে।
ঢাকায় আমার সেই প্রথম দিনটির সন্ধ্যার পর শহর দেখার জন্য ভাইয়ের হাত ধরে শাহসাববাড়ি থেকে বেরোতেই সরু গলিটির ঘরে ঘরে চিরুনি বানানোর চমৎকার দৃশ্যাবলি দেখলাম। হঠাৎ একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন ভাই। লক্ষ করলাম, এক কারিগর চেরাই শেষ করে এমন একটি চিরুনি রাখলেন, যেটি দিয়ে আম্মা আপার চুল আঁচড়ে হাতে বের করেন উকুন, আর মুখে বলেন_'তোর চুলের জঙ্গল থেকে সব উকুন বের করা যায় একমাত্র ঢাকার এই মোষের শিঙের চিরুনি দিয়ে। যশোরের প্লাস্টিকের চিরুনি দিয়ে একটাও বের করা যায় না'। আমার আবিষ্কারটা জানাতেই ভাই বললেন, সে-চিরুনিটি তো আম্মার জন্য আমি এঁর হাতেই বিশেষ যত্ন সহকারে বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমিও ধন্য হলাম আপার মাথায় নিত্যদেখা চিরুনিটির স্বয়ং নির্মাতাকে চাক্ষুষ দেখে।
পরদিন ছিল শুক্রবার। দিনটি ছিল আমার মতো শিশুর জন্যও পরম আধ্যা@ি@@@ক_অর্থাৎ একের পর এক মারফতি কিংবদন্তি শোনার দিন। শাহসাববাড়ির সব কিছুই অলৌকিক ঠেকছিল আমার কাছে। সকালেই আমাকে উঠোনের আমগাছটি থেকে আম পেড়ে খাওয়ালেন খালুর আবাসিক মুরিদ ও ব্যক্তিগত খাদেম আজিজভাই। আমটি ছিল যেমন কচি, তেমনি মিষ্টি। জিজ্ঞেস করলাম, এত কাঁচা আম কী করে এত মিষ্টি হয়? আজিজভাইয়ের ভক্তিবিগলিত জবাব : বাবার দয়ায়। বলেই তিনি পাশের গাছটি থেকে কামরাঙা পেড়ে খাওয়ালেন, যেন খালুর গুরুর আরেকটি কেরামতি দেখাবেন বলে। দেখালেনও। কামরাঙাটা আরো কাঁচা, তবু আরো মিষ্টি। কারণ জানতে চাইলে আজিজভাই এবার বিস্তারিত জানালেন।
করিম শাহ ফকির দোহার থানার এক মুরিদের বাড়িতে গিয়ে একটি কামরাঙা গাছের নিচে বসতেই মুরিদ বলে উঠল_বাবা! গাছটার কামরাঙা এত টক যে দাঁত বসানো যায় না। শুনে বাবা বলেছিলেন_আগামী বছর এই গাছটার কামরাঙা মিঠা অইলে একটা চারা আমারে দিবা। পরের বছর গাছটার কামরাঙা দারুণ মিডা হওয়াতে লোকটা একটা চারা বাবার লাইগা লইয়া আইছিল। এই সেই চারার গাছ আর তার ফল। আমার স্বাভাবিক প্রশ্ন_কিন্তু কী করে আগের বছরের প্রবল টক পরের বছর প্রবল মিষ্ট হয়ে গেল? ভক্তের আধ্যা@ি@@@ক উত্তর_বাবার দয়ায়।
তাহলে এবার আমার প্রিয়তম ফলটি খাওয়ান, পেয়ারা_কিন্তু বাবার দয়া-পাওয়া। জবাব পেলাম, এ বাড়িতে পেয়ারা গাছ নেই। প্রশ্ন করলাম : আতা আছে, শরিফা আছে, পেয়ারা নেই কেন? এবারও উত্তর পেলাম : বাবার দয়ায়। মানে? ততক্ষণে আমার বন্ধু হয়ে যাওয়া আজিজভাই বললেন : তা-ও আরেক কুদরতি ব্যাপারই। এক পেয়ারের মুরিদের অসুস্থ পোলার রোগ কোনো চিকিৎসায়ই সারতাছে না শুইনা পোলাটারে দেখতে বাবা নিজে গেলেন। তার বারিতে ঢুইকাই একটা পেয়ারা গাছ দেইখা বাবায় কইলেন_এই গাছটার ফল তোমরা খাইবা না, গাছটা আমারে দিয়া দাও। মুরিদ 'দিলাম' কইতেই বাবা ফিরা আইলেন ছেলেটারে না-দেইখাই। কয়েকদিনের মধ্যেই গাছটা মইরা গেল এবং পোলাটা সাইরা উঠল।