আলোচনা- 'রাজকীয় সম্মেলন' by মিজানুর রহমান খান

বিচার বিভাগ যতটা পৃথক হয়েছে, বিচারকদের মনমানসিকতা ততটা পৃথক হয়নি। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর এই প্রথম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ। আর সম্মেলনের রাজকীয় আয়োজনটাই বলে দেয় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে বিচারকেরাও কম যান না। সে কারণে সরকারপ্রধানই প্রধান অতিথি। অনেক বিচারকের কাছে মাসদার হোসেন মামলা একটি বিলাসিতা। ধ্যানে জ্ঞানে তাঁরা ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’। বুক ফুলিয়ে তাঁরা তা উচ্চারণে শরমিন্দা বোধ করেন না। অন্য দিকে নির্বাহী বিভাগের চরিত্রও বদলায়নি। সার্বিক বিচারে চরিত্র বদলায়নি আইন বিভাগেরও।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের টানাপোড়েনের কথা কচিৎ জানতে পারি। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধন করে জেলা জজদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হনুজ দূর অস্ত।
এই প্রথম বঙ্গভবনে জেলা জজদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ ঘটতে যাচ্ছে। সেখানে তাঁরা ‘বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম’ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করবেন। এর নেতৃত্ব দেবেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ জাহাঙ্গির হোসেন বাদল। রাষ্ট্রপতির পরিবারের সঙ্গে ঢাকার বর্তমান জেলা জজের সখ্য থাকার একটা কথা চালু রয়েছে। বঙ্গভবনে আজকের সান্ধ্য বৈঠক সেটি নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। উপরন্তু এটা হচ্ছে এমন একটি প্রেক্ষাপটে, যখন বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আইন সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে চিঠি দিয়েছে। ৭ ডিসেম্বর তাঁরা এসে বলবেন, কী নীতির ভিত্তিতে বিপুলসংখ্যক জ্যেষ্ঠ জেলা জজকে ডিঙিয়ে তাঁকে ঢাকা জেলা জজ নিয়োগ করতে হয়েছিল। আমরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কারণ, বিচার বিভাগ নামের স্তম্ভটির জবাবদিহি যে সংসদের কাছে , সেটা এ দেশে একেবারেই অনুচ্চারিত। বিচারক সমিতিও সংসদীয় কমিটির সভাপতিকে আমন্ত্রণ জানানোর দরকার মনে করেনি।
এর আগে লিখেছিলাম, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগ যেন একটি ব্যাপকভিত্তিক সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে বিচার প্রশাসনের বিষয়ে উপযুক্ত স্কিম ও কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হবে। কিন্তু আমরা এ রকম কোনো অনুশীলন দেখিনি। সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি প্রায় খামোখা দেশময় সফর করলেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি সারা দেশের বিচারকদের ঢাকায় এনে সম্মেলন করলেন। সেখানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা গরহাজির ছিলেন। সম্মেলনের যে বিবরণ শুনেছি, তা আমাদের হতাশ করেছে। এক হাজার ২০০ বিচারক কী করে বিচারাধীন ১৬ লাখ মামলা নিষ্পত্তি করবেন—এ ধরনের কোনো নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরির আলোচনা সেখানে হয়নি।
বদলি ও কর্মস্থল নির্ধারণ নিয়ে অধস্তন আদালতে তুঘলকি কাণ্ড চলছে। এসব দেখে সবচেয়ে আশাহত তরুণ বিচারকেরা। সরকার খেয়াল-খুশিমতো প্রস্তাব দিচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট কোনো সামঞ্জস্য রক্ষা ছাড়াই তাতে সাড়া দিচ্ছেন। আমরা মনে করি, বর্তমান জিএ (জেনারেল এডমিনেস্ট্রশন) কমিটি সংবিধানসম্মত নয়। এর বৈধতা যুক্তিযুক্ত কারণেই চ্যালেঞ্জযোগ্য। প্রায় তিন বছর আগে আমরা সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন রেজিস্ট্রারের আমলে বদলি-সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। কাজি হাবিবুল আউয়ালের মামলায় হাইকোর্ট প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে শুধু রেজিস্ট্রারের দায় নির্ধারণে ফুল কোর্টকে তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এবারও আমরা দেখি, সংসদীয় কমিটি রেজিস্ট্রারকেই ডাকলেন। কিন্তু আসলে কলকাঠি তো রেজিস্ট্রারের হাতে থাকে না।
