চুপ থাকলে চলবে না by নাতাশা ইসরাত কবির

ভিন্নভাবে সক্ষম জনগোষ্ঠীর নারী শিক্ষার্থীরা প্রজনন শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, যারা তথাকথিত প্রতিবন্ধী হিসেবে পরিচিত, নাকি মূলধারা গোষ্ঠীর মানসিক প্রতিবন্ধকতা? যেমন ফেসবুকের একটি গ্রুপের নাম 'সিস্টারহুড'। সেখানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন লিখেছেন_ রাজশাহী নিবাসী তার এক বান্ধবীর বক্তব্য ছিল এমন : 'আমার মেয়েটির বয়ঃসন্ধিকাল পরিবর্তন বন্ধ করা জরুরি। কারণ আমি এক অক্ষম মা, যার মেয়ে ডাউন সিনড্রোমে ভুগছে।' যার পরিচয় এক কথায় বলতে গেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। উপরের কথাগুলো একজন মা যখন দুঃখে, বিধ্বস্ত মনের আকুতি নিয়ে বলছেন, তখন আমরা আসলে অনেকে জানি না ডাউন সিনড্রোম সম্পর্কে। আর এ মুহূর্তে প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ভিন্নভাবে সক্ষম শব্দটি ও একজন মাকে নির্ভরতা ও নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। কারণ প্রতিবন্ধকতা এখনও আমাদের মানসিকতায়। এ সংকট আরও ঘনীভূত হয় অটিস্টিক কিশোরী ও তরুণীর ক্ষেত্রে। সুইড বাংলাদেশের একজন শিক্ষিকা বলেন, অনেক বাবা-মা লোকলজ্জাকে এত বেশি প্রাধান্য দেন যে, নিজের মেয়েটির সমস্যা তার কাছে গৌণ।
২০১০ আমি যখন ফেলোশিপে কাজ করি, তখন আমার কাজের জন্য বেছে নিই সমাজের সেই শ্রেণীর নারীদের, যারা মূলধারা থেকে সেই বাস্তবতা আমাকে বিশালভাবে ভাবায় যখন নারীদের একটা অংশ প্রজনন সংক্রান্ত অজ্ঞতা নিয়ে দিনের পর দিন পার করছে এবং যারা মূলধারা থেকেই বিচ্ছিন্ন। তাদের ছাড়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব? কথা হচ্ছিল এনজেন্ডার হেলথের তৎকালীন সময়ের প্রোগ্রাম অফিসারের সঙ্গে, তিনি নিজেও এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করেননি।
আজ ২০১৫ সালে আমি নিজেই যখন ভিন্নভাবে সক্ষম গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছি, তখন বুঝতে পারছি পরিস্থিতি আরও কতটা সংকটময়। তাদের এক কথায় প্রতিবন্ধী বলা হচ্ছে; কিন্তু প্রতিবন্ধকতা আসলে আমাদের মনমানসিকতায় যারা মূলধারার জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেকে দাবি করে। ভিন্নভাবে সক্ষম জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই বললে চলে। কিন্তু প্রশ্নটা এখানেই, পড়াশোনা যাদের জীবনে অনিশ্চিত আর জীবনটাকে যাদের বোঝা হিসেবে বয়ে বেড়ানোর অনিশ্চয়তা বহন করতে হয়, সেখানে প্রজনন শিক্ষা তো দূর প্রয়োজনীয় শিক্ষার জায়গাটি অনিশ্চিত।
মনে আছে, বধির স্কুলের ছাত্রী সুমি (১৮) প্রথম জানতে পারে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে, পরিবারে তো আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না আর স্কুলে তো সুযোগ নেই। তাকে যখন প্রশ্ন করা হয় সে এ বিষয়ে ট্রেনিং নিতে আগ্রহী কিনা, সে কিছুটা ইতস্তত করে এবং ইশারা ভাষায় জানায়, ছেলেদের সঙ্গে একই শ্রেণীকক্ষে না। সুমিকে যখন প্রশ্ন করা হয়, কেন ছেলেদের সঙ্গে নয়! উত্তরটা শুধুই সংকোচের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য মাশিয়াত (১৮) এ বিষয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি, সে ও সুমি একই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলেও সুমীর ক্ষেত্রে যেখানে অভিভাবক ভূমিকাহীন, সেখানে মাশিয়াত মনে করে, তার মা তাকে অনেক তথ্য দিয়েছেন। শান্তা আর মৌ একই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং তারাও সংকোচবোধ করছিল বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা না থাকায়। প্রথম যখন বিষয়টা উপস্থাপন করা হয়, তখন তারা প্রশ্নগুলো দেখে বুঝতে পারেনি। পরবর্তীকালে যখন বুঝিয়ে বলা হয় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে, তাদের কাছে প্রতিটি বিষয় নতুন মনে হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েকটি শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে এ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া থাকলেও তা অপ্রতুল এবং তা থেকে প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয় না। