আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি : মিয়ানমারে কি গণতন্ত্র আসছে? by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী

সুদীর্ঘ ১৫ বছর গৃহবন্দি থাকার পর অং সান সু চি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি তাঁর স্বামী হারিয়েছেন_শেষ দেখাও করতে পারেননি। ছোট ছেলের সঙ্গেও দেখা করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর মনোবল কেউ ভাঙতে পারেনি। আজও তিনি গণতন্ত্রের মানসকন্যা। জনগণের ভোটের ও মানবাধিকারের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সামরিক সরকার তাঁকে তাঁর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে গেছে। তারা তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা আরো সুসংহত করেছে। নতুন পার্লামেন্ট গঠন করেছে।
নতুন রাজধানী গড়েছে। সংবিধানে তারা তাদের মতো করে পরিবর্তন এনেছে। সে অনুযায়ী সংসদে ২৫ শতাংশ আসন সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত! সামরিক শাসনকর্তার হাতে রয়েছে ভেটো ক্ষমতা। তিনি যেকোনো সময় সংসদীয় সরকার স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করতে পারবেন। মোদ্দাকথা সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য সব প্রচেষ্টাই নেওয়া হয়েছে।
সু চির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি যে বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করা হয়েছে, সেখানে তারা তাদের পছন্দমতো দলকে জয়যুক্ত করে এনেছে। কিন্তু এ নির্বাচন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন যে বিশ্ব নিন্দা ও ভর্ৎসনা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য সু চিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তিনি যদি জোরেশোরে আবার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে নামেন, তবে আবার তারা তাঁকে গৃহবন্দি করবে।
সু চি সব বিষয় গভীরভাবে দেখেছেন। তিনি জানেন সামরিক জান্তা সর্বক্ষমতা তাদের হাতে রেখেছে। কাজেই গতবারের মতো সরাসরি তাদের বিরোধিতা না করে এবার সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন, তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত রাখার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর লক্ষ্য হলো, একটা 'শান্তিপূর্ণ বিপ্লব', যার মাধ্যমে তিনি গণতান্ত্রিক দলগুলোকে সংঘবদ্ধ করবেন, দেশের মানুষের মন জয় করবেন, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর সৈনিক ও তরুণ-মধ্যবয়সী সামরিক কর্মকর্তাদের গণতান্ত্রিক পথের দিকে আনার জন্য অনুপ্রাণিত করবেন।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক জেনারেল অং সানের সুযোগ্য কন্যা সু চি আজ এক নতুন সংগ্রামে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আজও মিয়ানমারে অক্ষুণ্ন আছে। কিন্তু সে দেশের জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সামরিক জান্তা নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। তিনি তাদের আশার বাণী শোনাচ্ছেন, ভয়ভীতির ঊধর্ে্ব এসে তাদের মতামত দিতে আহ্বান জানাচ্ছেন। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোর দাবিদাওয়ার কথা শুনছেন, তাদের জাতীয় কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত করতে চাচ্ছেন। তিনি জানেন তাঁর জনগণ গণতন্ত্র চায়; কিন্তু চাওয়া সহজ, পাওয়া কঠিন। কাজেই তাঁকে ভেবে-চিন্তে এগোতে হবে।
সু চি জানেন, পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ সামরিক জান্তার শাসনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি। পারেনি কোনো অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে। কারণ চীন, ভারত ও আসিয়ানের অন্য সদস্য দেশগুলো মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে। জান্তার কোনো ক্ষতি হয়নি_ক্ষতি হয়েছে জনগণের। দেশে কোনো বণিক শ্রেণী বা শিল্প গড়ে ওঠেনি। অনেক প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভারের দেশে নেই বিনিয়োগকারী, নেই কল-কারখানা। অন্যদিকে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মালিক সরকার ও সামরিক জান্তা।
নিষেধাজ্ঞার ফলে অর্থনৈতিক উন্নতি হয়নি; বরং এক চরম দুরবস্থার মধ্যে বাস করেছে জনগণ। তাদের অবস্থার উন্নতি না হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কিভাবে এগোবে। পেটে ভাত না থাকলে গলার স্বর জোরালো হয় না_আর জোরালো আন্দোলন না হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
