অভিজিৎ হত্যার পৌনঃপুনিকতা যদি রোধ করতে হয়- by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

অভিজিৎ রায় ছিলেন বিজ্ঞানের সাধক। তারুণ্যভরা জীবনটি তিনি বিজ্ঞানের সত্য সাধনায় কাটিয়েছেন। তিনি তার মরদেহও দান করে গেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেবায়। তাকে শহীদ বলা হলে অত্যুক্তি হবে না। তিনি সত্যের সন্ধান ও সাধনায় জীবন দান করেছেন। কিন্তু সব সত্য সাধকের বেলাতেই যা হয় তার বেলাতেও অন্যথা হয়নি। তার পরিবারের ওপর থেকে বিপদটি এখনও কাটেনি। ঘাতকের দল এতই বিবেকবিহীন পশু যে, অভিজিৎকে হত্যার পর তার শোকার্ত পিতা অধ্যাপক অজিত রায়কেও জীবননাশের হুমকি দিতে দ্বিধা করছে না। আমি জানি না, এই সাহস তারা কোথা থেকে এবং কেমন করে পায়? অভিজিৎ হত্যায় বিক্ষুব্ধ মানুষ দেশে এবং বিদেশেও (লন্ডনে আজ রোববারেও ট্রাফালগার স্কোয়ারে প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে) দাবি তুলেছে এই নরপশুদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। সরকার যদি তা না পারে, তাহলে তা তাদের দুর্বলতা অথবা ব্যর্থতা বলে গণ্য হবে। আমি সব ব্যর্থতার দায়িত্ব সরকারের ওপর চাপাবো না। এই ঘাতকদের দেশ থেকে নির্মূল করার ব্যাপারে আমাদের একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। সেটি আমরা পালন করছি না, অন্যদিকে এই ঘাতক দমনে সরকারের নীতিতেও যথেষ্ট দুর্বলতা ও ধীরে চলার কৌশল লক্ষণীয়।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সন্ত্রাস যে নির্মূল করা যাচ্ছে না, তার একটা বড় কারণ, এই সন্ত্রাসের পেছনে আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা, আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য রয়েছে। এই সন্ত্রাস এখন জিহাদিষ্ট নামে চিহ্নিত হয়ে একটি তথাকথিত আন্তর্জাতিক মতবাদে পরিণত হয়েছে। এই মতবাদে দীক্ষা নিচ্ছে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার যে তরুণরা, তাদের মধ্যে অমুসলিমও রয়েছে। তারা শিক্ষিত, কিন্তু ধর্মান্ধ। এই ধর্মান্ধতার কারণে তারা ইরাকে ও সিরিয়ায় ‘ইসলামিক স্টেটে’ যোগ দিয়ে জেহাদে অংশ গ্রহণের জন্য ছুটে যাচ্ছে। এদের নিরস্ত্র ও দমন করার কাজে ইউরোপীয় সরকারগুলোই হিমশিম খাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের কথা আলাদাভাবে চিন্তা করা বাতুলতা।
তবু বাংলাদেশেই সরকার পারত এই নিষ্ঠুর বুদ্ধিজীবী হত্যা রোধে আরও সফল হতে, যদি তারা মৌলবাদী ও তাদের আর্মড উইং- জেহাদিস্টদের সম্পর্কে আরও কঠোর হতে পারত। অন্যদিকে আমাদের সুশীল সমাজ এবং নাগরিক সমাজও এই ঘাতক চক্রকে প্রতিরোধ করার ব্যাপারে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে ততোটা সচেতন ও সক্রিয় নন। আওয়ামী লীগ সরকারের কবল থেকে তাদের কল্পিত গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য আমাদের সুশীল সমাজ যতটা সরব ও সক্রিয়; দেশের জনগণকে, সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী সমাজকে ভয়াবহ মৌলবাদী উত্থান এবং তাদের ঘাতক বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচাতে তারা ততোটা সক্রিয় ও আগ্রহী নন। বরং তাদের একটি অংশ সম্ভবত মৌলবাদী হিংস্রতাকে তাদের গণতন্ত্রের আন্দোলনের সহায়ক শক্তি মনে করেন।
অন্যদিকে পাকিস্তান আমলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমন ও দাঙ্গাবাজদের রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারে দেশের সুশীল সমাজ ও ছাত্রসমাজকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। এবার সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চেয়েও ভয়াবহ হিংস্র জিহাদিস্টদের রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারে দেশের সুশীল সমাজ ও ছাত্রসমাজের মধ্যে আগের সেই ঐক্য ও মিলিটেন্সি নেই। বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের আগের সংগ্রামী ভূমিকা নেই। নানা স্বার্থদ্বন্দ্বে তারা বহুধাবিভক্ত এবং নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত।
অন্যদিকে একটি সুশীল শ্রেণী এখন চরম সুবিধাভোগী সমাজে পরিণত হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্রের জন্য বাঘ হিসেবে চিত্রণ করে মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতো টকশোতে গিয়ে চিৎকার করা এবং দেশে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে ওই সরকারকে মন্ত্রী, উপদেষ্টা জোগান দেয়াই তাদের প্রধান কাজ। আরও লক্ষ্য করার বিষয়, ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী বা জিহাদিস্টরা এ সুশীল সমাজের বুদ্ধিজীবীদের গায়ে কখনও হাত দেয় না।
