স্মরণ- 'মানুষের জন্য যিনি জেগে থাকতেন' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ননেতা নুরুল ইসলাম এবং তাঁর ছেলে তমোহর ইসলাম লালমাটিয়ায় তাঁদের ফ্ল্যাটে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন। দুই বছর আগের এই দিনে। তমোহর ঘর থেকে বের হতে পারেননি, নুরুল ইসলামকে হাসপাতাল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল। সেখানে তিনি দু-একটি কথাও বলতে পেরেছিলেন। এবং তাঁর কথাবার্তা থেকে এটি স্পষ্ট ছিল, আগুনটা কোনো দুর্ঘটনা থেকে ঘটেনি। আগুন লাগানো হয়েছিল।
অর্থাৎ এই দুই গুণী মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। যাঁরা এ ঘটনার তদন্ত করেছেন, তাঁদের কয়েকজন বলেওছেন, শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে আলামত ভিন্ন হতো। আমরা যারা আগুন-বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু দুয়ে দুয়ে চার করার মতো সাধারণ জ্ঞানটা রাখি, তাদের কাছে নাশকতার বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগলে একটা জায়গা ধরে কি শুধু আগুন লাগে? বিস্ফোরণ হয় এমনি একটা জায়গা ধরে যে সিলিং ফ্যানের পাখা বেঁকে যায়, অথচ সোফার অত্যি দাহ্য ফোম অক্ষত থেকে যায়? আমার মনে আছে, তদন্তে আসা পুলিশের এক কর্তা বলেছিলেন, ঘরের ফ্রিজের কমপ্রেসর বিস্ফোরিত হয়েছিল। অথচ টিভি চ্যানেলের খবরে অক্ষত দেখানো হলো ওই কমপ্রেসরটিকে। পরে জানা গেল, তিন বছর ধরে অকেজো পড়ে ছিল ফ্রিজটি।
নুরুল ইসলাম ও তমোহর ইসলামের মৃত্যুর তদন্তে শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে এ ধরনের অনেক অসংগতি, স্ববিরোধিতা ও ঢিলেঢালা ভাব। একসময় চাঞ্চল্যকর মামলায় এই তালিকাটি স্থান পেল, কিন্তু তাতে না পুলিশ, না প্রশাসন, কারও মধ্যে কোনো চঞ্চলতা পরিলক্ষিত হলো না। আমরাই একটু যা চঞ্চল হয়েছিলাম এই আশায় যে এবার একটা রফা হবে, ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী—সবাই আশ্বাস দিয়েছেন, মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হবে। কিন্তু তাঁদের আশ্বাস যে বাস্তবায়িত হবে, তার কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এখন শুনতে পাচ্ছি, মামলাটি নিয়ে নতুন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
আমরা কি ন্যায়বিচারের স্বার্থে আবার একটা দাবি করতে পারি যে যথাযথ তদন্ত হোক; এবং তদন্তে যদি আমাদের আশঙ্কা প্রমাণিত হয়, তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক? প্রধানমন্ত্রী ও কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রীর আশ্বাস সরকারের সংশ্লিষ্ট বাহিনী-সংস্থাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেবে—এটুকু আশা একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক সমাজ তো করতেই পারে।
২.