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীরা তথা ভিন্নভাবে সক্ষম নারীরা। ফলে বাল্যবিয়ে, বারবার গর্ভধারণ, অপুষ্টি, মাতৃত্বকালীন মৃত্যু, দুর্বল ও মৃত সন্তান প্রসব বেড়ে চলেছে। একজন শারীরিক ও ভিন্নভাবে সক্ষম নারী বর্তমানে দেশের একটি বিখ্যাত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তিনি প্রতি মুহূর্তে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। তবু পত্রিকা, বেতার আর টেলিভিশন থাকায় তিনি কিছুটা ধারণা পেয়েছেন।
সমস্যাটা এখানেই, ছাত্রীদের মধ্যে অনেকের পারিবারিক পরিবেশ অনুকূল নয়; বিশেষত বধিরদের ক্ষেত্রে বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে তথ্য পাওয়া সহজ নয়। কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, তাদের এক সহপাঠীর অষ্টম শ্রেণীতে থাকতে বিয়ে হয়ে যায়। তিন বছরের মধ্যে তিনটি সন্তানের মা হয় এবং মা-শিশু উভয়ে অপুষ্টির শিকার। তার কাছ থেকে তার সহপাঠীরা কিছু ধারণা পায়। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই, সে যদি সচেতন থাকত তাহলে এ সমস্যা হতো না। যে বিষয়টা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় তা হলো, মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে পারিবারিক আর সামাজিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
২০০৬ সালে জাতীয় প্রজনন স্বাস্থ্য নীতিমালার কৌশলপত্র ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২০০৩ সালে ছয়টি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ছয়টি মন্ত্রণালয় নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত। প্রস্তাবিত উদ্দেশ্য হলো, পাঠ্যক্রমও কমিউনিটিভিত্তিক কৈশোর-প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন করা, বাল্যবিয়ে ও গর্ভধারণের ঘটনা কমানোর কৌশল এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রসার, এইচআইভি এইডসসহ যৌন সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধ, কৈশোর প্রজনন স্বাস্থ্য ও সংশিল্গষ্ট সেবা কিশোর-কিশোরীদের নাগালে নিয়ে আসা এবং ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ নিরুৎসাহিত করা।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্পর্শকাতর এইচআইভি এইডসকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরপরও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ভিন্নভাবে সক্ষম জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কাজটি শুধু প্রকল্পের অধীনে করলে চলবে না।
সবকিছুর পর যে প্রশ্নটা আবারও আসে, মূলধারা বলে বিচ্ছিন্ন নীতির যে ধারা অব্যাহত আছে তখন বিশেষভাবে সক্ষম গোষ্ঠী আর তাদের অভিভাবকদের সচেতন করার দায়িত্ব কে নেবে? যেখানে দেশের তরুণ ও তরুণীর একটি অংশ বিশেষভাবে সক্ষম জনগোষ্ঠী, তাদের কথা না ভেবে নীতিমালা, সভা-সমিতি এবং সচেতনতাকে প্রাধান্য দেওয়া কীভাবে সম্ভব?
এখনই আসলে এ উদ্যোগটি নিয়ে ভাবতে হবে, যেখানে অভিভাবককে বোঝানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও ভূমিকা রাখতে পারেন। ভিন্নভাবে সক্ষম গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রসঙ্গ এড়ালে চলবে না। কারণ তাদের জানার পরিধি ্র সুযোগ অনেক কম আর সেজন্য বিশেষ কর্মসূচি থাকতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বেতার ও টেলিভিশনের সব কার্যক্রমও মূলধারার গোষ্ঠী নিয়ে। আমাদের মানসিক প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে কেউ কথাই বলতে চায় না। আমাদের চুপ থাকলে চলবে না। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, তথ্য বিনিময়, পরামর্শ চালিয়ে যেতেই হবে।
গবেষক

No comments

Powered by Blogger.