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে ভক্ত আজিজভাইয়ের কাছে শোনা এসব অলৌকিক ঘটনা শাহসাববাড়ির গৃহশিক্ষক বাহাউদ্দিন সাহেবকে বললে অবিশ্বাসী মাস্টার বললেন_ওসব আকস্মিক ঘটনা, অলৌকিক নয়। অতঃপর বিভ্রান্ত বালকটিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন_তালগাছে কাক বসা অবস্থায় তাল পড়তে দেখেছ কোনো দিন? বললাম, একদিন দেখেছি। বল তো কেন পড়েছিল তালটা? বললাম, পেকে গিয়েছিল বলে। ঠিক তাই। আজিজ মিয়া বলবে, কাকের ভারে পড়ে গেছে তালটা। আমার আস্থাটা মাস্টারের কথার ওপরই বহাল রয়ে গেছে আজ অবধি। এই কামিল ফকিরের মৃত্যুর দুই বছর আগেই তাঁর কবর নির্মিত হয়েছিল। করিম শাহ ফকিরের ইন্তেকালের পর তাঁর প্রধান শিষ্য ফকির মৌলভী এরশাদ উল্লাহ (আমার খালু) তাঁর গদিনশিন হন।
খালুর গদিনশিন হওয়ার আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত, ঘটনাটার মাত্র ১২ বছর পরই ঢাকায় আসার কারণে, আমি জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী প্রবীণের কাছে যা শুনেছিলাম, তা অলৌকিক শোনালেও, রটনার বদলে ঘটনা বলেই মানতে হয়। কবর নির্মাণ করে দুটি বছর অপেক্ষার পর করিম শাহ ফকির একদিন নদীর ধারে গিয়ে দেখেন, একটি লাশ নদীতে ভাসতে ভাসতে এসে তাঁর বাড়ির ঘাটেই ভিড়েছে। ঘাটে নেমে লাশটি দেখে ফকির বলে ওঠেন : 'আইয়া পরছছ? তর লাইগা আমি দুইটা বছর বইয়া রইছি'। মৃতকল্প মানুষটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁকে গদিতে বসিয়ে করিম শাহ ফকির দুনিয়া থেকে বিদায় নেন এবং তাঁর 'জিন্দা' কবরটিতে সমাহিত হন।
দুপুরবেলা আমলিগোলা শাহী মসজিদে জুমা পড়তে যেতে বড়ভাই ছোটভাইটিকেও সঙ্গে নিলেন। দেখলাম দোকান বন্ধ করে কারিগরপাড়ার সবাই চললেন মসজিদে। ফেরার সময় রাস্তার ধারে শাহসাববাড়ির দিকের গলির মুখে শাপলা ফল, পানিফল ইত্যাদির ডালি নিয়ে বসা লোকগুলির কাছ থেকে কিছু না নিয়ে ভাই একটু দূরে বসা একজনের কাছ থেকে অতি অসুন্দর একটি ফল কিনলেন, নাম যার অতি সুন্দর_'মাখ্না'। ক্ষেতের আলু-খাওয়া সজারুর মতো কাঁটাওয়ালা কালো রঙের বিদঘুটে ফলটি কেন কিনলেন জিজ্ঞেস করলে ভাই বললেন_একই উদ্ভিদের ফুলে আর ফলে কত পার্থক্য থাকতে পারে, সেটা দেখানোর জন্য। পরদিন সকালে আজিজভাই শাহসাহেববাড়ির ঘাটে বাঁধা পারিবারিক নৌকাটি চালিয়ে আমাদের নদীতে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরের দিকে গিয়ে আমার জন্য 'মাখ্না' ফলের একটি ফুল জোগাড় করলেন। এত সুন্দর যে বিশ্বাসই হয় না, ওই ফলের এই ফুল।
