স্মৃতি ও গল্প- সেই আমি এই আমি by আতিকুল হক চৌধুরী

ত দূর মনে করতে পারছি, ১৯৩৫ সালে বোধ হয় আমি প্রথম আমার জন্মস্থান বাটামারা গিয়েছিলাম। অস্পষ্ট ছবি। তবু মনে পড়ে, সেই শৈশবের দেখা আমার জন্মস্থান। ঘরের ফ্লোর সিমেন্টের, কিন্তু টিনের ঘর। চৌচালা। বারান্দার সামনে লাল সিমেন্ট বাঁধানো বসার জায়গা। তারপর লাল রঙের সিঁড়ি_নিচে নামার জন্য। এসব ছবি নাটকের আউট অব ফোকাসের মতো। আবার তার কিছু কিছু ফোকাস ইন।
একটা কালো রঙের কাঠের পুল। ছোট্ট খাল। বজরা নৌকা। পালকি। নানা বর্ণের কাচের জানালা দেওয়া কাছারি ঘর। অনেকগুলো খাট একসঙ্গে। তার ওপর খোলা বিছানা। বড় বড় তাকিয়া। সিংহ দরজা পার হয়ে আমার বড় মামার ঘর, যেখানে নাকি আমার জন্ম হয়েছিল। সেজ মামার ঘর। আমার সম্পর্কীয় নানু আম্মার খালাদের দোতলা টিনের ঘর। মসজিদ। পুকুর। ঘাটলা। খালের কাছে বিহারি নাপিত, মুচি ও পালকির বেয়ারাদের ঘরবাড়ি। না। চার-পাঁচ বছরের স্মৃতিতে আর কিছু মনে আসছে না। বোধ করি, ওই বছরই আমি প্রথম কলকাতা গিয়েছিলাম। বরিশাল থেকে স্টিমারে উঠেছিলাম। স্টিমার পানিতে চলাচল করা এক ধরনের যান_এটুকু বুঝেছিলাম। আমার মনে আছে, স্টিমারের ডেকে ইংরেজ এক মেম লম্বা মতো খুব সুন্দরী একটি ইংরেজ মহিলা আমাকে কোলে করে স্টিমারের রেলিংয়ের কাছে নিয়ে আমার মুখে সজোরে চুমু দিয়েছিলেন আর আমাকে একটা লম্বা সাদা লজেন্স খেতে দিয়েছিলেন। চুমুর মধ্যে ইংরেজ মহিলার মুখের যে গন্ধ পেয়েছিলাম (পরবর্তী সময়ে বুঝেছিলাম তা ছিল চুরুট আর এলকোহলের গন্ধ) আমার তা ভালো লাগেনি মোটেও। কেমন যেন একটা ভুসভুসে গন্ধ। কিন্তু তার দেওয়া সাদা লজেন্সে যে গন্ধ পেয়েছি, যে স্বাদ পেয়েছি তার তুলনা নেই। লজেন্স যে কী জিনিস তা এই প্রথম অনুভব করলাম। সেই যে এক ইংরেজ মহিলার কাছ থেকে পাওয়া আদর, চুমু, আমার জীবনে প্রথম উপহার লজেন্স_সেই থেকে আমার মধ্যে বিদেশিনি মহিলাদের প্রতি একটা আসক্তি বলব না, গভীর মমত্ববোধ থেকেই গেছে। এ কি অদ্ভুত এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক প্রক্রিয়া?' যা কিছুটা অনুভব করা যায়, কিন্তু এঙ্প্লেইন করা যায় না। স্টিমারে করে বোধ করি কলকাতা পর্যন্ত যাইনি। লাল সুড়কি রঙের লম্বা মতো একটা গাড়িতে উঠেছিলাম। ঝিনি ঝিনি শব্দ। এটা ছিল ট্রেন। ট্রেনে করে কলকাতা গিয়েছিলাম। ব্যাপারটা তখন পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে_হ্যাঁ, কলকাতাই গিয়েছিলাম। সেই লাল সুড়কি রঙের একটি ট্রেন ভোঁ ভোঁ করে ছুটে চলছে কোথায়? পার হয়ে যাচ্ছে গাছগাছালি। ঘরবাড়ি। মানুষজন। কলকাতার কথা মনে হলে অস্পষ্ট মনে