পারিবারিক নির্যাতনের অচেনা দিক -নারী অধিকার by জোবাইদা নাসরীন

প্রথম আলোয় ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি রিপোর্ট আমাদের আতঙ্কগ্রস্ত করেছে, শঙ্কিত করেছে। পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ এবং এর বিপরীতে লিঙ্গীয় সমতা রক্ষার জন্য সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগকে রীতিমতো ব্যঙ্গ করেছে রিপোর্টটি। এই রিপোর্টের তথ্য আমাদের আলোর বিপরীতে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়, আশার আলো নিভিয়ে দেয়। আমরা ঘরের দিকে ফিরে তাকাই, নির্যাতনের চিত্র দেখি, ভয়াবহতা দেখি, নারীর অবস্থা বিবেচনা করি।
পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টটিতে প্রধান যে বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে তা হলো বাংলাদেশে বিবাহিত পুরুষদের ৬০ শতাংশই দাম্পত্য জীবনে কোনো না কোনো সময় স্ত্রীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন। আমরা ধরেই নিতে পারি, এর সংখ্যা আরও বেশি। কেননা এ দেশে খুব কম নারীই স্বামীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাইরে করও কাছে বলেন। ‘ঘর-বাহির’-এর রাজনৈতিক দূরত্ব তাঁদের এই নির্যাতনের পরিসীমাকেও খণ্ডিত করে। তাই এর বিরুদ্ধে আইন-বিচারের জায়গাও হয়ে পড়ে খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্ত। যার কারণে নারী ছিটকে পড়ছে আরও দূরে, কেননা কোনো নির্যাতনের জন্য কেথায় গিয়ে বিচার চাইতে হবে, সেটি হয়ে পড়ে তার কাছে অস্পষ্ট। ফলে আরও বেশি নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই চোখ বন্ধ করে বলা যায়, এই ৬০ শতাংশ হলেন তাঁরাই যাঁরা কিছুটা বলতে পেরেছেন কিংবা সমাজের হাজারো চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে বলার মতো শক্তি অর্জন করেছেন, কিংবা যারা স্বামীর নির্যাতনের কারণেই ভয়কে জয় করতে পেরেছেন।
তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, এখানেই শেষ হয়ে যায়নি এই তথ্যের জৌলুস। গবেষণা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা রিপোর্টটি আরও জানায়, পরিবার-কাঠামোতে ৫৪ শতাংশ স্বামীর মতে, স্ত্রীকে নির্যাতন করা স্বামী-স্ত্রীর একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। ৩৯ শতাংশ মনে করেন, স্ত্রীকে মারধর করার অধিকার স্বামীর আছে। এটি কোনোভাবেই ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, এটি একবারেই পুরুষতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়। ‘ব্যক্তিগত’-র আবরণ দিয়ে এটিকে জায়েজ করা হয়, বৈধ করার চেষ্টা হয় কিংবা অপরাধ জেনেও আড়াল করার অবিরাম চেষ্টা চলে। তাই এই প্রবণতাকে মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে। আর শুধু স্ত্রী কেন যে-কাউকেই শারীরিকভাবে আঘাত করা অপরাধ, নির্যাতন। সেটি কারও অধিকার হতে পারে না।
বাংলাদেশে পরিচালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ মতে, ১৫ বছরের বেশি বয়সী গ্রামের নারীদের ৪২ শতাংশ এবং শহরের নারীদের ৪০ শতাংশ কাছের মানুষের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এর সঙ্গে আরও তথ্য জানা যায়, আইসিডিডিআরবি এবং নারীপক্ষ পরিচালিত জরিপ থেকে, যেখানে দেখা গেছে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী নারীদের ৪৮ শতাংশই এ নির্যাতনের শিকার (প্রথম আলো, ১২ সেপ্টম্বর ২০০৯)। এই বিষয়ে বেশ কটি গবেষণা-রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী মেয়েশিশুরা প্রথম যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হয় খুব কাছের আত্মীয়-পরিজনদের মাধ্যমে, আদর-স্নেহের আবরণে কিংবা অতি ভালোবাসার প্রলেপে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন মেয়েশিশুর বয়স এতই কম থাকে, সে বুঝতেই পারে না যে এটি নির্যাতন। পরবর্তী সময়ে বুঝতে পারলেও, সামাজিক চাপ ও পুরুষতন্ত্রের অনিঃশেষ তাপে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই বিষয়ে খুব বেশি আগানো সম্ভব হয় না।