বিশাল আকৃতির পাতায় আধারিত হালকা বেগুনি রঙের ফুলটির ভেতরের অংশ উজ্জ্বল লাল। অনেক পুংকেশরসমৃদ্ধ, পাপড়িও অনেক। পাপড়িগুলি ওপরে উঠেছে কয়েকটি ভাঁজে। গোলাকার রাজকীয় পত্রের সৌন্দর্যও পুষ্পের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মৌসুমে পুরান ঢাকার পথে পথে মাখনা বিক্রি হতো। কিন্তু আশপাশের খালবিলের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা থেকে হারিয়ে গেছে বিচিত্র এই জলজ উদ্ভিদটি। সুখ্যাত গ্যাস্ট্রোনোম হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর বিখ্যাত 'ঢাকা পাচাস বারাস পাহেলে' গ্রন্থে লিখেছেন_'ঢাকার খান্দানি পরিবারে মাখনা ছিল একটি জনপ্রিয় ফল। নবাববাড়ির বেগমরা বিদেশে ভ্রমণের সময়ও এই মাখনা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।'
সেদিনই বিকেলে ভাই কৌতূহল মেটাতে আমাকে ঘোড়ার গাড়ির গতি দেখাতে লালবাগ রোডে নিয়ে গেলেন। দেখলাম, শোফার-চালিত ও ঘণ্টাবাদিত ট্রটিং-গতির ঘোড়াগাড়িগুলির উন্নতশির রাজকীয় চাল। ফেরার পথে সন্ধ্যা সমাগত দেখে আরেকটা মজা দেখাতে তিনি জগন্নাথ সাহা রোডের বিশেষ একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে ডানে-বাঁয়ে পথের ধারের সমান লম্বা দু-তিনটা খুঁটি দেখিয়ে বললেন, কিছুক্ষণ পরপর খুঁটিগুলির মাথার দিকে তাকাবে। বললাম, অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে; একটু পরে মাথাগুলি তো আর দেখাই যাবে না। তিনি বললেন, মাথাগুলি তখনই দেখা যাবে বেশি।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাবলাম, ভাই আমাকে বোকা বানাচ্ছেন। আমি বোকা না-বনার জন্য যেই চোখ নামাতে যাব, অমনি দেখি খুঁটির মাথায় ঠিকরানো রশ্মিসংবলিত তীব্র আলো জ্বলে উঠল_কুপি-হারিকেন থেকে বহুগুণ বেশি উজ্জ্বল। ভূতের কাণ্ড ভেবে ভয়ে ভাইয়ের হাত জোরে আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, একসঙ্গে তিনটা খুঁটির মাথায় বাতি জ্বললো কী করে? কে জ্বালালো? একটা খুঁটির মাথায়ও তো চড়তে দেখলাম না কাউকে। ভাই বললেন, আগের দিন কাঠের খামের উপ্রে কেরোসিনের বাতি জ্বলত। রোজ সন্ধ্যায় একটা লোক বাঁশের সিঁড়ি কাঁধে নিয়ে প্রতিটি খামের মাথায় উঠে বাতি জ্বালাত। এখন পুরানা পল্টনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে সন্ধ্যা হলেই একটা সুইচে চাপ দেয় আর সারা শহরে একসঙ্গে সব লাইটপোস্টের বাতি জ্বলে ওঠে। পুষ্পরাজ সাহা নামের এক বিরাট ব্যবসায়ী আমলিগোলার প্রধান সড়কে নিজ খরচে বিদ্যুৎবাতি স্থাপন করার বিনিময়ে আমলিগোলা মহল্লার নাম তাঁর পিতার নামে জগন্নাথ সাহা রোডে রূপান্তরিত করেন।
