শিল্প-অর্থনীতি 'চামড়াশিল্প শিগগিরই সরছে না' by আলী আসিফ

হাজারীবাগের ট্যানারি (চামড়া প্রক্রিয়াকরণ কারখানা) মোড়ে পা রাখতেই বোটকা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। ওই কারখানার সঙ্গে সংযুক্ত বর্জ্য নিষ্কাশন নালার দিকে তাকালেও পেট গুলিয়ে উঠতে পারে। অপরিশোধিত এই রাসায়নিক বর্জ্য মিশছে বুড়িগঙ্গায়। অথচ সাত বছর আগে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করে এখনো তা শেষ করতে পারছে না সরকার। ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় (একনেকে) ‘চামড়া শিল্পনগরী (বিসিক) সাভার’ নামে একটি প্রকল্পের অনুমোদন নেওয়া হয়।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাজারীবাগের সব ট্যানারি স্থানান্তর করে সাভারে নেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। কিন্তু সেখানে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বা সিইটিপি) স্থাপনের কাজ শেষ হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকায় নষ্ট হচ্ছে শিল্পনগরের বিভিন্ন অবকাঠামো। ট্যানারির মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে, আর সাভারের চামড়া শিল্পনগরের সিইটিপি স্থাপন নিয়ে গড়িমসি দেখে ধারণা করা যাচ্ছে, তিন বছরের আগে ট্যানারিগুলো হাজারীবাগ থেকে সরছে না।
ট্যানারি স্থানান্তরে বাধা
‘চামড়া শিল্পনগরী সাভার’ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প এলাকার প্রায় সব কাজ শেষ। বাকি আছে কেবল সিইটিপি বসানোর কাজ। বিসিকের কর্তাদের ভাষ্যমতে, সিইটিপি বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। সিইটিপি স্থাপিত হলেই ট্যানারি মালিকদের সাভার না আসার কোনো কারণ তাঁরা দেখছেন না। তবে বিসিকের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকেরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমদ জানান, ট্যানারি মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ এবং ব্যাংক লোনের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলে তাঁদের সাভারে যেতে আপত্তি আছে। হাজারীবাগে প্লট বা কারখানা ভবন বন্ধক রেখে যে ব্যাংক লোন নেওয়া আছে, এখন ব্যাংক লোনটাই সাভারে প্রাপ্ত প্লটের নামে হস্তান্তর করে দিলে ট্যানারি মালিকদের কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে আসবে বলেও তিনি জানান।
হাজারীবাগের তাজ ট্যানারি লিমিটেডের সুপারভাইজার আনোয়ার হোসেন জানান, ট্যানারি স্থানান্তরের সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থের দোকান, শ্রমিকদের বাসস্থান, চামড়াপ্রাপ্তির নিশ্চয়তাসহ আনুষঙ্গিক বিষয় জড়িত। এ বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ট্যানারি মালিকেরা সহজে সাভারে যেতে চাইবেন না।
একই প্রসঙ্গে হাজারীবাগ কেমিক্যাল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ বলেন, ‘কাঁচা চামড়া পাকা করার জন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যালের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে হাজারীবাগে রয়েছেন। এখন ট্যানারিগুলো যদি হাজারীবাগ থেকে সাভারে নেওয়া হয়, তাহলে আমাদেরও ব্যবসা গুটিয়ে সাভার এলাকায় চলে যেতে হবে। কিন্তু সাভারের চামড়াশিল্পনগরে আমাদের জন্য কোনো প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিল বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের কাছে এক লাখ ৬০ হাজার বর্গফুট জায়গার জন্য আবেদন করেছিলাম। পরবর্তী সময় আবারও এ বছরের ২৪ মার্চ শিল্পমন্ত্রী বরাবর স্থান চেয়ে আবেদন করেছি।’
মালিকপক্ষের পাশাপাশি শ্রমিকপক্ষের দাবিদাওয়ার ঝুলিটাও কম নয়। হাজারীবাগ এলাকায় ট্যানারি-শিল্পে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন বলে জানালেন ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক মো. আক্তার হোসেন। হাজারীবাগ ট্যানারি কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের যাবতীয় দেনা-পাওনা মিটিয়েই তবে এখান থেকে ট্যানারি সরাতে হবে বলে তিনি দাবি করেন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে হাজারীবাগ এলাকায় কর্মরত যেসব শ্রমিক ট্যানারি এলাকার পার্শ্ববর্তী বস্তি কিংবা ছোট মেসে বাস করছেন, তাঁদের বাসস্থানের ব্যবস্থার দাবিও জানিয়েছে শ্রমিকদের এই সংগঠন। শ্রমিকদের কলোনির পাশাপাশি তাঁদের জন্য একটি হাসপাতালের কথাও বললেন তাঁরা। তাঁদের যুক্তি হলো, হাজারীবাগ থেকে খুব সহজেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাওয়া যায়। কিন্তু সাভারে একজন শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হলে তখন তাঁর কী হবে?
