আলোচনা- একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি কি হারিয়ে যাবে by ফরহাদ মাহমুদ

'হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ' কিংবা 'হায় সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!'_এমনই সব উক্তি যে দেশটিকে নিয়ে, আকৃতিতে সেই দেশটি খুবই ছোট।

'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা' এ দেশটির অধিকাংশ মানুষই অত্যন্ত দরিদ্র। তা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের দিক থেকে দেশটি মোটেও দরিদ্র নয়। বলা যায়, পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ এবং অনেক বেশি ঈর্ষণীয়। তাই এই দেশের একজন অধিবাসী হিসেবে আমাদের গর্ব করা, অহংকার করাটা মোটেও অযৌক্তিক নয়।
আমাদের এমন সব প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা পৃথিবীর অনেক বড় বড় দেশেরই নেই। আমাদের রয়েছে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, রয়েছে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। আমাদের রয়েছে গর্ব করার মতো একটি প্রবাল দ্বীপ, যা পৃথিবীর অনেক দেশেরই নেই। নদীমাতৃক এই দেশের রয়েছে বিশাল বিশাল হাওরাঞ্চল এবং লোভনীয় জীববৈচিত্র্যের অধিকারী সুউচ্চ পর্বতমালা। প্রাচীন সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পকলা বা স্থাপত্য নিদর্শনের দিক থেকেও আমরা অত্যন্ত গর্বিত ঐতিহ্যের অধিকারী। কিন্তু সচেতনতার অভাবে এসবের অনেক কিছুই আমরা ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি। অনেক কিছুই হারাতে চলেছি। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। চকরিয়া সুন্দরবন তো হারিয়েই গেছে। তেমনি করে নতুন একটি শঙ্কা তৈরি হয়েছে আমাদের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনসকে নিয়েও।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমার সীমান্ত থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনা ছাড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকে দ্বীপটির অবস্থান। দ্বীপটির স্থানীয় নাম 'নারিকেল জিঞ্জিরা'। দ্বীপটিতে থাকা প্রচুর নারিকেল গাছের কারণেই এ ধরনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। দীর্ঘকাল ধরে প্রবাল জমতে জমতে এই দ্বীপটির সৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নদীবাহিত পলি। ফলে শত শত বছরের ব্যবধানে এর উপরিভাগ সাধারণ মৃত্তিকাভূমি বলেই মনে হয়।
প্রবাল একধরনের সামুদ্রিক প্রাণী। প্রজাতিভেদে এদের আকৃতি ভিন্ন হয় এবং এরা দলবদ্ধ জীবনযাপন করে। শরীর থেকে নিঃসৃত ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের কারণে এদের মৃতদেহগুলো সংবদ্ধ অবস্থায় স্তূপাকৃতি পেতে থাকে এবং সাগরের বুকে দীর্ঘ প্রাচীরের মতো করে তার পরিধি বাড়াতে থাকে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কোরাল রিফ বা প্রবাল প্রাচীরটি রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড উপকূলে, যার নাম গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। প্রবাল সাধারণত উষ্ণমণ্ডলীয় এবং কম গভীরতাসম্পন্ন সাগরে বসবাস করে। তবে অপেক্ষাকৃত গভীর সমুদ্রেও কিছু প্রজাতির প্রবালের দেখা পাওয়া যায়।
অনুকূল পরিবেশ পাওয়ায় আমাদের সেন্ট মার্টিনস দ্বীপটিও প্রবাল দিয়ে গড়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে পলি যুক্ত হওয়ায় দ্বীপটিতে গড়ে ওঠে উদ্ভিদবৈচিত্র্য। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে যদি প্রবাল আহরণ এবং প্রবালের উপযোগী জলীয় পরিবেশ নষ্ট হতে থাকে, তাহলে এই দ্বীপের গঠন ও বিস্তৃতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। শুধু সেন্ট মার্টিনস নয়, চট্টগ্রাম শহর কিংবা পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের শতাধিক দোকানে সেন্ট মার্টিনস থেকে সংগ্রহ করা প্রবাল বিক্রি হতে দেখা যায়। দ্বীপবাসী সেখানে ধানসহ বিভিন্ন ফসল ফলায়। এসব জমিতে নিয়মিতভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে সেগুলো ধুয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী পানিতে মিশছে। মানববর্জ্যসহ নানা রকম বর্জ্য গিয়ে পড়ছে পানিতে। পরিবেশ অধিদপ্তর সেখানে পর্যটকদের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করে দিয়েছে; কিন্তু অধিকাংশ পর্যটকই তা মানে না। তারা নানা রকম প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহার করে ফেলে দিচ্ছে সাগরের পানিতে! ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে অবিরাম তেল নির্গত হয়ে জলে মিশছে। সেন্ট মার্টিনসের তীরবর্তী বালুকাময় এলাকাগুলোয় পাঁচ ধরনের সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসত। চারটি প্রজাতি এখন আর আসে না বললেই চলে। বাকি একটি প্রজাতির আসার পরিমাণও অনেক কমে গেছে। এর বড় কারণ বালুকাভূমিগুলো তাদের নির্জনতা হারিয়েছে। রাতেও সেখানে টর্চ বা অন্যান্য বাতি জ্বালিয়ে পর্যটকেরা হইহুল্লোড় করে, গান বাজায়। তাই কচ্ছপ আসতে ভয় পায়। তার পরও যেসব কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে, তাদের ডিম চুরি হয়ে যায়। বাজারে সেসব ডিম বিক্রি হতে দেখা যায়। এ-রকম আরো অনেক উপায়ে সেন্ট মার্টিনসের পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ভারসাম্য আমরা ক্রমাগত বিনষ্ট করছি।