আমার ঢাকা আসার তৃতীয় দিনের চমক ছিল সেকালের ঢাকার অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য আমলিগোলার পুষ্প সাহার রাজকীয় প্রাসাদ দেখা। বাড়িটির বিশাল ঘাটওয়ালা পুষ্করিণীটি ছিল শুধু দর্শনীয় নয়, স্মরণীয়ও। সেই বাড়ি দেখাতে বড়ভাই আমাকে নিয়ে বেরোবেন শুনেই খালু তাঁর খাস খাদেম আজিজ মিয়াকে সঙ্গে যেতে বললেন, যেহেতু গোটা এলাকাটা তাঁর নখদর্পণে এবং ছালাওয়ালা শাহসাবের নিকটচারী মুরিদ হিসেবেও অনেকে তাঁকে চেনে-জানে ও মানে। শাহসাববাড়ি থেকে আঁকাবাঁকা গলি বেয়ে জগন্নাথ সাহা রোডে উঠে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকলাম আমরা। গন্তব্যের দূরত্ব অল্প হলেও আমার পথ যেন শেষই হচ্ছিল না। আমলিগোলা জামে মসজিদ ছাড়িয়ে কিছুটা পথ পেরিয়ে যাওয়ার পর একটা পুকুর আর তার পার্শ্ববর্তী একতলা বাড়িটি দেখে হতাশ হয়ে ভাইকে বললাম_আমাদের গ্রামের বাড়ি-পুকুরের চেয়ে ছোট, এগুলি দেখার জন্য এতদূর আসার কী দরকার ছিল। ভাই বললেন, এগুলি না; পুষ্প সাহার বাড়ি আর পুকুর দেখে তুমি মূর্ছাই যাও কি না তাই নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছি আমি। আজিজ ভাই বললেন, 'কোথায় বেপারির তালাও, কোথায় পুষ্প সাহার তালাও!'
এরপর চৈতন্য নামের একটি স্কুল ছাড়িয়ে বেশ কিছু দূর গিয়ে বাঁয়ের সরু গলিতে ঢুকে কিছুক্ষণ হাঁটার পরই একটা নতুন শহর চোখে পড়তেই জিজ্ঞেস করলাম, এটা আবার কোন্ শহর? ভাই বললেন_শহর না, বাড়ি। এটাই পুষ্প সাহার বাড়ি। পাশেরটা তাঁর ভাই কৃষ্ট সাহার বাড়ি_বললেন আজিজ ভাই। জিজ্ঞেস করলাম : নদী নাই, খাল নাই, পানিও নাই_রাস্তার ওপর পুল কেন? আজিজ ভাই বললেন : ওইটা পুল না, ঝুল-বারান্দা; দুই বাড়ির মানুষগো আওন-যাওনের বারান্দা। ভাই বললেন : আমরা উত্তরদিক থেকে এসে বাড়িটির উত্তর দেয়াল দেখতে পাচ্ছি, যার ওপর রং-বেরঙের চিনামাটির টুকরার নানা রকম নকশা-নমুনা। বাকি পূর্ব, পশ্চিম আর দক্ষিণ দিক খোলা_তিন দিক থেকেই বাড়িটিতে ঢোকার গেট আছে।
তারপর দক্ষিণের চতুর্দিক দেয়ালে ঘেরা বিশাল পুকুরটির ঘাটের চাতালে গিয়ে দেখলাম এ এক বিরাট দীঘি, যার কূল নাই কিনার নাই। পুকুরে এত লোকে গোসল করছিল যে আমি কয়েকবার করে দুহাতের আঙুলের করে গুনে বের করতে পারিনি অগণ্য স্নাতকদের মোট সংখ্যা কত। আজিজ ভাই বললেন, আরেকটা ঘাট আছে খালি জেনানাগো লাইগা। আমি বললাম, আজকের গোসল আমি এই সুন্দর পুকুরটিতেই করে যাব। আমাদের এ মুহূর্তের গার্জেন হাসিতে ফেটে পড়লেন তাঁর দর্শনীয় বাবরি চুল নাচিয়ে। অবশেষে বললেন :
'এ লাইগাই তো বাবায় আমারে লগে পাঠাইছে। এই পুকুরে হিন্দু গো কাপড়-গা ধুইতে সোডা-সাবান লাগান মানা আর মোসলমান গো নাহানই মানা।'
'কেন? মোসলমান কি সোডা-সাবান?'