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ ‘হেলথ সার্ভে ২০০৭’ শীর্ষক এক জরিপে স্ত্রী-নির্যাতনের পেছনে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে স্বামীর আদেশ অমান্য করা, স্বামীর যৌন আগ্রহে সাড়া না দেওয়া, যথাসময়ে ঘরের কাজ শেষ না করা, সন্তানদের যত্ন না নেওয়া, স্বামীকে না বলে বাইরে যাওয়া, ধর্মীয় আচার না মানা এবং স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করা। এই সব অজুহাত নির্যাতনের কারণ হিসেবে কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। নারীর এই ধরনের আচরণের সামাজিক চাহিদায় ‘সামাজিক নারী’র একটি কল্পিত রূপ আমাদের সামনে হাজির করে। পারিবারিক এই নির্যাতন সয়ে যাওয়া, দেনদরবার করা, প্রতিবাদ করা কিংবা এটিকে অনিবার্য বলে মনে করে নারী ‘বিয়ে’ নামক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আসলে একটি ব্যবস্থার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আপসরফার চেষ্টা করে মাত্র। কখনো কখনো সেটি ঘটে তার জীবনের বিনিময়েও। কিন্তু এটি হওয়া ঠিক নয়, এই ধরনের প্রবণতার মাধ্যমে নারী নির্যাতন আরও বাড়ে, কোনোভাবেই কমে না।
এখানে কিছু বিষয় খোলাসা করা প্রয়োজন। প্রথমত, নারীর প্রতি শারীরিক নির্যাতনের ধরন বলতে বলা হয় কিংবা বোঝানো হয় শারীরিকভাবে মারধর করাকেই। কিন্তু এই নির্যাতনের অন্যতম ধরন হলো ‘ম্যারিটাল রেপ’ অর্থাত্ বিয়ে সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণ, যেটিকে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই বিবেচনার মধ্যে নেওয়া হয় না। দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ধর্ষণের অস্তিত্ব এবং এর মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি নির্যাতনের বিষয়টিও পারিবারিক কাঠামোতে নারীর প্রতি নির্যাতনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধরন; কিন্তু এটিকে সামনে আনা হয় না, গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয় না, বরং দাম্পত্য সম্পর্কের অনিবার্য শর্ত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ম্যারিটাল রেপকে যদি নির্যাতন হিসেবে দেখা হতো, তাহলে নির্যাতনের পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই ৬০ শতাংশের বেশি হতো। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র নেপালেই ম্যারিটাল রেপের বিরুদ্ধে আইন রয়েছে। ওখানে বলা হয়েছে, ধর্ষণ হলো ধর্ষণই, সেটি যার মাধ্যমে যেভাবেই সংগঠিত হোক না কেন। আমেরিকার একটি গবেষণা-প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, বিয়ে সম্পর্কের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, যা কখনো পারিবারিক নির্যাতন হিসেবে উল্লেখ করা হয় না। পারিবারিক নির্যাতনের একটি বড় জায়গা হিসেবে বাংলাদেশে অচিরেই ম্যারিটাল রেপের মতো বিষয়কে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি হলো পারিবারিক নির্যাতনকে ব্যক্তিগতভাবে দেখা। পরিবার একটি সামাজিক স্তম্ভ। কিন্তু কী কারণে পারিবারিক সম্পর্ককে ব্যক্তিগত বলা হয় কিংবা ব্যক্তিগত হিসেবে দেখা হয় তা বোঝা মুশকিল। ব্যক্তিমাত্রই রাজনৈতিক, এখানে কোনো কিছুকে ব্যক্তিগতর মোড়কে দেখার সুযোগ নেই, এবং সম্পর্ক কখনো ব্যক্তিগত হতে পারে না। বিশেষ করে, লিঙ্গীয় সম্পর্ক বিশ্লেষণে বলা যায়, এই সম্পর্কে যে রাজনৈতিক লেনদেন থাকে, শাসন-শোষণের বিষয় থাকে, ঔপনিবেশিকতা-অধীনতার ধরন থাকে, এটি কখনো ব্যক্তিগত হতে পারে না। পারিবারিক নির্যাতন অবশ্যই একটি রাজনৈতিক বিষয়— এটি অপরাধ, এটি বন্ধ হওয়া উচিত।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaida_76@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.