হার না–মানাদের জয়গাথা by সাঈদা ইসলাম

চট্টগ্রাম বিভাগে জয়িতা খেতাবজয়ী পাঁচ নারী: (বাঁ থেকে) তাহমিনা হক চৌধুরী,
ঝর্ণা ধর, শিরিন আক্তার খানম, হাফছা আক্তার ও আয়েশা বেগম l প্রথম আলো
বারবার হোঁচট খেয়েছেন, কিন্তু দমে যাননি। ভাঙা থেকেই গড়েছেন নিজেকে। মিলেছে কাজের স্বীকৃতি। হয়েছেন ২০১৪ সালের শ্রেষ্ঠ জয়িতা। হার না–মানা সেই পাঁচ নারীর জয়গাথা নিয়ে এই আয়োজন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন সাঈদা ইসলাম
পড়ে পড়ে মার খেয়ো না, ঘুরে দাঁড়াও : ঝর্ণা
২০০২ সালে বিয়ে হয় কক্সবাজারের মেয়ে ঝর্ণা ধরের। বয়স তখন মাত্র ১৩। কিশোরী ঝর্ণার বিয়েতে সাধ্যমতো যৌতুক দিয়েছিলেন দিনমজুর বাবা। আরও টাকার দাবিতে বিয়ের পরপর ঝর্ণার ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। এর মধ্যে ২০০৪ সালে জন্ম নেয় প্রথম সন্তান। এর তিন বছর পরে জন্ম নেয় দ্বিতীয় সন্তান। কিন্তু এ নিয়ে বাধল বিপত্তি। সন্তানের গায়ের রং ফরসা হওয়ায় নিজের সন্তান হিসেবে অস্বীকৃতি জানান স্বামী। অত্যাচার ও পরকীয়ার অপবাদ সহ্য করতে না পেরে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান ঝর্ণা। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও নির্যাতন বন্ধ হয়নি। একদিন পাষণ্ড স্বামী ঝর্ণার গায়ে অ্যাসিড ঢেলে পালিয়ে যান। এরপর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহায়তায় দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হন তিনি।
স্বামীর ঘরে আর ফেরেননি ঝর্ণা। চট্টগ্রামে পোশাক কারখানায় কাজ নেন। এখন দুই সন্তানকে নিয়ে জীবন যাপন করছেন তিনি। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী হিসেবে হয়েছেন এবারের জয়িতা।
ঝর্ণা বলেন, ‘এখন অনেক সুখে আছি। মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছি। আমার মতো নির্যাতনের শিকার মেয়েদের বলব, পড়ে পড়ে মার খেয়ো না, ঘুরে দাঁড়াও। আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ো না।’
ভাঙা থেকেই গড়েছি: শিরিন
চাঁদপুরের শিরিন আক্তার খানম। ১৯৮৫ সালে স্বামীর মৃত্যুতে চার সন্তানকে নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন। তখন ছোট সন্তানের বয়স মাত্র আড়াই মাস আর বড়টির ১২ বছর।
সেই সময়কার অভাব ও সংগ্রামের প্রতিটি দিন এখনো ভোলেননি শিরিন। জানালেন, মৃত্যুর সময় কিছুই রেখে যেতে পারেননি স্বামী। ছোট ভাই ছাড়া আর কোনো আত্মীয়স্বজনও বিপদে হাত বাড়িয়ে দেননি। ১৯৭২ সালে মেট্রিক পাস করেছিলেন শিরিন আক্তার। সেই বিদ্যাকে সঞ্চয় করে ১৯৮৬ সালে পিটিআইয়ে (প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণকেন্দ্র) ভর্তি হন। ১৯৮৮ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে স্থানীয় বিদ্যালয়ে যোগ দেন। চাকরির স্বল্প টাকায় সংসার চালানো কষ্ট, তাই পাশাপাশি শুরু করেন সবজি চাষ ও হাস-মুরগি পালন। সময়ে সময়ে বাজারে বিক্রি করতেন সেসব। এভাবেই সুদিন ফেরে তাঁর।
সন্তানেরা এখন সবাই প্রতিষ্ঠিত। সফল জননী হিসেবে হয়েছেন জয়িতা। শিরিন বলেন, ‘আঘাত সয়েছি। কিন্তু ভেঙে পড়িনি। ভাঙা থেকেই গড়েছি।’
দিনের ১৮ ঘণ্টাই কেটেছে কাজের মধ্যে: আয়েশা
লক্ষ্মীপুরের মেয়ে আয়েশা বেগম। সাত বোনের মধ্যে সবার বড় আয়েশার পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। মনে স্বপ্ন, পড়াশোনা শেষে সেবিকা হবেন। কিন্তু কৃষক বাবার সামর্থ্য না থাকায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আর পড়তে পারেননি তিনি। ২০০৩ সালে একই গ্রামে বিয়ে হয় আয়েশার। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ২০০৪ সালে স্বামী-স্ত্রী চলে আসেন চট্টগ্রামে। পোশাক কারখানায় কাজ নেন দুজনেই। কিন্তু কিছুদিন পরেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় আবারও স্বামীর সঙ্গে লক্ষ্মীপুরেই ফেরেন।