'তার থেইকাও খারাপ হ্যাগো কাছে।'
আজিজভাইয়ের কথাটা বড়ভাইও মেনে নিলেন দেখে মনটা আমার খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
ঢাকায় আমার সেই তৃতীয় দিনটির রাত্রে আমাদের দাওয়াত খেতে যেতে হয়েছিল শাহসাব-খালুর বিশিষ্ট মুরিদ এবং ভাইসাবের ঢাকা কলেজের সহপাঠী কিসলু মিয়াদের বেগমবাজারের বিখ্যাত একটি বনেদি বাড়িতে। শাইন করা জেটব্ল্যাক গ্ল্যাস্কিটের পামশু, ধবধবে সাদা শার্কস্কিনের ট্রাউজারের ভেতরে ঢোকানো টুইল বুনটের একই রকমের ধবধবে সাদা শার্ট আর অতি সরু সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা হীরের মতো ঠিকরানো দ্যুতিময় কিসলু মিয়া আমার ঢাকায় আসার দিনই শাহসাববাড়ি এসে তকতকে সাইকেলখানি থেকে নেমেই ছুটি থেকে ফেরা ভাইসাবকে পেয়ে প্রাণোচ্ছল হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন।
দেবকান্তি মানুষটি যেন মাটির মানুষ নন, আকাশের ফেরেশতা। মাটির মানুষ হলেও এঁর ধমনিতে বইছিল আমাদের চেয়ে ভিন্ন কোনো জাতের রক্ত। তখন আমার এমন বোধ হওয়ার কারণ ছিল_আমি নির্ভেজাল কালো, বড়ভাই উজ্জ্বল শ্যামল আর কিসলুভাইয়া ছিলেন ফকফকে ফর্সা। বর্ণসাংকর্যের ব্যাপারটা বুঝেছিলাম অনেক পরে_আমরা আফ্রিকান হাইব্রিড হলে কিসলুভাইয়ারা ছিলেন ককেশিয়ান হাইব্রিড। পরদিনও এসেছিলেন তিনি, তার পরদিন তাঁদের বাড়িতে আমাদের রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানাতে।
বেগমবাজারের বাড়িটিতে গিয়েই আমি কিসলুভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম_বেগমবাজারে কি খালি বেগমেরা বাজার করে? তিনি বললেন, না; বাজারটির মালিক বেগম। এত দিন পর সেই বেগমের পরিচয় পেলাম 'ঢাকাইয়া আস্লি'-বইটির ভাষ্যে। ঢাকার নায়েব নাজিম নওয়াব সরফরাজ খাঁর কন্যা লাডলি 'বেগম' দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ কর্তৃক ১৭০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আজকের প্রসিদ্ধ চকবাজারের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত একটি মসজিদ ও বাজারের কর্তৃত্ব দখল করে নিয়েছিলেন। তাঁরই নামানুসারে এলাকাটার নাম 'বেগমবাজার' আর মসজিদটি 'বেগমবাজার মসজিদ'। নাম দুটি কালজয়ী হয়ে আছে 'চকবাজার' ও 'চকবাজার মসজিদ' নাম দুটির গরিব প্রতিবেশীর মতো। খাজা কিসলু সেই লাডলি বেগমদের লতা বা পাতাও হতে পারেন।