অভিজিৎরা নৃশংসভাবে মরবে, দেশ মেধাশূন্য হবে, আমরা শুধু প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন করব এবং সরকার শুধু তদন্তের আদেশ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করবে। সেক্ষেত্রে এই পৌনঃপুনিক পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কখনও বন্ধ হবে না। সরকারের পুলিশি তদন্ত দীর্ঘকাল ধরে চলে। তারপর দু’একজন দুষ্কৃতকারী ধরা পড়ে ও সাজা পায়; যেমন পেয়েছে রাজশাহীর অধ্যাপক ইউনুসের এবং অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের দু’এক ঘাতক। তাতে ঘাতক শ্রেণীর সংখ্যা কমে না, রিক্রুটমেন্ট বন্ধ হয় না। বরং তাদের সাহস ও তৎপরতা বাড়ে। যেমন বাড়তে দেখা গেছে অভিজিৎকে হত্যার পর তার পিতা অধ্যাপক অজিত রায়কে হত্যার হুমকি দেয়ার মধ্যে। ঘাতকদের এই সাহস বাড়ার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। এক, একাত্তরের দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড কার্যকর করা ক্রমাগত বিলম্বিত হওয়ায় এই ঘাতক ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মনে এই ধারণাটি জন্ম নিয়েছে যে, সরকার এই দণ্ডদানে ভীত। সরকারের নীতি দুর্বল ও আপসবাদী। দুই, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ এই ঘাতক চক্রের সহায়ক এবং দেশের সুশীল সমাজও এই হিংস্র মৌলবাদীদের বদলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বেশি সরব ও সক্রিয়। তিন, বিএনপির তথাকথিত রাজনৈতিক আন্দোলনও এই সন্ত্রাসীদের তৎপরতার সহায়ক।
বর্তমান সরকারের প্রশাসনের মধ্যেও ভ্রান্ত ধর্মীয় অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত, মৌলবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি বড় অংশ আছে। পুলিশ প্রশাসনেও এদের সংখ্যা কম নয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেও আছে মৌলবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি অংশ। স্থানীয়ভাবে প্রভাব প্রতিপত্তি ও ভোটের বাক্স রক্ষার জন্য এরা মৌলবাদীদের তুষ্ট রাখতে চায়, এমনকি তাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যেও জড়িত তারা। ফলে এই ঘাতকদের ধরা সব সময় সহজ হয় না। অপরাধ অনুষ্ঠানের পর পালিয়ে গিয়ে তারা নিরাপত্তা ও আশ্রয় দুটোই পায়। পুলিশ তাদের নাগাল পায় না। অথবা নাগাল পেলেও ধরতে পারে না। নইলে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর হত্যাকাণ্ডের মীমাংসায় এত বিলম্ব ঘটে?
অভিজিতের হত্যাকারীদের ধরার ব্যাপারে সরকার এবার অন্তত কঠোর হোক। তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজে বের করুন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ এসব সন্ত্রাসীর রিক্রুটের ঘাঁটি, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। সন্ত্রাসীদের পিতামাতা ও অভিভাবকদের সতর্ক করুন। সুশীল সমাজ ও বৃহত্তর নাগরিক সমাজ কেবল মানববন্ধন না করে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সর্বদলীয় ছাত্রসমাজ সন্ত্রাস রোধে রাজপথে নামুন। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত ও প্রতিহত করার ব্যাপারে তারা ভিজিলেন্স কমিটি গঠন করুন।
বাংলাদেশে এই বুদ্ধিজীবী হত্যা ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক যোগসূত্র রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, এমনকি ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসএর সঙ্গে এই সন্ত্রাসী ও ঘাতকদের যোগাযোগ থাকার বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই যোগাযোগ ছিন্ন করার জন্য সরকারের আরও উদ্যোগী হওয়া দরকার, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গ্রহণও প্রয়োজন। হিংস্র মৌলবাদ ও সন্ত্রাস দমনে সরকার যদি সর্বাÍক নীতি গ্রহণ না করে এবং দেশের নাগরিকদের সব অংশকে এই নরপশুদের বিরুদ্ধে সজাগ ও সক্রিয় করে না তোলে, তাহলে দেশে পৌনঃপুনিক বুদ্ধিজীবী হত্যা, মেধা হত্যা অব্যাহত থাকবে এবং পরিণামে দেশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে। এই ঘাতকরা বিভ্রান্ত তরুণ নয়; এরা শিক্ষিত, ট্রেনিংপ্রাপ্ত, রাজনৈতিক প্রভুদের দ্বারা আদিষ্ট ও পরিচালিত নিষ্ঠুর, বিবেকবর্জিত ঘাতক। এদের বিরুদ্ধে দেশের সম্মিলিত সামাজিক ক্রোধ ও প্রতিরোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন।
দেশ যেন আরও অভিজিৎ না হারায়।
লন্ডন ১ মার্চ, রোববার, ২০১৫

No comments

Powered by Blogger.