এই দুজন গুণী মানুষকে আমরা অকালেই হারালাম। তমোহরের কথা প্রথমে বলি, ছোটবেলা থেকে তাকে দেখে এসেছি। সংগীত ভালোবাসত, জীবনকে ভালোবাসত। একটি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন মন ছিল তার। মার্জিত, শিক্ষিত, রুচিশীল। দেখা হলেই একটা শুভ্র হাসিতে মুখ ভরিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করত। গুণী ছেলে ছিল, দেশের জন্য সম্পদ ছিল। তাকে হারালাম।
নূরুল ইসলামের যে ভরাট কণ্ঠ ছিল, সংগীতের তালিম নিলে ভালো গায়ক হতে পারতেন। কিন্তু তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, তখন বাংলাদেশের কাঁধে চেপে বসেছে পাকিস্তানের প্রেত; বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সংগীত—সব রুদ্ধ। সেই রুদ্ধ সংস্কৃতি মুক্ত করার দায় আরও অসংখ্য সহযোদ্ধার সঙ্গে তিনি নিজের হাতে তুলে নিলেন। মানুষের কাছাকাছি ছিলেন সারা জীবন, বিশেষ করে মেহনতি মানুষ, শ্রমিক আর কৃষকের, যাদের নিয়তি হচ্ছে বঞ্চনা, শোষণ আর অত্যাচার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে বেরোলেন, কিন্তু চাকরি নিলেন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে। উদ্দেশ্য, তাঁদের কাতারে দাঁড়িয়ে, তাঁদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে তাঁদের জন্য সংগ্রাম করা। দীর্ঘদিন এই কাজটি করেছেন তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন দীর্ঘদিন, কর্মচারীদের অধিকার রক্ষায় আন্দোলন করেছেন, তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ আর দশজনের মতো ভালো চাকরি নিয়ে তিনি টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ির মালিক হতে পারতেন। তিনি সেদিকে না গিয়ে বেছে নিলেন সংগ্রামের জীবন। রাজনীতিকে নিজের জীবনের আদর্শের একটি ভিত্তিতে স্থাপন করলেন। অনেকের জন্য যা ঠোঁটসেবা, তাঁর নিজের জীবনে তা ছিল অবশ্যপালনীয় একটি বাস্তব কর্ম।
নুরুল ইসলাম, যাঁকে আমরা নুরুল ইসলাম ভাই বলে ডাকতাম, গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ছিলেন, ট্রেড ইউনয়ন কেন্দ্রের সভাপতি ছিলেন এবং দেশের প্রয়োজনের সময়গুলোতে সংগ্রামের সম্মুখ সারিতে ছিলেন। গত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ছিল তাঁর, এবং বিজয়ী হয়ে সংসদে বসার। তিনি রাজনীতি করেছেন খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। তাঁর জন্য অসম্ভব ভালোবাসা ছিল সেই মানুষগুলোর। তাঁর যে শত্রু থাকতে পারে, আমরা ভাবতে পারিনি। কিন্তু মৃত্যুর আগে টেলিফোনে হুমকি পেয়েছেন। এখন ভাবি, কারা সেই অন্ধকারের মানুষ, যারা তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল? কত শক্তিশালী তারা, যে এত বড় মাপের একজন জননেতার অনিষ্ট চিন্তা করতে পারে? হয়তো তাঁর মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্তে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
নুরুল ইসলাম ভাই চিরনিন্দ্রায় গেছেন, কিন্তু তাঁর রাজনীতি জেগে আছে মানুষের জন্য, যেমন তিনি জেগে থাকতেন।
==========================
রাজনৈতিক আলোচনা- 'আবার আসিব ফিরে!'  আলোচনা- 'রাজকীয় সম্মেলন'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'অসারের তর্জন-গর্জন'  আলোচনা- 'একজন নোবেল বিজয়ী, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ'  স্মৃতি ও গল্প- সেই আমি এই আমি  গল্প- 'ঘুঁটি'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি : মিয়ানমারে কি কি গণতন্ত্র আসছে?  শিল্পি- শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র  সাহিত্যালোচনা- তান তুয়ান এঙের উপন্যাস দ্য গিফট গিফট অব রেইন  খবর- বন্ধ তাবানীতে লোক নিয়োগ  ইতিহাস- আমাদের ভাববিশ্ব ও বৌদ্ধবিহার  স্মৃতি ও ইতিহাস- ঢাকায় আমার প্রথম তিন দিনের স্মৃতিরোমন্থন  আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে  আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার  গল্প- দূর গাঁয়ের গল্প  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা  পাঁচ গাড়িসহ দুই ছেলের মালপত্র বুঝে নেওয়া হলো আজ বাকিগুলো  গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে'  গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.