কন্যাশিশুর অধিকার রক্ষা -ধর্ম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলাম কন্যাশিশুকে সৌভাগ্যের প্রতীকরূপে ঘোষণা করেছে এবং যাবতীয় বৈষম্যমূলক অশোভনীয় আচরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। প্রতিটি শিশুসন্তান পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ও বিকশিত হওয়ার অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। পুত্রসন্তানের মতো কন্যাশিশুরাও এ অধিকারের সমান দাবিদার। প্রাক-ইসলামী অন্ধকার যুগের হীন মনোবৃত্তির কথা আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে। সে ভাবে হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে! সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কতই না নিকৃষ্ট।’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫৮-৫৯)
ইসলাম মানুষকে এ ধারণায় দীক্ষিত করেছে যে পুত্র-কন্যা দুই ধরনের সন্তানই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিশেষ উপহার। সন্তানকে চোখ জুড়ানো সম্পদ বিবেচনা করে পুত্র বা কন্যা হোক আচরণের ক্ষেত্রে এ দুইয়ের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করা ইসলাম সমর্থন করে না। কিন্তু বর্তমানে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সাধারণত পুত্রসন্তানের প্রতি যে অধিক যত্ন নেওয়া হয়, কন্যাশিশুর প্রতি তা করা হয় না। বৃহত্তর সমাজ তো দূরের কথা, পরিবারেই কন্যাশিশুটি সবচেয়ে বেশি অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়। এটি আমাদের জরাজীর্ণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার মারাত্মক ত্রুটি। ইসলামের সুমহান বাণী তাদের বোধে-বিশ্বাসে সুদৃঢ়ভাবে অবস্থান করে নিতে পারেনি। অথচ মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের মধ্যে কন্যাই উত্তম।’ (মুসলিম)
দরিদ্র পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে কন্যার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে ছেলের লেখাপড়া কষ্টে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। অথচ কিশোরীটিও যে পরিবারে শ্রম ও মেধা দিয়ে সাহায্য করে, তার হিসাব কেউ রাখে না। তারা মেধাবী নয়, সৃষ্টিশীল নয়, এমন অজুহাতে অনেক সময়ই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পরিবার তাদের প্রাপ্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। কন্যাশিশুকে তার সমবয়সী একজন পুত্রসন্তানের মতো একইভাবে আদর-যত্ন দিয়ে লালন-পালনের প্রতি সব মা-বাবারই আরও সচেষ্ট ও সচেতন হতে হবে; তা না হলে এর প্রভাব ভবিষ্যত্ প্রজন্মের ওপর পড়বে। তাই কন্যাশিশুর প্রতি কোনো রকম তাচ্ছিল্য প্রদর্শন, পুত্র ও কন্যার মধ্যে পার্থক্য বিধান এবং মেয়েদের ওপর ছেলেদের অহেতুক প্রাধান্য দিতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন নবী করিম (সা.)।
কন্যাশিশু ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য বেহেশতের শুভবার্তা বয়ে আনে এবং সংসারজীবনকে স্নিগ্ধ মায়া-মমতায় ভরে রাখে। তাই এরা ঘরের প্রাণময় সৌন্দর্য; কিন্তু বর্তমান সমাজে অনেকেই কন্যাসন্তান জন্ম নিলে খুবই বিব্রতবোধ করেন। একাধিক কন্যা হলে অত্যন্ত হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার অপরাধে স্ত্রীকে বিভিন্ন রকম অমানুষিক নির্যাতন করে থাকে। এমনকি তালাক দেওয়ার মতো নির্মম ও অত্যন্ত জঘন্য পাপের পথেও পা বাড়ায়। নানাভাবে কন্যা জন্মদাত্রীকে নিগৃহীত করা হয়। নির্মম ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি বিশ্বব্যবস্থায় বিরাজমান বাস্তবতা কন্যাশিশুর অধিকার সুরক্ষার পক্ষে মোটেই অনুকূলে নয়। অথচ কন্যাসন্তান প্রতিপালনের অতুলনীয় মর্যাদার কথা রাসূলুল্লাহ (সা.) মানুষকে উদাত্তকণ্ঠে জানিয়েছেন। অসংখ্য হাদিসে কন্যাশিশু প্রতিপালনের মর্যাদা ও অশেষ পুণ্যের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। মহানবী (সা.) পিতার অন্তরে কন্যা সন্তানের প্রতি গভীর মমত্ববোধ জাগ্রত করার উদ্দেশে উপদেশবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুটি কন্যাসন্তানকে বয়োপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে, কিয়ামতের দিন আমি ও সে এরূপ কাছাকাছি থাকব বলে তিনি তার আঙুলগুলো মিলিয়ে দেখালেন।’ (মুসলিম)
