কল্প গল্প- '...আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে!' by আলী হাবিব

অনেক দিন আগে বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি ছাড়া আর কোনো টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। বিটিভির সেই একচ্ছত্র আধিপত্যের সময় হুমায়ূন আহমেদের কোনো একটি ধারাবাহিক নাটকে একটি খাদক চরিত্র ছিল। সেই খাদক খেতে পারত। একবারে একটি গরু খেয়ে ফেলতে পারত। নাটকের একটি দৃশ্য ছিল এ রকম_খাদককে খাওয়ানো হবে। ভোজের আগে গরুটি নিয়ে সে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াচ্ছে। পেছনে একদল শিশু-কিশোর। খাদক ঘুরে ঘুরে গ্রামের লোককে গরুটি দেখাচ্ছে।
এই গরুটিই পরদিন জবাই করা হবে। পরদিন খেতে বসে খাদকের কী অবস্থা হয়েছিল, সেটাও দেখানো হয়েছিল নাটকে। হুমায়ূন আহমেদের নাটকের সেই খাদকের কথাই নতুন করে মনে করিয়ে দিল পাবনার পেটুকদের প্রতিযোগিতা। গত শনিবার পাবনার আটোয়ায় অনুষ্ঠিত হয় এই 'সেরা পেটুক' প্রতিযোগিতা। শারীরিকভাবে সুস্থ কি না তা পরীক্ষার পরই ২১ প্রতিযোগীর মধ্য থেকে ১৬ জনকে সেরা পেটুক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। প্রতিযোগিতায় তিন কেজি ভাত আর তিন কেজি গরুর মাংস খেয়ে সেরা পেটুক নির্বাচিত হয়েছেন ভাড়ারার আবদুল মজিদ। প্রথম পুরস্কার হিসেবে তাঁকে দেওয়া হয় ২০ হাজার ৫০০ টাকা দামের একটি বকনা গরু। দুই কেজি ৮৫০ গ্রাম ভাত আর আড়াই কেজি মাংস খেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী ভাড়ারার আবদুল করিম পুরস্কার পান বাচ্চাসহ একটি ছাগল এবং প্রায় সমপরিমাণ খেয়ে তৃতীয় স্থান অধিকারী শ্রীপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম পান একটি সেলাই মেশিন। বাই দ্য বাই ক্লাবের উদ্যোগে এ প্রতিযোগিতায় পাবনার বিভিন্ন এলাকার মোট ২১ জন পেটুক নাম তালিকাভুক্ত করান। শারীরিক পরীক্ষার পর তাঁদের মধ্য থেকে ১৬ জনকে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার উপযোগী ঘোষণা করা হয়। এই ১৬ জনের প্রত্যেককে এন্ট্রি ফি দিতে হয় ৩০০ টাকা করে। প্রত্যেক প্রতিযোগীর জন্য সর্বনিম্ন এক কেজি ভাত আর এক কেজি গরুর মাংস খাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক।
উপকথা-রূপকথায় অনেক খাদক চরিত্র পাওয়া যায়। বিশেষ করে রাক্ষস-খোক্কসদের অনেক গল্প রূপকথায় আছে। একসময় গ্রামাঞ্চলে নাকি অনেক খাদক পাওয়া যেত। বিয়েবাড়িতে এসব খাদকের বিশেষ কদর ছিল বলে শোনা যায়। বরযাত্রী হিসেবে খাদকদের নাকি ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হতো। খাদকদের কাজ ছিল খাওয়া। কনে পক্ষের বাড়িতে গিয়ে খেয়ে সব সাবাড় করে দেওয়াটাই ছিল তাদের কাজ। কনে পক্ষের খাবার যাতে কম পড়ে, সে ব্যবস্থা করতেই বর পক্ষ খাদকদের ভাড়া করে নিয়ে যেত। আবার বউভাতের সময়ও এভাবে খাদক ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া হতো। এটা অনেকটাই ছিল নিছক এক ধরনের খেলা। নির্মল আনন্দের ব্যাপার। কোন এলাকায় কয়জন খাদক আছে। সেই খাদকদের খাদ্য গ্রহণের ক্ষমতা সম্পর্কে এলাকার সবারই জানাশোনা ছিল। সে আমলে এলাকার খাদকদের সঙ্গে অন্য এলাকার মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য স্পেশাল 'জেয়াফত' হতো। আজকাল যেমন 'মেজবান' হচ্ছে, অনেকটা সে রকম। এখন আমরা যতই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, 'সে-দিন হয়েছে বাসি।' কিন্তু তার পরও হাসিমুখে ভোজন করা লোকের যে অভাব নেই বা সত্যিকারের ভোজন-রসিক যে এখনো কোথাও কোথাও পাওয়া যায়, সেটা প্রমাণ করতে পাবনার এই 'সেরা পেটুক প্রতিযোগিতা' শিরোনামের খবরটিই যথেষ্ট।
