স্বস্তির জয়ে সিরিজে ফেরা

নিউজিল্যান্ড বধ-কাব্যের পর এই সিরিজ অনেকটা ফুটবলে পেনাল্টি মারার মতো! বাংলাদেশ জিতলে সবাই বলবে, ‘ও, জিম্বাবুয়ে! এ আর এমন কী!’ হারলে সর্বনাশ!
শুধু নিউজিল্যান্ড-বীরত্বই বা কারণ হবে কেন! সর্বশেষ ২৫ ম্যাচের ২০টিতেই জয়, সর্বশেষ ১২ ম্যাচের ১০টিতে—জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় তো অনেক দিনই বাংলাদেশকে এমন কোনো আনন্দে ভাসানোর উপলক্ষ নয়। তার পরও কাল ৬ উইকেটের যে জয়ে বাংলাদেশ সিরিজে সমতা ফেরাল, সেটির মহিমা বলে শেষ করা যাবে না।
সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে মাঠে হেরেছিল বাংলাদেশ। সাকিবের ম্যাচ-উত্তর সংবাদ সম্মেলন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে মাঠের বাইরে হারতে বসেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটই। সাকিব যতই উল্টো দাবি করুন, ড্রেসিংরুমেও এর ঝাপটা না লেগে পারেই না। আরেকটি পরাজয় ঝোড়ো হাওয়া হয়ে এলোমেলো করে দিতে পারত সব। এই জয় তাই যত না আনন্দের, তার চেয়ে বেশি স্বস্তির। ছন্নছাড়া দলকে একতাবদ্ধ করতে জয়ের চেয়ে ধন্বন্তরি বটিকা যে আর নেই!
সাকিব আল হাসানের মূল অনুযোগটা যদি আপনার মনে থেকে থাকে, তাহলে বুঝবেন, দ্বিতীয় ম্যাচে নিজের পছন্দের একাদশ নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন অধিনায়ক। এটা এমন কিছু নয়, অধিনায়কের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সাকিব তো চাইলে ১৫ জনের বাইরের কাউকেও ডেকে বসতে পারতেন! ম্যাচের আগের দিন বোর্ড সভাপতি তো ‘নতুন ইতিহাস’ সৃষ্টি করে সেই অধিকারও দিয়ে দিয়েছেন তাঁকে!
সাকিব ১৫ জনের মধ্যেই থেকেছেন। শুধু তাঁর দৃষ্টিতে দলের সেরা দুই ফিল্ডার রকিবুল ও নাঈমকে ফিরিয়েছেন দলে। তার পরও হারলে তাঁর মুখে প্রায় সব সময় লেগে থাকা দুষ্টুমির হাসিটা উধাও-ই হয়ে যেত। কিন্তু অধিনায়ক সাকিব এমনই পয়মন্ত যে, যা ছুঁয়ে দেন, তা-ই সোনা হয়ে যায়! বাংলাদেশ তাই শুধু জিতলই না; নিউজিল্যান্ড সিরিজের চার ম্যাচে ৫১ রান ও অশেষ যন্ত্রণা উপহার দেওয়া রকিবুল হাসান পর্যন্ত মন ভরিয়ে দিলেন। গত কিছুদিন রকিবুলের ব্যাটিং যাঁরা দেখেছেন, ‘মন ভরিয়ে দেওয়া’ কত বড় প্রশংসা, সেটি তাঁদের সহজেই বুঝতে পারার কথা। শুরু থেকেই স্বচ্ছন্দ, স্পিনারদের বিপক্ষে দুর্দান্ত পায়ের কাজ—৭৮ বলে ৬৫ রকিবুলের সেরা ওয়ানডে ইনিংসগুলোর একটি। ছক্কা মেরে হাফ সেঞ্চুরিতে পৌঁছানোর মতো কাণ্ড যেটির হাইলাইটস।
ওয়ানডেতে উইকেট নেওয়ার চেয়ে রান দেওয়ায় কিপটেমির মূল্য খুব কম নয়। সে হিসেবে সাকিবের দ্বিতীয় নির্বাচন নাঈমও সফল। উইকেট পাননি, তাতে কী! ১০ ওভারে দিয়েছেন মাত্র ২৭ রান। উইকেট যে সব দুই বাঁহাতি স্পিনারের জন্যই বরাদ্দ ছিল কাল। সব বলা ঠিক হলো না, কারণ জিম্বাবুয়েকে শুরুর ধাক্কাটা দিয়েছিলেন শফিউল। সেটি তাঁর প্রথম ওভারেই। এর পর আর ৪ ওভারই বোলিং করেছেন, মাশরাফি এলোমেলো ৩ ওভার। এই ৮ ওভারেই পেস-অধ্যায়ের সমাপ্তি। বাকিটুকু স্পিন আর স্পিন। বলতে পারেন, সাকিব আল হাসান ও আবদুর রাজ্জাকের ‘টু ম্যান শো’!