পরিবেশদূষণ ও অন্যান্য উৎপাতের কারণে যদি এই এলাকার প্রবালের অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়, তাহলে কী হবে? দ্বীপটিতে নতুন করে প্রবালভূমি গড়ে ওঠা ব্যাহত হবে। বড় বড় জাহাজ বা নৌযান অব্যাহতভাবে তাতে আঘাত করতে থাকলে তার ক্ষয়ও দ্রুততর হবে। তদুপরি সম্প্রতি বেশ কিছু পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, সমানে সেখানকার মাটি খুঁড়ে প্রবাল-পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। দ্বীপের তীরবর্তী পাথর সংগ্রহ করা হচ্ছে। এগুলো ভেঙে কংক্রিটের মতো বানিয়ে সিমেন্ট দিয়ে দালানকোঠা বানানো হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে নিশ্চিতভাবে দ্বীপের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হবে। সেন্ট মার্টিনসের প্রবালভূমির ওপর ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে বড় বড় ইমারত। বহুতল আবাসিক হোটেলই রয়েছে বেশ কয়েকটি। দ্বীপটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী লোকজনের সংখ্যা সম্ভবত ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া সেখানে নতুন করে লোকজনের বসতি স্থাপনের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে। অধিকাংশ জমিতেই দেখা গেছে, 'ক্রয়সূত্রে মালিক' সাইনবোর্ড। সব মিলিয়ে বলা যায়, সেন্ট মার্টিনসের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, আমরা কি আমাদের গর্বের ধন, একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি রক্ষা করব; নাকি একে অচিরেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেব? বিভিন্ন সময়ে দেশ ও বিদেশের প্রবাল বিশেষজ্ঞরা তাঁদের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা নানা রকম পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সেসব পরামর্শের প্রতি কখনোই তেমন গুরুত্বারোপ করা হয়নি। এজন্য সেখানকার অতিরিক্ত জনবসতিকে অন্যত্র সরিয়ে আনা অপরিহার্য। প্রবাল আহরণকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রবাল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে প্রতিদিন কতসংখ্যক পর্যটক সেখানে যেতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। পর্যটনের ক্ষেত্রে ইকোট্যুরিজম বা পরিবেশপ্রেমীদের ভ্রমণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে ভ্রমণের জন্য উচ্চ হারে করারোপ করা যেতে পারে এবং তা থেকে অর্জিত অর্থ দ্বীপের প্রতিবেশগত উন্নয়নে ব্যয় করা যেতে পারে। সেখানকার মাটি ও পরিবেশদূষণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে ধান ও অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ বন্ধ করে দিতে হবে এবং আগের মতো দ্বীপটিকে নারিকেল দ্বীপ হিসেবেই গড়ে তোলা যেতে পারে। দ্বীপের গঠন-কাঠামো অনুযায়ী সেখানে বহুতল ভবন তৈরি করা কোনোক্রমেই সংগত নয়। কাজেই বহুতল ভবনগুলো অপসারণ করতে হবে। দ্বীপের উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য যেন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
কথায় বলে, দাঁত থাকতে নির্বোধেরা দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। আমরা জাতিগতভাবে তেমন নির্বোধ সাজতে চাই না। সাজাটা উচিতও নয়। তাই বর্তমান সরকারের প্রতি অনুরোধ, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বিশেষ কমিটি গঠনের মাধ্যমে দ্বীপ সংরক্ষণে অবিলম্বে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হোক এবং সেই পরিকল্পনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক। যথেচ্ছাচারের মাধ্যমে আমরা আমাদের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটিকে হারিয়ে বিশ্ববাসীর ধিক্কারের পাত্র হতে চাই না।
============================
আলোচনা- বাংলাদেশের সমাজ : মধ্যবিত্ত সমাচার  গল্প- দূর গাঁয়ের গল্প  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠা  সাহিত্যালোচনা- কবিতার হয়ে ওঠাই কবির তপস্যা  পাঁচ গাড়িসহ দুই ছেলের মালপত্র বুঝে নেওয়া হলো আজ বাকিগুলো  গল্প- 'কোনো এক গাঁয়ের বিয়ে'  গল্প- মৌরস ভৌরস  শিল্পি- ড্রয়িং, স্কেচ না পূর্ণাঙ্গ চিত্রকর্ম  গল্পসল্প- নারী শিক্ষা মন্দির  স্মৃতি ও গল্প- ছিন্নস্মৃতি  স্মৃতি ও গল্প- স্কুল জীবনে বাঁকুড়া, জলপাইগুড়ি ও যশোর  ফিচার- তাঁহাদের দান  ফিচার- ডায়ানার আংটি  গল্প- 'অভিমান'  গল্প- 'মাটির ব্যাংক'  গল্পসল্প- 'সাগরকে যাঁরা পোষ মানালেন'  স্মরণ- 'আমাদের সেলিনা আপা'  আলোচনা- 'বেতন-ভাতা না নেওয়ার ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নয় কেন?  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পরীক্ষা করছে নরওয়ে  খালেদার মালপত্র আজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে  আলোচনা- 'পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও অশান্তির মনস্তত্ত্ব'  সাক্ষাৎকার- পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে  আলোচনা- 'শান্তিচুক্তির ১৩ বছর'  রাজনৈতিক আলোচনা- 'উন্মত্ত নৈরাজ্যের শক্তি বনাম সোনালি সম্ভাবনা'  আলোচনা- ''ট্রানজিট' না 'করিডোর' না 'কানেকটিভিটি'  আলোচনা- 'ওরাও মানুষ আছে ওদের অধিকার'  আন্তর্জাতিক- অং সান সু চির মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ  শিল্প-অর্থনীতি 'আঞ্চলিক রফতানি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থকে মনে পড়ে' by খুশবন্ত সিং


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ফরহাদ মাহমুদ
সাংবাদিক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.