সু চি এ ব্যাপারে অবগত আছেন ও অবরোধের ব্যাপারে মত কিছুটা পরিবর্তন করেছেন। অবরোধ উঠানোর ব্যাপারে তিনি এখন অনেক নমনীয়। একই সঙ্গে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নেতাদের মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে আলোচনা শুরু করার ব্যাপারে তিনি এখন সম্মত। তবে এ ব্যাপারে ধীরে চলার পক্ষপাতী ও আলোচনা শুরু করার আগে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কিছুটা উন্নতি চান। তাই তাঁর দেশের সবার কাছে এক অনুরোধ, দেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করুন। সবাইকে নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একা তা করা সম্ভব নয়।
'শান্তিপূর্ণ বিপ্লব' সত্যিই কি মিয়ানমারে গণতন্ত্র আনবে? সামরিক সরকার কি তাদের ৫০ বছরের আধিপত্য এত সহজে ছেড়ে দেবে? ক্ষমতা ছাড়া খুব সহজ কাজ নয়। কাজেই সবার দরকার ধৈর্যের ও সংযমের। সু চি তাঁর কার্যক্রমে ও গণতন্ত্র বিকাশের উত্তরণে সামরিক সরকারকে অংশীদার করতে চান। তাঁরা কি রাজি হবেন সু চিকে ও তাঁর দলকে অংশীদার করতে। সু চি নমনীয় ভাব দেখিয়েছেন, তারাও কি নমনীয় হবে? সেটা শুধু আগামী দিনেই দেখা যাবে।
তবে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। চার্চিলের ভাষায়, সবচেয়ে নিকৃষ্ট গণতন্ত্র, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট স্বৈরশাসন থেকে ভালো। তবে গণতন্ত্র জিনিসটা বড় নাজুক। এক দেশের গণতন্ত্র অন্য দেশে চাপানো যায় না। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের গাছ সে দেশেরই আর্থ-সামাজিক ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই গজাতে হবে। আমদানি করে পণ্য কেনা যায়, প্রযুক্তি কেনা যায়; কিন্তু গণতন্ত্র কেনা যায় না। আজ পশ্চিমা দেশগুলো গণতন্ত্রের ভিত্তিতেই তাদের উন্নতি করেছে; কিন্তু এসব দেশের অভিজ্ঞতা এক নয়। তাদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। কারণ তাদের ইতিহাস, ভূগোল ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ভিন্ন। কাজেই তাদের সংবিধান ও গণতন্ত্রও ভিন্ন।
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই মিয়ানমারের গণতন্ত্রের বিকাশ চায়_চায় তাদের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি। তবে মিয়ানমারের ব্যাপারে আমাদের আরো সক্রিয় ভূমিকার প্রয়োজন আছে। আমরা নিশ্চয়ই তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না; কিন্তু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার করতে চাই। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা শিথিল হচ্ছে। খোদ ওবামা সাহেবও আলোচনা শুরু করতে চান। কারণ নিষেধাজ্ঞা ও বর্জন সামরিক সরকারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। এ-রকম অবস্থায় আমাদের আরো সক্রিয় নীতির প্রয়োজন। আমাদের মিয়ানমারের সহযোগিতা দরকার, যোগাযোগের ক্ষেত্রে ও নৌ সীমানা চিহ্নিত করতে। জ্বালানিসংকটে মিয়ানমার আমাদের বিশেষ সুবিধা দিতে পারবে। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার হলে সব সরকারের সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক থাকবে। আমাদের সব প্রতিবেশী দেশই তা করছে।
আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতে মিয়ানমারের গুরুত্ব অপরিসীম। কাজেই সুসম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই। আরো গতি আসুক আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে।
===========================
শিল্পি- শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র  সাহিত্যালোচনা- তান তুয়ান এঙের উপন্যাস দ্য গিফট গিফট অব রেইন  খবর- বন্ধ তাবানীতে লোক নিয়োগ  ইতিহাস- আমাদের ভাববিশ্ব ও বৌদ্ধবিহার  স্মৃতি ও ইতিহাস- ঢাকায় আমার প্রথম তিন দিনের স্মৃতিরোমন্থন  আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে  আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার  গল্প- দূর গাঁয়ের গল্প  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা  পাঁচ গাড়িসহ দুই ছেলের মালপত্র বুঝে নেওয়া হলো আজ বাকিগুলো  গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে'  গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.