হাজারীবাগে যেসব প্রতিষ্ঠানের বড় কারখানা আছে, তাঁরাই সাভারের চামড়াশিল্পনগরে ১৯৫টি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। কিন্তু হাজারীবাগে ২০০ থেকে ২৫০টি ছোট চামড়া ব্যবসার প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের নিজেদের কোনো ট্যানারি নেই, কিন্তু ট্যানারিগুলোর সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কাজ করে। ক্ষুদ্র এই ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস অ্যাসোসিয়েশন কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ লেদার অ্যান্ড লেদার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের ভাষ্যমতে, সাভারে চামড়াশিল্প যদি স্থানান্তর করা হয়, তাহলে অবশ্যই তাঁদের জন্যও সেখানে জায়গা দিতে হবে। তা না হলে তাঁরা কঠোর আন্দোলনে নামবেন।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমদ জানান, সরকার চামড়াশিল্পকে যদি বাঁচাতে চায়, তাহলে অবশ্যই ট্যানারির মালিক, শ্রমিক, ট্যানারির কাঁচা চামড়া সরবরাহকারী—সবার কথাই ভাবা উচিত। তা না হলে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরালেও তেমন একটা সফলতা আসবে না।
উচ্চ আদালতের আদেশ পালনে গড়িমসি
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য উচ্চ আদালতে তারা একটি রিট আবেদন করে। রিট অনুযায়ী উচ্চ আদালত এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সাভার চামড়াশিল্পনগরে সব ট্যানারি স্থানান্তরের সময়সীমা বেঁধে দেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পর ট্যানারি কর্তৃপক্ষ আদালতে সময় চেয়ে আবেদন জানালে উচ্চ আদালত তাদের ছয় মাস সময়সীমা বেঁধে দেন। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট সময়ের পরও চামড়াশিল্প সাভারের চামড়াশিল্পনগরে যায়নি। বেলার পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, উচ্চ আদালতের কাছে তাঁরা (অভিযুক্ত ব্যক্তিরা) পুনরায় আবেদন করলে তাঁদের আবারও ছয় মাসের সময় দেওয়া হয়।
সিইটিপির মাধ্যমে চামড়াশিল্পের বর্জ্য পরিশোধন করে পরিবেশবান্ধব চামড়াশিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যেই সাভারে স্থানান্তর করা হচ্ছে চামড়াশিল্প। সাভারে সিইটিপি বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে ‘চামড়া শিল্পনগরী সাভার’-এর প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দুই ধাপে সিইটিপি যাচাইয়ের কাজ করা হবে। প্রথমত, যান্ত্রিক দরপত্র যাচাই এবং পরবর্তী সময় আর্থিক দরপত্র যাচাই করা হবে। এখন চলছে যান্ত্রিক দরপত্র যাচাইয়ের কাজ। এ কাজটি শেষ হলে আমরা সিইটিপির আর্থিক দরপত্র যাচাইয়ের কাজ শুরু করব।’ আর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বসাতেও প্রায় দেড় বছর সময় লাগবে। তাই সবকিছু নিয়মমতো চললে আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প এলাকাটি চামড়াশিল্প বসানোর উপযোগী হবে বলে জানান তিনি।
চামড়াশিল্পনগরের হাল