পুরাণেও আমরা অনেক খাদকের সন্ধান পাই। ভীমের কথাই ধরা যাক। দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম ছিলেন মহাবীর। শক্তিতে তাঁর সঙ্গে পেরে ওঠার মতো কাউকে পাওয়া যেত না। অযুত হস্তীর সমান শক্তিশালী ছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে ছিলেন ভোজনপটু। খেতে পারতেন। ভোজনপটুতার কারণে তাঁর আরেক নাম বৃকোদর। অর্থাৎ তাঁর উদরে বৃক নামের অগি্ন ছিল, যা খেতেন হজম করে ফেলতেন। এ রকমই আরেক চরিত্র কুম্ভকর্ণ। ঘুমকাতুরে যারা, তাদের আমরা কুম্ভকর্ণ বলে থাকি। কুম্ভকর্ণ ঘুমোতেন একটানা ছয় মাস। ঘুম থেকে জেগে প্রচুর পান ও ভোজন করতেন। জন্মগ্রহণের অব্যবহিত পরই কুম্ভকর্ণ ক্ষুধার্ত হয়ে ক্ষুণি্নবৃত্তির জন্য সহস্র প্রজা ভক্ষণ করে ফেলেছিলেন।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভোজন সংস্কৃতি সেই পৌরাণিক-কাল থেকেই চলে আসছে। ভোজনের সঙ্গে রসের একটা যোগ আছে। সেই যোগটি আছে বলেই ভোজনরসিক আছে, ভোজনরসিকদের গল্প আছে। এসব ভোজনরসিকের কথা উঠে এসেছে আমাদের সাহিত্যেও। সুকুমার রায় তাঁর খাই খাই ছড়ায় লিখেছেন, 'খাই খাই করো কেন/ এসো বসো আহারে/ খাওয়াবো আজব খাওয়া/ ভোজ কয় যাহারে।' কী কী খাওয়া যেতে পারে? ছড়াসম্রাট সুকুমার রায় অনেক কিছু খাওয়ার কথাই বলেছেন তাঁর ছড়ায়। সেই আমলেই তিনি বলে দিয়েছেন, 'সুদ খায় মহাজনে/ ঘুষ খায় দারোগায়'। এ অমোঘ সত্য থেকে আজও সমাজ বোধ হয় মুক্ত হতে পারেনি। তা সে, যার যেমন রুচি তিনি তেমনটি খাবেন। এ নিয়ে তো আর আমাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু বলেছেন, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন_'আবদুল হাই/ করে খাই খাই।' এরপর নানাবিধ জিনিস তার খাদ্য হয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আবদুল হাই 'এতোকিছু খেয়ে বলে/ কিছু খাই নাই।' এ বড় চিন্তার বিষয়। এত কিছু খেয়েও যদি কিছু খাওয়া না-হয়, তাহলে তো চিন্তার উদ্রেক হতেই পারে। আবার আখতার হুসেন যখন তাঁর ছড়ায় বলেন, 'সরকারি অফিসার মিস্টার কালু খাঁয়/ খিদে পেলে ভাত নয়, শুধু কাঁচা আলু খায়' এবং শেষে 'ওষুধের মতো করে মধু দিয়ে বালু খায়'_তখন তো চিন্তিত হতেই হয়। কারণ, এটা তো স্বাভাবিক খাবার নয়। সুকুমার রায় তো 'পাকাপাকি'তে বলেই দিয়েছেন, 'ফলারটি পাকা হয় লুচি-দধি আহারে'।
মানুষের খাদ্য তালিকায় কী কী থাকতে পারে, তার একটা ধারণা আমাদের আছে। কিন্তু যখন দেখি কেউ বন খেয়ে ফেলছে, কারো নামের সঙ্গে 'বনখেকো' বিশেষণ বসে যাচ্ছে, তখন আমাদের একটু অবাকই হতে হয়। কেউ বন খায়, কেউ ধন খায়। কেউ খেয়ে-দেয়ে আরামের ঢেঁকুর তোলে। কেউ আবার যত খায় তত চায়। খেয়ে তৃপ্তি হয় না। আরো খেতে চায়। বাই দ্য বাই ক্লাবের এই প্রতিযোগিতার বাইরেও খাওয়ার এবং পাওয়ার একটা প্রতিযোগিতা এ সমাজে আছে। সবাই খেতে চায়। খাওয়ার শেষ নেই। চিকিৎসাশাস্ত্রে বুলিমিয়া নামে একটা রোগ আছে। যাদের মনটা সব সময় খাই-খাই করে, তারা যে বুলিমিয়া রোগে আক্রান্ত সেটা এখন আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজনৈতিক কারণে যাদের খাই-খাই বাড়ে, তারা 'পলিটিক্যাল বুলিমিয়া' রোগে আক্রান্ত কি না সেটা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। তবে এটা ঠিক যে এই খাওয়া-খাওয়ির ব্যাপারটা কারো কারো জন্য খেয়োখেয়ি হয়ে যায়। এই খাওয়া নিয়ে একটা নাটক হয়েছিল ঢাকার মঞ্চে। ঢাকা থিয়েটারের সেই মঞ্চসফল নাটকটির নাম মুনতাসীর ফ্যান্টাসি। প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীনের নাটক। নাটকের প্রধান চরিত্র মুনতাসীর কেবলই খেতে চায়। যা দেখে তা-ই খেয়ে ফেলে। খেতে খেতে পেট ফুলে গেল তার। একসময় অপারেশন করতে হলো। অপারেশন করে পেট থেকে বের করা হলো অ্যান্টিক এবং আরো অনেক কিছু।
খাওয়াটা কারো অভ্যাস, কারো নেশা। খাওয়ার নেশা একবার পেয়ে বসলে সহজে ছাড়ে না। খেতে খেতে সব কিছু খাওয়ার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করে। তখন কিছু একটা খেতে না পারলে মনের ভেতর কেমন কেমন করে। খেতেই হয়। রিলিফের গম, টিন থেকে শুরু করে বিস্কুট খাওয়ার ইতিহাস তো আমরা জানিই। ইদানীং আবার টেন্ডার থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছু খেতে দেখছি। এমন আজব আজব জিনিস খাওয়া চলছে, যা খাদ্য হতে পারে এমনটি আমাদের বোধেরও অগম্য ছিল।
=====================
রাজনৈতিক আলোচনা- ''উচিত কথায় ননদ বেজার, গরম ভাতে ভাতে বিলাই (বিড়াল)' by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী  প্রকৃতি- 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষশত্রু' by মেহেদী উল্লাহ  ইতিহাস- 'ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর আসন' by সৈয়দ আবুল মকসুদ  ইতিহাস- 'টিকে থাকুক ‘টেগর লজ’' by আশীষ-উর-রহমান  আলোচনা- 'কর্মশক্তি ও টাকার অপচয়!' by রোজিনা ইসলাম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আশির দশকে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন' by আবুল কাসেম ফজলুল হক  আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব আকাশচুম্বী' by ড. নিয়াজ আহম্মেদ  ইতিহাস- 'প্রত্যন্ত জনপদে ইতিহাস-সঙ্গী হয়ে' by সাযযাদ কাদির  আন্তর্জাতিক- 'জাতিসংঘ বনাম যুক্তরাষ্ট্র' by শহিদুল শহিদুল ইসলাম  গল্পালোচনা- 'দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ?' by মহসীন মহসীন হাবিব  স্বাস্থ্য আলোচনা- 'প্রসূতিসেবায় পিছিয়ে দেশ' by শেখ সাবিহা আলম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বন্দিত কান্না, নিন্দিত হরতাল আর রাজকীয় অশ্রুপাতের গল্প' by ফারুক ওয়াসিফ  খবর- উত্তর কোরিয়ার নতুন পরমাণু প্ল্যান্ট দেখে 'তাজ্জব' মার্কিন বিজ্ঞানীরা  গল্পসল্প- 'মুজিব একবার আসিয়া সোনার বাংলা যাওরে দেখিয়ারে' by মোস্তফা হোসেইন  আন্তর্জাতিক- 'ওবামা কি ক্লিনটনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন?' by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী  কৃষি আলোচনা- 'পোষের শেষ মাঘের বারো' by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস  মণিপুরি মহা রাসলীলা উৎসবের ইতিকথা by মুজিবুর রহমান

কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আলী হাবিব


এই লেখা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.