কিসলুভাইদের প্রাচীন বাড়িটির সব কিছুতেই ছিল আভিজাত্যের ছাপ। আমার মতো শিশুও চিনতে ভুল করেনি যে সে একটি বড়লোকের বাড়িতে এসেছে। কিন্তু ইঁচড়েপাকা নামে পরিচিত বালকটিও খাদ্যতালিকার কিছুই চিনতে পারেনি সেদিন_না টক, না ঝাল, না মিষ্টি। খাবারগুলির চেহারাই শুধু অচেনা ছিল না, স্বাদও ছিল অজানা_তবে ভোলার মতো না। অবিস্মরণীয় ছিল বলেই পঁয়ষট্টি বছর পরও মেজর আইটেমগুলি চিনতে পারছি 'ঢাকাইয়া আস্লি'র 'শহর ঢাকার ভোজনবিলাস' অধ্যায়টিতে সেগুলি সম্পর্কে বিখ্যাত ভোজনরসিক হাকিম হাবিবুর রহমানের বিস্তারিত বিবরণ পড়ে।
যাওয়ামাত্রই নাশতা দেওয়া হয়েছিল কুলিচা আর নানখাতাই নামের ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই বিস্কুট, যেগুলিকে হাকিম সাহেব তাঁর গ্রন্থে বলেছেন, পশ্চিম এশিয়ার মুসলমানদের সঙ্গে আসা 'তন্দুরি সওগাত'। সঙ্গে ঢাকার স্থানীয় অভিজাত হিন্দুদের উপহার নারকোলের চিঁড়া। আর শরবতস্বরূপ ছিল ফালুদা। সব কিছুরই স্বাদ ছিল ছোট্ট একটি শব্দে বলতে গেলে, তোফা। মূল ভোজনপর্বের আগে হোসেনী কালিয়া-নামী এক দফা হালকা খাবার দেওয়া হয়েছিল অ্যাপারেতিফ কিংবা ক্ষুধা উদ্রেককারী হিসেবে, যার একেলে নাম 'মাটন শাস্লিক'। সে ছিল এক বিচিত্র দৃশ্য_বাঁশের শিকে গাঁথা একবটি গোশত, তার নিচে একটি পিঁয়াজ, তার নিচে এক টুকরা আদা; পরম্পরাটা আবার আরম্ভ হয় শুরুর ওই গোশত দিয়েই। বস্তুগুলো দোপেঁয়াজার মসলা দিয়ে কড়াইতে পাকানো। সঙ্গে বাখরখানির যোগ্য কাজিন, মোগলদের আনা, 'শীরমাল'।
মূল পর্বের আয়োজন এত রকমের যে এখানে বর্ণনা বেমানান হবে। কেবল মেজর কয়েকটি ডিশের কথা বলে শেষ করব। মটরশুঁটি-মিশ্রিত পোলাও, ঢাকার বনেদি পরিবারের বিশেষ মসলা দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি কোরমার সঙ্গে বাঁধাকপির দমপোখ্ত, টক লটকনের দোলমা আর বেগুনের রায়তা। সুইট ডিশ ছিল গাজরের মোরব্বা আর মালাই কুলফি। ঢাকায় নবাগত আমার জন্য এ সবই ছিল একান্ত অভিনব এবং অবিস্মরণীয়। সে জন্যই সেবারের প্রায় মাসখানেক ঢাকাবাসকালে খাবারগুলির নাম আমি কিসলু ভাইয়াকে এতবার জিজ্ঞেস করেছিলাম যে মুখস্থই হয়ে গিয়েছিল। হাকিম হাবিবুর রহমানের গ্রন্থ পড়ে শনাক্তও করতে পেরেছিলাম সে কারণেই।
======================
আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে  আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার  গল্প- দূর গাঁয়ের গল্প  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা  পাঁচ গাড়িসহ দুই ছেলের মালপত্র বুঝে নেওয়া হলো আজ বাকিগুলো  গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে'  গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আবদুশ শাকুর


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.