পড়ে, সবুজ একটা মাঠের কোনায় আম্মা আমাকে ফিডিং কাপে করে দুধ খাওয়াচ্ছেন। সামনে একটি বিরাট সাদা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে। বড় হয়ে জেনেছিলাম, ওটাই নাকি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। আমাকে কলকাতার খিদিরপুর চিড়িয়াখানায়ও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমার স্মৃতিতে ভেসে আসছে, কাঠের সুন্দর সুন্দর ব্রিজ। নিচে ছোট ছোট আঁকাবাঁকা খাল। পাশে রেস্টুুরেন্ট। সাপের ঘরে পাশাপাশি দুটি সাপ। খাঁচায় বাঘ-ভল্লুকসহ কত জন্তু-জানোয়ার। বাচ্চারা মায়েদের কোলে বসে তাকিয়ে দেখছে, হয়তো আমারই মতো। না। এর বেশি আর কোনো ছবি মনে পড়ছে না।
আবার বোরহানউদ্দীন থানা। আমরা যাকে বরানদী বলতাম। কিছু দিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম, বরানদী থেকে আমরা অন্য কোথাও যাচ্ছি। একটি স্কুলের মাঠে আব্বার কোলে বসে ছিলাম আমি। আমার হাতে ছিল কলকাতা থেকে আনা ছোট্ট একটা ছড়ি। মাথা রুপোয় মোড়ানো। ক্যামেরা দিয়ে দূরের ছবি তোলা হচ্ছিল। জীবনে এই প্রথম ফটোসেশন দেখলাম। কালো একটা কাপড় মাথায় ঢেকে এক ফটোগ্রাফার আব্বার ফেয়ারওয়েলের ছবি তুলছিলেন। যাঁদের ছবি তুলছিলেন সেই ভোলার এসডিওসহ অফিসের অনেক কর্মচারী, পিয়ন, চাপরাশি। মাঝখানে আব্বা। কারো কারো চোখে অশ্রু দেখেছিলাম। ফেয়ারওয়েলের ফটোসেশনে যে গ্রুপ ছবি তোলা হয়, জীবনে এই প্রথম দেখলাম। বুঝলাম। তবে বোরহানউদ্দীন থেকে কোথায় যাচ্ছি, কোথায় যাব_কিছুই জানি না। বুঝি না। এইটুকু দেখলাম, একটা বড় নৌকোয় আমাদের মালপত্র সব উঠানো হলো। সিঁড়ি দিয়ে আব্বা উঠলেন। আম্মা উঠলেন। আমাকেও উঠানো হলো। ছৈ দেওয়া নৌকা ছিল। বজরা নৌকার ভেতরে আম্মার জন্য আলাদা কেবিনের মতো ছিল। আমি আম্মার সঙ্গেই ওই কেবিনে ছিলাম। নৌকার ভেতরে পিচের গন্ধ আসছিল। আমার কেমন বমি বমি লাগছিল। বেশ কয়জন মাঝি একসঙ্গে দাঁড় ফেলে নৌকা বাইছিলেন। নৌকা একসময় একটা ধানক্ষেতের পাশে এসে থামল। আমাকে নৌকার কাঠের পাটাতনের ওপর রেখে বদনা দিয়ে পানি ঢেলে গোসল করানো হয়েছিল। আম্মা আমাকে দুই হাতে ধরে বসেছিলেন। সাদা একটা গন্ধওয়ালা সাবান আমার শরীরে মাখানো হয়েছিল। একটা সাদা তোয়ালে দিয়ে আমার গা-গতরের পানি মোছানো হয়েছিল। তারপর আবার নৌকার ছৈয়ের নিচে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। কয়দিন এ নৌকায় ছিলাম মনে নেই। জানালা দিয়ে নদী দেখলাম। শেওলা ভাসতে দেখলাম। পানির ভেতর রুপালি মাছের উঁকি দেওয়া দেখলাম। সকালে সূর্য ওঠা দেখলাম। সন্ধ্যার আগে সূর্য ডোবা দেখলাম। নদীর পানি সোনালি রং ধারণ করেছিল। মনে পড়ে, জোছনা রাতে আমাকে নৌকার ছৈয়ের ওপর উঠানো হয়েছিল। কার কোলে যেন বসেছিলাম। আম্মা-আব্বা রাগারাগি করায় আমাকে নিচে নামানো হলো_অনেকটা যেন কাড়াকাড়ি করেই। আমি খুশি হচ্ছিলাম না মোটেও। নৌকার ওপর জোছনা রাতে চাঁদ দেখে দেখে নৌকার সামনে নদীতে এগিয়ে চলা আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। এমনিভাবে কত সকাল-সন্ধ্যা-রাত পার হয়ে একদিন আমাদের বজরা নৌকা একটি ঘাটে এসে থামল। আবারও নৌকা থেকে সিঁড়ি। মালপত্র নামানো। আমাকে কোলে নিয়ে একটি দোতলা পুরনো ধরনের বিল্ডিংয়ে উঠলাম আমরা। জীবনে এই প্রথম বিল্ডিং মানে দালান দেখলাম। বাঁধানো সিঁড়ি দেখলাম। দেয়াল দেখলাম। বেশ কয়েকটি কক্ষও দেখলাম। হ্যাঁ, খুব খোলামেলা একটা ছাদও ছিল। ছাদের চারপাশে রেলিং দেওয়া। কারুকাজ করা রেলিং। এক পাশে টিনের শেড দেওয়া গোসলখানা। গোসল করার জন্য লাল রঙের জলচৌকি। সিমেন্টে মোড়া। আব্বা বোরহানউদ্দীন থেকে যে জায়গায় প্রথম বদলি হয়ে এলেন, সে জায়গার নাম শুনলাম সাহেবগঞ্জ। পাশে বাকেরগঞ্জ। আমরা লোকজনের কাছে শুনতে শুরু করলাম বাখরগঞ্জ। আমরা কিন্তু থাকতাম সাহেবগঞ্জে। আস্তে আস্তে এই সাহেবগঞ্জেই আমি বড় হতে লাগলাম। বড় বড় চোখ মেলে এই জগৎ-সংসারটাকে আমার মতো করে চিনতে ও বুঝতে শুরু করলাম। এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই, সাহেবগঞ্জের সেই পুরনো জমিদারবাড়ির নিচতলায় টুপি মাথায় এক মাওলানা সাহেব রুমের মধ্যে ফ্লোরে পানি ঢেলে নিজে ওজু করে আমাকে ওজু করা শেখাচ্ছেন। প্রথম প্রথম ওজু করতে আমার বেশ মজাই লাগছিল। কারণ, গোসল করা ছাড়া এই প্রথম হাতে-পায়ে ও মুখে পানি ছিটানোর ব্যাপার। পানির সঙ্গে একটা যোগাযোগ ভালোই লাগত আমার। তোয়ালে দিয়ে আমার ওজুর পানি মোছানো হতো, তা আমার ভালো লাগত না। ভাবতাম, থাক না আরো কিছুক্ষণ পানি। লেগে থাক না পানি আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে। শৈশবে টবের মধ্যে বসে গোসল করতে দারুণ মজা লাগত আমার। কেউ টব থেকে উঠিয়ে আনতে চাইলে ভীষণ খেপে যেতাম। নিজেদের গায়ে পানি লাগাতে চায় না এমন শিশু খুব একটা বোধ করি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাই পানি বলতে পাগল থাকে। আমিও তাই ছিলাম।
এখনো খালে-বিলে, ঝিলে, পুকুরে, নদীতে, সমুদ্রে পানি দেখতে দারুণ ভালো লাগে আমার।