সাভারের হেমায়েতপুর উপজেলায় এই হরিণধারা গ্রামের ২০০ একর জমিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে চামড়াশিল্পনগর করার জন্য। নিচু জমিতে বালু ভরাট করে ট্যানারি মালিকদের স্থান বরাদ্দ-প্রক্রিয়াও শেষ হয়েছে বহু আগে। কিন্তু সিইটিপি এখনো বসানো হয়নি প্রকল্প এলাকায়, তবে কারখানাগুলোয় চামড়া ধোয়া এবং খাবার পানির সংস্থানের লক্ষ্যে ওয়াটার ফিল্টারিং প্লান্টটি বসানোর কাজ শুরু হয়েছে গত ১০ মে। প্রকল্প এলাকার চারপাশে আরও ১০টি গভীর নলকূপ বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি, আর শুষ্ক মৌসুমে গভীর নলকূপের পানি ব্যবহার করা হবে বলে জানালেন ওয়াটার ফিল্টার প্লান্ট নির্মাণের দায়িত্বে থাকা পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম।
প্রকল্প এলাকায় বিস্তৃত এলাকাজুড়ে পিচঢালা পথ আর পথের দুই ধারে চামড়া পাকা করার প্লটগুলো পড়ে আছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একজন জানালেন, পয়োনিষ্কাশন নালাগুলোয় শ্যাওলা আর কাদামাটি জমে এমন দশা হয়েছে যে সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য আবারও দরপত্র আহ্বান করতে হবে। এলাকার পুলিশ ফাঁড়ি ও ফায়ার ব্রিগেড কার্যালয়টি এখনো ফাঁকা। প্রকল্প এলাকায় প্রায় সময়ই সন্ধ্যার পর জমে ওঠে জুয়া আর মদের আসর। আর দিনদুপুরে মোটরগাড়ি চালাতে শেখানো গাড়িগুলোর সরব উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। পুরো প্রকল্প এলাকায় কোনো ধরনের ফটকের বালাই না থাকায় এমনটি হচ্ছে বলে স্বীকার করলেন প্রকল্প এলাকার দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী শাহীনুর ইসলাম। আর দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকায় পিচের রাস্তায় স্থানে স্থানে ভাঙন ধরেছে।
===============================
ফিচার- ‘র‌্যাগিং : পৌষ মাস না সর্বনাশ?' by সমুদ্র সৈকত  ভর্তি এবার লটারিতে! by হাবিবুর রহমান তারেক ও তমাল আবদুল কাইয়ুম  আলোচনা- 'পেট্রোবাংলার ভূমিকা এবং কিছু প্রশ্ন' by ড. এম শামসুল আলম  আন্তর্জাতিক- 'যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকনীতি ইরানকে বিজয়ী করছে' by ফয়সাল আমিন ইস্ত্রাবাদি  আলোচনা- 'ইভ টিজিং : দায়ী কে?' by ফখরে আলম  কল্প গল্প- '...আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে!' by আলী আলী হাবিব  রাজনৈতিক আলোচনা- ''উচিত কথায় ননদ বেজার, গরম ভাতে ভাতে বিলাই (বিড়াল)' by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী  প্রকৃতি- 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষশত্রু' by মেহেদী উল্লাহ  ইতিহাস- 'ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর আসন' by সৈয়দ আবুল মকসুদ  ইতিহাস- 'টিকে থাকুক ‘টেগর লজ’' by আশীষ-উর-রহমান  আলোচনা- 'কর্মশক্তি ও টাকার অপচয়!' by রোজিনা ইসলাম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আশির দশকে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন' by আবুল কাসেম ফজলুল হক  আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব আকাশচুম্বী' by ড. নিয়াজ আহম্মেদ  ইতিহাস- 'প্রত্যন্ত জনপদে ইতিহাস-সঙ্গী হয়ে' by সাযযাদ কাদির  আন্তর্জাতিক- 'জাতিসংঘ বনাম যুক্তরাষ্ট্র' by শহিদুল শহিদুল ইসলাম  গল্পালোচনা- 'দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ?' by মহসীন মহসীন হাবিব  স্বাস্থ্য আলোচনা- 'প্রসূতিসেবায় পিছিয়ে দেশ' by শেখ সাবিহা আলম


প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ আলী আসিফ


এই ফিচার'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.