সমাজব্যবস্থায় মনে করা হয়, বিয়েই হচ্ছে কন্যাশিশুদের একমাত্র গন্তব্যস্থল। তাই প্রয়োজনে শিক্ষাকে ব্যাহত করেও নির্দিষ্ট বয়সের আগেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। এখনো কন্যাশিশুর শিক্ষা অর্জনের পথে পরিবারের যথেষ্ট উদার মানসিকতার পরিচয় মেলে না। আর্থিক কারণে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হলে কন্যাশিশুর ভাগ্যেই তা জোটে। এখনো অনেক পরিবারে কন্যাশিশুকে প্রয়োজনীয় খাবার খেতে দেওয়া হয় না। কন্যাশিশুর অসুস্থতাকেও অনেক পরিবারে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। পরিবারে কন্যাশিশুর পর্যাপ্ত পুষ্টি চাহিদা পূরণের সুযোগ নেই। একই জায়গায় পুত্রসন্তানের জন্য খাবারের উত্কৃষ্ট অংশ যেখানে বরাদ্দ রাখা হয়, সেখানে কন্যাশিশুকে বঞ্চিত করা হয়। কিশোরীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে সঠিক ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রয়োজন। খাবারদাবার সম্পর্কিত কুসংস্কার দূর করা প্রয়োজন। সমাজে প্রচলিত নীতিকথা আর চিন্তাচেতনা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি অনেকেই। অথচ নবী করিম (সা.) ইরশাদ ফরমান, ‘যার দুটি বা তিনটি কন্যাসন্তান আছে এবং তাদের উত্তম শিক্ষায় সুশিক্ষিত ও প্রতিপালিত করে সত্ পাত্রস্থ করবে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গে অবস্থান করবে।’ (মুসলিম)
নবী করিম (সা.) তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা হজরত ফাতেমা আয-যাহরা (রা.)-এর সঙ্গে যে ধরনের উঁচুমানের ব্যবহার করতেন, তা ছিল তত্কালীন সমাজের নিয়মকানুনবহির্ভূত। তিনি কন্যাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, যেখানেই যেতেন শিশু ফাতেমাকে সঙ্গে নিয়ে বলতেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার প্রথম সন্তান মেয়ে।’
নবী করিম (সা.) কন্যাশিশু তথা নারীর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে হজরত ফাতেমা (রা.)-এর মাধ্যমে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এবং একই সঙ্গে তাঁকেও একজন আদর্শ রক্ষক হিসেবে গড়ে তুলে বলেন, ‘কন্যাসন্তান সুগন্ধি ফুল, আমি তার সুগন্ধি গ্রহণ করি আর তার রিযিক তো আল্লাহর হাতে।’
আজকের কন্যাশিশুই আগামী দিনের একজন নারী, ভবিষ্যত্ প্রজন্মের নিয়ামক শক্তি। অথচ বঞ্চনার কারণে কন্যাশিশুরা পরিণত বয়সে ছেলেদের মতো মানবসম্পদ হয়ে উঠতে পারছে না। এভাবে কন্যাশিশুকে অধিকারবঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে যে বৈষম্যের সূত্রপাত হয়। তার খেসারত শুধু কন্যাশিশু আর নারী নয়, গোটা জাতিকে দিতে হয়। এ কঠিন বাস্ততায় ইসলামে কন্যাশিশুর অধিকার রক্ষা ও বিকাশের বিষয়টিকে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার কাজ করতে হবে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে কন্যাশিশুর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য, অবহেলা, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এখনই। কন্যাশিশুর রিযিক আল্লাহ তাআলা দান করেন, তার জীবন-জীবিকা ও উপযুক্ত সময়ে পরিণয়বন্ধনের দায়ভারও মহান আল্লাহ গ্রহণ করেন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.