ইতিহাস- 'টিকে থাকুক ‘টেগর লজ’' by আশীষ-উর-রহমান

পাঁচ লাখ টাকায় এক অমূল্য স্থাবর সম্পদ কিনেছে কুষ্টিয়া পৌরসভা। বাড়িটি শহরের মিলপাড়ায়। জায়গা খুব বেশি নয়, সাকল্যে নয় কাঠা। তার ওপরে ছোট্ট দোতলা বাড়ি। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। উত্তর-দক্ষিণ দুই পাশেই বারান্দা। পশ্চিম পাশের কুঠুরির কোণে দোতলায় ওঠার প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি। বাড়িতে প্রবেশের পথ অবশ্য উত্তর দিকে। একেবারে মিলপাড়ার সড়কের সঙ্গে লাগোয়া। বাড়িটির নাম ‘টেগর লজ’। ছোট্ট বাড়িটি মাপের চেয়ে মর্যাদায়, গৌরবে যে বড় হয়ে উঠেছে তা ওই ঠাকুরের স্মৃতিধন্য হওয়ার কারণেই। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ির যেমন বিপুল খ্যাতি ও পরিচিতি, সে তুলনায় শহরের ভেতরের এই বাড়ি প্রায় অপরিচিতই বলা যায়। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরেরা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কুষ্টিয়া রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন ১৮৯০ সালের শেষ ভাগে।
জায়গার পরিমাণ তখন আরও বেশি ছিল। ভুসিমাল ও পাটের কারবারের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘টেগর অ্যান্ড কোম্পানি’। এর একাংশে ক্ষণকাল থাকার প্রয়োজনে তৈরি করেছিলেন টেগর লজ নামের দোতলা বাড়িটি। ভুসিমালের কারবারের সঙ্গে এখানে কবি আখ মাড়াইকল ও পাটের গাঁট তৈরির কলও স্থাপন করেছিলেন। পরে স্বদেশি আন্দোলনের চেতনায় টেগর লজকে কেন্দ্র করে একটি বড় তাঁতশালাও গড়ে তোলেন। কবিকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করতেন তাঁর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথমটায় ব্যবসা ভালো চললেও পরে টেগর অ্যান্ড কোম্পানি ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকে। পাটের কারবার করতে এসে কবি লাখ টাকার ওপরে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। উপায়ান্তর না দেখে তিনি শ্বশুরবাড়ি খুলনার দক্ষিণডিহির উদ্যমী যুবক যজ্ঞেশ্বরকে ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব দেন। যজ্ঞেশ্বর বহু খেটেখুটে ডুবতে বসা টেগর অ্যান্ড কোম্পানিকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতে থাকেন। একপর্যায়ে কবি তিন হাজার টাকায় যজ্ঞেশ্বরকে কোম্পানির সমুদয় যন্ত্রপাতি ও মালামাল দান করে দেন এবং টেগর লজসহ এখানকার দুই বিঘা জমি বছরে ৫০ টাকা খাজনার বিনিময়ে বন্দোবস্ত করে দেন। পরে যজ্ঞেশ্বর এখানে ‘যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন (কারখানা ভবনটি এখনো আছে)। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ বইয়ে।
তারপর তো কেটে গেছে বহু দিন। একপর্যায়ে টেগর লজ বেদখল হয়ে যায়। বহু হাত বদল হয়ে অবশেষে এর মালিকানা এসে পৌঁছায় স্থানীয় আবদুল গফুরের স্ত্রী ছালিমা খাতুনের নামে। ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। আশপাশের জমি চলে গেছে বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে। তাঁরা নিজেদের নামে কাগজপত্র করে নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর কবির স্মৃতিধন্য বাড়িটিকে রক্ষার উদ্যোগ নেন কুষ্টিয়া পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়াম্যান মো. আবদুর রহিম। বাড়িটি পৌরসভার নামে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য তিনি উচ্চমহলে দেন-দরবার করতে থাকেন। এরই একপর্যায়ে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুষ্টিয়া সফরে এলে তিনি টেগর লজ পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করার আবেদন জানান। বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর স্মৃতিধন্য বাড়িটির মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। কিন্তু বাড়ির মালিকানা যেহেতু ব্যক্তিপর্যায়ে, তাই পৌরসভাকে হস্তান্তর করা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর টেগর লজ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
এর মধ্যে বাড়িটি আরও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পৌরসভার বর্তমান মেয়র আনোয়ার আলী ১৯৮০ সালে আবার বাড়িটি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেন। কিন্তু আবার সেই জটিলতা। অগত্যা মালিক পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ২০০৪ সালে পৌরসভার পক্ষে পাঁচ লাখ টাকায় বাড়িটি কিনে নেন মেয়র। এরপর শুরু হয় সংস্কার কাজ। মূল নকশা অনুসারে বাড়িটি মেরামত করা হয়েছে (শিলাইদহের কুঠিবাড়ির মতো এ বাড়িতে চুনকাম করা হয়নি। বরং আদিরূপেই লাল রং করা হয়েছে)। প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে চারপাশে। নিচের তলায় একটি বড় হলঘর ও একটি ছোট ঘর। ওপরে ঘর তিনটি। ওপরের তলায় মাঝের ঘরটি বড়। এখানে একটি আলমারিতে রাখা কবির রচিত