আগের ঘটনায় আমাদের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক সত্তা বিস্ময়কর টালবাহানা করল। তারা সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পেল। স্পষ্টতই ওই সময়ে বদলিগুলোর তদন্ত হলে সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক স্ববিরোধিতা ও অস্বচ্ছতা উন্মোচিত হতো। ওই সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতিদার আহমেদকে বিধি লঙ্ঘন করে খুলনায় বদলি করা হয়। এর প্রতিবাদে তিনি স্বেচ্ছা অবসরে যান। ইকতিদার আহমেদ প্রতিবাদী হওয়ামাত্রই মরচেপড়া তদন্ত প্রস্তাব নাটকীয়ভাবে ফুল কোর্টে আসে। আবার ফুল কোর্ট ‘মহতী’ সিদ্ধান্ত নেন। যেহেতু তিনি অবসরে যাচ্ছেন, তাই এই তদন্ত আমরা করব না। এটা হলো সুপ্রিম কোর্টের স্ববিরোধিতার দৃষ্টান্ত। সংসদীয় কমিটির উচিত হবে, বিষয়টি আমলে নেওয়া। সাবেক রেজিস্ট্রারকে কমিটির সামনে কথা বলতে দিলে অনেক সত্য বেরিয়ে আসবে। শুধু চিঠি দিয়ে বদলির তদবির ঠেকানো যাবে না। প্রধান বিচারপতি ও জিএ কমিটি সম্ভবত তদবিরে বিরক্ত। তাঁরা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ভয় দেখিয়েছেন। কিন্তু এটা বিহিত নয়। বিহিত হলো বদলির লিখিত নীতিমালা তৈরি ও তা নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়ন করা।
এবার একটি অভ্যুত্থানের গল্পও বলি। বিচারক সমিতির সভাপতি ছিলেন ঢাকার জেলা জজ আবদুল গফুর। মহাসচিব গাজীপুরের জেলা জজ শাহজাহান সাজু। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত একটি গ্রুপ সমিতি করতলগত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা প্রধানমন্ত্রীকে ভুল পরামর্শ দিয়ে সভাপতি ও মহাসচিবকে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করাতে সক্ষম হয়। প্রধানমন্ত্রী যদিও প্রশংসনীয়ভাবে তাঁর ভুল শুধরে নেন। তাঁরাও চাকরি ফিরে পান। কিন্তু ওই গ্রুপের উদ্দেশ্য সফল হয়। তারা সামরিক স্টাইলে বিচার সমিতির গঠনতন্ত্র তছনছ করে। আবদুল গফুরকে সরিয়ে আনা হয় কৃষ্ণা দেবনাথকে (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারক)। ঢাকার জেলা জজ হয়েই তিনি মহাসচিবকে না জানিয়ে সমিতির সভা ডাকেন এবং রক্তপাতহীন অভ্যুথান ঘটান। সমিতির সভাপতির পদটি পদাধিকার বলে হলেও মহাসচিব পদটি তা নয়। অথচ মহাসচিবকে কিছু না জানিয়ে তাঁকে উৎখাত করা হয়। তিনি গোপন ব্যালটে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বিচারক সমিতিকে গণতন্ত্র অনুশীলন করতে হবে, গঠনতন্ত্র মানতে হবে। রাষ্ট্র সমিতিকে বাড়ি দিয়েছে। কিন্তু তারা কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সভা-সেমিনার আজ পর্যন্ত একটিও করেনি। নির্বাচন না করে আজ সেই অভ্যুথানে পাওয়া কমিটিই ভূতাপেক্ষ বৈধতা পাচ্ছে বলে আশংকা করছেন অনেকেই।
==============================
যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'অসারের তর্জন-গর্জন'  আলোচনা- 'একজন নোবেল বিজয়ী, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদ'  স্মৃতি ও গল্প- সেই আমি এই আমি  গল্প- 'ঘুঁটি'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি : মিয়ানমারে কি কি গণতন্ত্র আসছে?  শিল্পি- শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের সৃষ্টিসমগ্র  সাহিত্যালোচনা- তান তুয়ান এঙের উপন্যাস দ্য গিফট গিফট অব রেইন  খবর- বন্ধ তাবানীতে লোক নিয়োগ  ইতিহাস- আমাদের ভাববিশ্ব ও বৌদ্ধবিহার  স্মৃতি ও ইতিহাস- ঢাকায় আমার প্রথম তিন দিনের স্মৃতিরোমন্থন  আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে  আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার  গল্প- দূর গাঁয়ের গল্প  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা  পাঁচ গাড়িসহ দুই ছেলের মালপত্র বুঝে নেওয়া হলো আজ বাকিগুলো  গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে'  গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ মিজানুর রহমান খান


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.