এ কি কোন 'অতলে জলের আহ্বান'। পানি, আগুন, মাটি, হাওয়া_এই চার চিজ দিয়েই নাকি খোদা আমাদের সৃষ্টি করেছেন। আব্বার কাছে শুনেছি, এরাই কি তাহলে আসল আপন আমাদের? মনে আছে, ফুলফুরি মাস্টার সাহেবের কাছে আমার বাল্যশিক্ষার প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল। অ আ ক খ, অ ই ঈ উ, ১ ২ ৩_এসব তাঁর কাছ থেকেই আমি প্রথম শিখেছিলাম। আমাকে এক পাঠশালায় পাঠানো হয়েছিল। উঁচু মাটির বেদি, তার ওপর টিনের চালাঘর। পেছনে মনসা দুর্গার স্থায়ী মন্দির। আরো পেছনে ছোট্ট একটা খাল। তারও পেছনে অনেক ছোট ঘর। পাঠশালার শিক্ষককে বলতাম পণ্ডিত স্যার। আমরা ছালার ছোট বিছানায় আসন করে নিচে বসতাম। হাতে ছিল খাকের কলম। এক ধরনের বাঁশ দিয়ে তৈরি। মাটির দোয়াতে কালি ছিল। লেখার কাগজ ছিল না। লিখতাম লম্বা তাল পাতায়। পাতায় লিখে তা আবার মুছতাম ছোট ছোট ন্যাকড়া দিয়ে। এ কাপড়গুলো সংগ্রহ করতাম আমাদের বাসার কাছে এক দরজির দোকান থেকে। দরজিকে বলতাম খলিফা সাহেব। এই খলিফা সাহেবের দোকানে কত দিন চাতক পাখির মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বলতাম, 'আমাকে দেন না। দেন না।' খলিফা সাহেব প্রতিদিনই বেশ কিছু পরিত্যক্ত কাপড়ের টুকরো আমার হাতের মুঠোয় গুঁজে দিতেন। আমি তাঁর হাত থেকে আমার হাফ প্যান্টের দুই পকেটে, শার্টের বুক পকেটে গুঁজে খালি পায়ে বীরের মতো হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরতাম। সেসব দিনের কথা এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়। পেছনে ফেলে এসেছি আমার বহু দিনের চেনা জীবন, তবু মনে হয় কত অচেনা যেন!
শিশুর হাত থেকে খেলনা কেড়ে নিতে চাইলে শিশু যেমন দুই হাতে তার খেলনাটিকে আঁকড়ে ধরে থাকে, আমরাও কি আমাদের শৈশবের খেলনাগুলোকে তেমনি আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই?
=========================
গল্প- 'ঘুঁটি'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি : মিয়ানমারে কি কি গণতন্ত্র আসছে?  শিল্পি- শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র  সাহিত্যালোচনা- তান তুয়ান এঙের উপন্যাস দ্য গিফট গিফট অব রেইন  খবর- বন্ধ তাবানীতে লোক নিয়োগ  ইতিহাস- আমাদের ভাববিশ্ব ও বৌদ্ধবিহার  স্মৃতি ও ইতিহাস- ঢাকায় আমার প্রথম তিন দিনের স্মৃতিরোমন্থন  আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে  আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার  গল্প- দূর গাঁয়ের গল্প  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা  পাঁচ গাড়িসহ দুই ছেলের মালপত্র বুঝে নেওয়া হলো আজ বাকিগুলো  গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে'  গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আতিকুল হক চৌধুরী


এই স্মৃতি-গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.