গ্রন্থমালা। দেয়ালে ঝোলানো কবির আঁকা ১২টি ছবির অনুকৃতি। দক্ষিণে সবুজ ঘাসে ঢাকা একচিলতে আঙিনা। সেখানে ছোট্ট একটি মঞ্চও আছে। উত্তরের প্রবেশপথের সামনেই কবির আবক্ষ মূর্তি। এই মূর্তি ও ছবির অনুকৃতিগুলো ভারতীয় দূতাবাস দান করেছে বলে জানালেন টেগর লজের তত্ত্বাবধায়ক এস এম নূরুদ্দিন। ওপরতলায় আসবাবের মধ্যে আছে কয়েকটি চেয়ার ও হেলান দিয়ে বসার একটি লম্বা বেঞ্চ। এগুলো শিলাইদহের আসবাবের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে। জরাজীর্ণ দেয়াল ছাড়া আর কিছুই ছিল না বাড়িটিতে। প্রথমে ভবনটি সংস্কার করা হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে আগের দিনের আসবাবের নকশার সঙ্গে মিলিয়ে নতুন করে আসবাব তৈরি করা হচ্ছে বলে জানালেন তিনি। সরকারি ছুটি ছাড়া প্রতিদিনই বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত টেগর লজ খোলা থাকে। স্থানীয় লোকজন এসে পত্রপত্রিকা পড়েন। দর্শনার্থীরাও আসেন। কবির জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানও হয়। সংস্কারের পর পৌরসভা টেগর লজের একটি পরিচিতি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছে।
মেয়র আনোয়ার আলী বললেন, ‘টেগর লজটি উদ্ধার ও সংস্কার করতে পেরে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সুপরিচিত হলেও টেগর লজকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের সঙ্গে কবির যে সম্পর্ক, তা অনেকেরই অজানা। টেগর লজ উপেক্ষিত ছিল। আমরা কবির স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। আগামী দিনে টেগর লজকে রবীন্দ্র জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ভবনটিকে কুষ্টিয়ার সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’
কবি যখন ট্রেনে চেপে কলকাতা থেকে আসতেন বা কলকাতা যেতেন, তখন শিলাইদহ যাতায়াতের সময় টেগর লজে বিশ্রাম নিতেন। অনেক সময় রাতযাপনও করেছেন। ব্যবসায়িক কাজের তদারক করেছেন এখানে থেকে। অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী টেগর লজের পরিচিতি পুস্তিকায় লিখেছেন, ‘টেগর লজে বসে তিনি কোনো সাহিত্য রচনা করেছেন কি না, তার হদিস মেলে না। তবে এই কুষ্টিয়া কুঠিবাড়ি থেকে তিনি বেশ কিছু চিঠিপত্র লিখেছেন, তা বেশ জানা যায়। তবে তিনি কুষ্টিয়া রেলস্টেশন-সংলগ্ন বসন্তের ফুলে ভরা একটি কুরচি গাছ নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। ১০ বৈশাখ ১৩৩৪-এ লিখিত ‘কুরচি’ নামে এই কবিতা পরে বনবাণী বইয়ে গ্রথিত হয়।’
বাঙালি চিরকাল যাদের নিয়ে গর্ব করবে, তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। কুষ্টিয়া পৌরসভা তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি রক্ষা করার যে কাজটি করেছে, তা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
======================
আলোচনা- 'কর্মশক্তি ও টাকার অপচয়!' by রোজিনা ইসলাম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আশির দশকে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন' by আবুল কাসেম ফজলুল হক  আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব আকাশচুম্বী' by ড. নিয়াজ আহম্মেদ  ইতিহাস- 'প্রত্যন্ত জনপদে ইতিহাস-সঙ্গী হয়ে' by সাযযাদ কাদির  আন্তর্জাতিক- 'জাতিসংঘ বনাম যুক্তরাষ্ট্র' by শহিদুল শহিদুল ইসলাম  গল্পালোচনা- 'দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ?' by মহসীন মহসীন হাবিব  স্বাস্থ্য আলোচনা- 'প্রসূতিসেবায় পিছিয়ে দেশ' by শেখ সাবিহা আলম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বন্দিত কান্না, নিন্দিত হরতাল আর রাজকীয় অশ্রুপাতের গল্প' by ফারুক ওয়াসিফ  খবর- উত্তর কোরিয়ার নতুন পরমাণু প্ল্যান্ট দেখে 'তাজ্জব' মার্কিন বিজ্ঞানীরা  গল্পসল্প- 'মুজিব একবার আসিয়া সোনার বাংলা যাওরে দেখিয়ারে' by মোস্তফা হোসেইন  আন্তর্জাতিক- 'ওবামা কি ক্লিনটনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন?' by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী  কৃষি আলোচনা- 'পোষের শেষ মাঘের বারো' by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস  মণিপুরি মহা রাসলীলা উৎসবের ইতিকথা by মুজিবুর রহমান  প্রকৃতি- সমুদ্রে উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রবাল মড়ক  মণিপুরি রাসমেলা উৎসব by আকমল হোসেন নিপু  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'মডার্ন হাম্মুরাবি এবং কাঠের ঘোড়া' by আলমগীর সাত্তার  আলোচনা- 'কারাগার থেকে সংশোধনাগার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ' by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু  শিল্প-অর্থনীতি 'ক্ষুদ্রঋণের বিড়ম্বনা' by আহমদ রফিক


কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আশীষ-উর-রহমান


ইতিহাস আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.