যা এই ম্যাচের সীমানা ছাড়িয়েও বৃহত্তর মাত্রা পেল। কালকের ৪ উইকেট অস্ট্রেলিয়ার রায়ান হ্যারিসকে টপকে ওয়ানডেতে এ বছর সবচেয়ে বেশি উইকেটশিকারিদের তালিকার শীর্ষে তুলে নিল সাকিবকে। বছর শেষেও নামটি সেখানেই থাকছে নিশ্চিত। কারণ সাকিব যেখানে আরও ৩টি ম্যাচ পাচ্ছেন, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারও এ বছর আর ওয়ানডে খেলারই সুযোগ নেই।
তার পরও সাকিব আড়াল হয়ে গেলেন আবদুর রাজ্জাকের ছায়ায়। একজন বোলারের আজন্ম আরাধ্য স্বপ্ন হ্যাটট্রিক যে বাহুপাশে বেঁধেছে রাজ্জাককে! দুই ওভারে বিস্তৃত রাজ্জাকের হ্যাটট্রিকেই শেষ জিম্বাবুয়ের ইনিংস, মাত্র ২ রানে শেষ ৪ উইকেট হারিয়ে!
৩০৭৩ ম্যাচের ওয়ানডে ইতিহাসে মাত্র ২৭তম হ্যাটট্রিক। রাজ্জাককে নিয়ে মাত্র ২৪ জন বোলার পেয়েছেন এই ক্রিকেট অমরত্বের সার্টিফিকেট। তাঁদের মধ্যেও রাজ্জাক অনন্য। হ্যাটট্রিক-বীরদের দলে বাঁহাতি স্পিনার যে তিনি একাই।
ক্রিকেট অমরত্বই তো! নইলে জালাল-উদ-দিনের নামটা কেউ মনে রাখত নাকি! ওয়ানডেতে প্রথম হ্যাটট্রিক এই পাকিস্তানি পেসারের। খেলেছেন মাত্র ৬টি টেস্ট ও ৮টি ওয়ানডে। এ নিয়ে আক্ষেপ জাগলেই রোমন্থন করেন ওই হ্যাটট্রিকের স্মৃতি। বছর দুয়েক আগে করাচিতে এক অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার পর সাক্ষাৎকার চাওয়ামাত্রই বলেছিলেন, ‘কী, হ্যাটট্রিকের কথা শুনতে চান তো?’ কীভাবে বুঝলেন? জালাল-উদ-উদ্দিন হেসে বলেছিলেন, ‘আমার তো বলার মতো ওই একটাই জিনিস।’
রাজ্জাকের আরও কিছু আছে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সফলতম বোলার। তৃতীয়বারের মতো ৫ উইকেট পেলেন কাল। বাংলাদেশের আর কোনো বোলারের যেখানে একবারের বেশি এই কৃতিত্ব নেই।
জেমি সিডন্স সংবাদ সম্মেলনে আসেননি। এলে জানা যেত, রাজ্জাক-সাকিবের বোলিংয়ের চেয়েও রকিবুল-জুনায়েদের ব্যাটিংকে তিনি এই ম্যাচের বড় প্রাপ্তি মনে করছেন কি না! বাংলাদেশ দলের আশপাশে থাকলেই যে কেউ জেনে যাবেন, দুজনই সিডন্সের খুব পছন্দের ব্যাটসম্যান। দুজনই হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছেন। প্রথম ম্যাচের মতো কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কাও উড়ে গেছে তাঁদের ৭২ রানের জুটিতেই। সিডন্স তো খুশি হবেনই। তার চেয়েও বেশি খুশি হওয়ার কথা, বাংলাদেশের ৩ ও ৪ নম্বরের রান করা সম্ভব কি না, এই সংশয়ের অবসান হওয়ায়!
জুনায়েদের জন্য তো বড় একটা লাইফ লাইনও ৫৩ রানের এই ইনিংস। সে জন্য চিগুম্বুরার কাছে তাঁর অসীম কৃতজ্ঞতা। মিড অফে সহজ ক্যাচ ফেলে দিয়েছেন জিম্বাবুইয়ান অধিনায়ক। ১ রানে ভাগ্যের এই ছোঁয়া না পেলে জুনায়েদের তৃতীয় ম্যাচে খেলা বড় একটা সংশয়ের আবর্তেই পড়ে যেত।
গত জুলাইয়ে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর ৭ ইনিংসে সর্বোচ্চ ৩১। দলে ফিরে একটি ব্যর্থতাতেই যদি আশরাফুলকে আবার বসিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে শুধুই ব্যাটিংসর্বস্ব জুনায়েদের ক্ষেত্রে কেন অন্য বিচার—এই প্রশ্ন কিন্তু উঠেই গিয়েছিল।
দ্বিতীয় ওয়ানডে শুধু জয়ই দিল না, দিল এমন অনেক প্রশ্নের উত্তরও। শুধু যে একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না, সেটিকেও রাখতে পারেন প্রাপ্তির খাতায়। ‘আজ কি আপনার একাদশ খেলেছে’—প্রশ্নে সাকিব আল হাসান মৃদু হেসে বললেন, ‘নেক্সট কোয়েশ্চেন প্লিজ’।
অধিনায়ককে যে কখনো কখনো কূটনৈতিকও হতে হয়, সাকিব তা হলে বুঝছেন!

No comments

Powered by Blogger.