নীতিমালা বাস্তবায়ন ও বিচারের বাধাগুলো by নাসরিন খন্দকার

আমরা মেয়ে হয়ে জন্মেছি, পুরুষের কুদৃষ্টি একপাশে সরিয়ে রেখে আমাদের পথ চলতে শিখতে হবে; আমরা মেয়ে, আমাদের শরীর চলমান যৌনবস্তু, পুরুষের লোভাতুর দৃষ্টি তো পড়বেই; আমরা মেয়ে, আমাদের দেখে রাস্তার বখাটেরা শিস দেবে, বাসের ভিড়ে পুরুষেরা গায়ে হাত দেবে, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে তাই আমাদের বাবা-মা সতর্ক-উদ্বিগ্ন; আমরা মেয়ে, আমাদের প্রাপ্তি, আমাদের অর্জন আমাদের শরীরী মূল্যায়ন মাত্র; আমরা নারী, তাই নিপীড়ন আমাদের নিয়তি।’ এভাবেই নারীর বেড়ে ওঠার প্রতিটি স্তরে নিপীড়নকে স্বাভাবিক হিসেবে উপস্থাপিত হয়। কীভাবে একে মানিয়ে নিতে হবে তা শিখিয়ে দেয় সমাজ। কিন্তু এত শিখেও শেষ রক্ষা হয় না, হতে পারে না। এর প্রমাণ পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত যৌন নিপীড়নের অজস্র ঘটনা। পরিণতিতে হত্যা-আত্মহত্যা, সাম্প্রতিক সময়ে যা বিকট আকার ধারণ করেছে। নারীর প্রতি এই দৈনন্দিন নিপীড়নের ঘটনার ওপর থেকে স্বাভাবিকীকরণের মিষ্টি প্রলেপ সরালেই ভেতরের নৃশংসতাকে দেখা যাবে। এবং বোঝা যাবে প্রতিবাদী হয়ে ওঠা ছাড়া প্রতিকার হতে পারে না।
বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই সরব। আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসে এই ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়েছে ক্ষমতাশালী ছাত্রসংগঠনের ধর্ষক গ্রুপ, বরখাস্ত হয়েছেন নিপীড়ক শিক্ষক, প্রথম দাবি উঠেছে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা ও অভিযোগ সেলের। এই নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের তাগিদও এখান থেকেই উঠে এসেছে। সম্প্রতি সব প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন প্রসঙ্গে হাইকোর্টের নির্দেশনা এই আন্দোলনের বড় অর্জন।
হাইকোর্টের রায়ে সব প্রতিষ্ঠানে এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সে অনুসারে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগের তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে নাটক ও নাট্যতত্ত্বের এক শিক্ষকের বিচার পুনঃ তদন্তের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই হাইকোর্টের দেওয়া রায় অনুসারে বিচার-প্রক্রিয়া চলার কথা থাকলেও প্রশাসন ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা অভিযুক্তকে রক্ষায় মরিয়া হয়েছে। আইনের ফাঁক গলিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনাকে পক্ষপাতদুষ্ট পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়েছে এবং অভিযুক্তদের ‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ হয়েছে। তাই হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা প্রয়োজন।
প্রথমত, হাইকোর্টের রায়ে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে এর সংজ্ঞায়ন ও অপরাধ হিসেবে এর গুরুত্ব স্পষ্ট করা হয় এবং জনসচেতনতার জন্য একে ব্যাপকভাবে প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান নির্দেশনাটি অগ্রাহ্য করে। নিপীড়ন-সহায়ক পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখার সহায়ক এই মানসিকতা। আন্দোলনের চাপে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় রায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ কিছুমাত্রায় নিলেও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তা দেখা যায়নি। আমরা তাই সব প্রতিষ্ঠানে এই নীতিমালার বাস্তবায়ন ও প্রচারের দাবি জানাচ্ছি।
দ্বিতীয়ত, হাইকোর্টের দেওয়া নীতিমালায় নিপীড়নের অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্তের জন্য অভিযোগ সেল গঠন এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এর কর্মকাণ্ড পরিচালিত হওয়ার কথা। অভিযোগ সেল যন্ত্র নয়, তাই যেসব ব্যক্তিদের নিয়ে তা গঠিত হবে, তাদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়া এবং লিঙ্গ রাজনীতি বিষয়ে তাদের সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়। এটি নিশ্চিত করতেই অভিযোগ সেলে নারী সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বলা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মঞ্চ থেকে প্রস্তাবিত নীতিমালায় অভিযোগ বিবেচনার জন্য গঠিত কমিটিতে তাই অভিযোগকারীর প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের সদস্যের অন্তর্ভুক্তির বেলায় নারী ইস্যুতে কাজের অভিজ্ঞতা আছে, এমন ব্যক্তিকে নেওয়ার প্রয়োজনও তুলে ধরা হয়। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। অভিযোগ সেলে নারীর প্রতি সংবেদনশীলতার বদলে প্রশাসনপন্থী হওয়াই প্রধান বিবেচ্য হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে সেলের মেয়াদ ও পুনর্গঠন বিষয়ে রায়ে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশ না থাকায়, পক্ষপাতদুষ্ট সেলের পরিবর্তনও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাবশালী প্রশাসন যখন পক্ষপাত করে তখন সুবিচার অসম্ভব। হাইকোর্টের রায়কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করে উল্টো অভিযোগকারীকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তার চরিত্রহনন করা হতে দেখি। অথচ হাইকোর্টের রায়ে তদন্ত চলাকালে অভিযোগকারীকে কোনোভাবেই হয়রানি না করার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া ছিল! কিন্তু এটি নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা তাই অভিযোগ সেলের কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য তদন্ত চলাকালে অভিযোগকারীর সঙ্গে তার আইনজীবীর উপস্থিতি জরুরি মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কমিটির মতো অভিযোগ সেলও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। এর কর্মপদ্ধতিও জবাবদিহির মুখে রাখা জরুরি।
তৃতীয়ত, বিচারপতি গোলাম রাব্বানী প্রদত্ত একটি রায়ে যৌন নিপীড়নের বিচারে প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াও সম্পন্ন করার নজির থাকা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাব বিচারে সমস্যা তৈরি করে। যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞা ও ধরন থেকে আমরা স্পষ্ট যে এই অপরাধের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ প্রমাণ বা সাক্ষ্য হাজির করা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কঠিন। এ কারণেই যৌন নিপীড়নের বিচারে নিপীড়িতের বয়ান ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যত আমরা নিপীড়িতকেই জেরার মুখে পড়তে দেখি। পারিপার্শ্বিক প্রমাণাদির সংজ্ঞা ও সীমানা সুনির্দিষ্ট না থাকায় এরও যথার্থ ব্যবহার হয় না। প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের বিচারের ক্ষেত্রে ঠিক কোন ধরনের অভিযোগ গ্রহণ করা হবে, তারও সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকা প্রয়োজন।
চতুর্থত, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিবিধির শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ অনুযায়ী যেকোনো অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই কমিটি যাচাইয়ের পরে তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং সেই তদন্ত কমিটি তদন্ত সাপেক্ষে বিচার-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী অভিযোগ সেল অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তা তুলে ধরবে এবং এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য হবে। উল্লেখ্য, এই অধ্যাদেশে ‘নৈতিক অসচ্চরিত্রতা, অসদাচরণ ও অদক্ষতা’—এই তিনটিই কেবল অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। এগুলোর জন্য লঘু শাস্তি হিসেবে সতর্কীকরণ ও তিরস্কার থেকে শুরু করে চাকরি থেকে বরখাস্তের মতো বিধান রয়েছে। কিন্তু তিনটি অপরাধের মাত্রা ও ধরন যেহেতু এক নয়, সেহেতু একই অপরাধে লঘু থেকে গুরু শাস্তির মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান থাকা সমস্যাজনক। এ ক্ষেত্রে ‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ হওয়ার সুযোগ অবারিত থাকে এবং সেই সুযোগ নেওয়াও হচ্ছে। যৌন নিপীড়নকে ‘অসদাচরণ’ বললে এর গুরুত্ব ও ভয়াবহতাকে খাটো করা হয়। যৌন নিপীড়ন বিশেষ ধরনের অপরাধ হওয়ায় স্বতন্ত্র অনুচ্ছেদে আলাদা করে নিপীড়নের বিভিন্ন ধরন এবং শাস্তির মাত্রা সুস্পষ্ট করে দিতে হবে, যাতে অস্পষ্টতা ও শিথিলতার সুযোগ না থাকে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় আইনে যৌন নিপীড়নকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ ধরনের বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিকারের রূপরেখা স্পষ্ট করে দিতে হবে। একে পারিবারিক সহিংসতা ও নারী নির্যাতনের বিস্তৃত ক্ষেত্রের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সুবিচার না পেলে যে কারও পক্ষে যাতে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার পথ খোলা থাকে, তারও বন্দোবস্ত করতে হবে।
যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধকে সঠিক নামে, সঠিক গুরুত্ব দিয়ে চিহ্নিত করা এবং নারীর অসম্মতি-অনিচ্ছা ও নিপীড়িত হওয়ার অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে পারা নিপীড়ন প্রতিরোধের প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে যারপরনাই ব্যর্থ। ‘ইভ টিজিং’, ‘অপারেশন রোমিও-হান্ট’ ইত্যাদি নামকরণ নিপীড়নের ভয়াবহতাকে হালকা করে একে তামাশায় পরিণত করে। নিপীড়ন আর ‘টিজিং’-এর মধ্যে হাজার মাইল ব্যবধান, তেমনি নির্যাতকদের ‘রোমিও’ বলে নির্যাতিতদের ‘জুলিয়েট’-এর ভাবমূর্তি দেওয়া এক নিষ্ঠুর রসিকতা। নিপীড়ন প্রতিরোধ করতে হলে প্রথমে এই তামাশাকরণ বন্ধ করতে হবে, সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং শক্তিশালী আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
গত ২৭ নভেম্বর ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ আয়োজিত মতবিনিময় সভায় পঠিত নিবন্ধ
নাসরিন খন্দকার: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জা.বি।
nasrin.khandoker@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.