সন্তান জন্মের পর ২০০৫ সালে নিজ গ্রামে টিউশনি শুরু করেন তিনি, গৃহকর্মীর কাজও করেছেন। একই সঙ্গে একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ও জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রমের আওতায় মাঠকর্মীর কাজ নেন। ২০০৭ সালে নিজের সঞ্চয় ও ঋণ মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন বিয়ের শাড়িতে নকশা তৈরির ব্যবসা।
আয়েশা বলেন, ‘দিনের ১৮ ঘণ্টাই কেটেছে কাজের মধ্যে। পরিশ্রমের ভিতে গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠান। এখন আমার প্রতিষ্ঠানে ৪০০ কর্মী কাজ করেন।’ আয়েশা অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে হয়েছেন জয়িতা।
সাহস আর ইচ্ছাশক্তিই একমাত্র পুঁজি: হাফছা
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে জন্ম হাফছা আক্তারের। জন্মের দুই বছর পর অসুস্থ হয়ে কোমরের নিচের দিকের কর্মক্ষমতা হারান তিনি। একেবারে পঙ্গু হননি, তবে সুস্থ আর আট-দশটি শিশুর মতো হাঁটতে পারতেন না।
শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে মেয়ে পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হবে—এটি মেনে নিতে পারেননি হাফছার দিনমজুর বাবা। ভর্তি করিয়ে দেন বিদ্যালয়ে। হাফছা বলেন, ‘পায়ে জোর ছিল না, কিন্তু মনে ছিল অসম সাহস আর ইচ্ছাশক্তি। সেটাকে পুঁজি করে হেঁটেই প্রতিদিন তিন কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে গিয়েছি।’
এদিকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার আগে মারা যান বাবা। ভেঙে পড়লেও পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ২০০৫ সালে স্নাতক শেষ করেন।
২০০৫ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত ২১তম হ্যান্ডি ম্যারাথন (হুইলচেয়ার) প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান হাফছা। সেখানে ২১টি দেশের ২৫১ জন প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথম হন। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনার পাশাপাশি আরও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন হাফছা।
বর্তমানে হাফছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। আরও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা আছে তাঁর। তিনি শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে জিতেছেন জয়িতার শিরোপা।
নারীরা কারও মুখাপেক্ষী নয়: তাহমিনা
সন্দ্বীপের এক দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন ইউনিয়নের নাম উড়িরচর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্য আর শিক্ষার আলোহীন একটি এলাকা। ১৯৮৫ সালে সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) গঠনের পর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তাহমিনা হক চৌধুরী। এরপর টানা ১৫ বছর এই চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। গড়ে তোলেন তিনটি প্রাথমিক ও একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়।
উড়িরচরের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সন্দ্বীপের কাঠগড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও ছিলেন তাহমিনা। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের প্রথম নারী চেয়ারম্যান তিনি।
তবে শুধু এই দুটি ইউনিয়নই নয়, কালাপানিয়া ইউনিয়নের উন্নয়নেও রয়েছে তাহমিনার অবদান। তাঁর দান করা জমিতে এই ইউনিয়নে চারতলার দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে।
৮২ বছর বয়সী তাহমিনা এখনো মানবসেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও সম্মাননা পেয়েছেন। বাবা ও স্বামী ছিলেন এ কাজে তাঁর প্রেরণা। বাবা শামসুদ্দিন মিয়াও ছিলেন সন্তোষপুর ইউপির চেয়ারম্যান। এবারের জয়িতা অন্বেষণে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় তাহমিনাকে জয়িতা হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হয়। তাহমিনা বলেন, ‘নারীরা কারও মুখাপেক্ষী নয়। সমান তালে এগিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা আছে আমাদের মধ্যে।’

No comments

Powered by Blogger.