দুই মাসেও ঠিক হয়নি রেলসূচি by মাহমুদ মানজুর

সাতসকালে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট থেকে সোজা কমলাপুর স্টেশনে যান বেলাল হোসাইন। সঙ্গে ছোট ভাই রুবেল। উদ্দেশ্য মহানগর প্রভাতীতে করে চট্টগ্রামে যাওয়া। কমলাপুর স্টেশনের সাত নম্বর প্লাটফরম থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার কথা সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে। টিকিটের গায়ে এবং স্টেশনের ডিজিটালসূচি বোর্ডে তাই লেখা ছিল। সে হিসেবে গতকাল ভোর ৭টার আগেই বাক্স-পেটরা নিয়ে স্টেশনে হাজির দুই সহোদর। সকাল-দুপুর গড়িয়ে ঘড়ির কাঁটায় বিকাল ৩টা বেজে গেলেও স্টেশনে মহানগর প্রভাতীর কোন খোঁজ নেই! ডিজিটাল সূচিতেও উল্লেখ নেই ট্রেনটি ছাড়ার সম্ভাব্য সময়। অন্যদিকে হুইল চেয়ারে বসে অর্ধ পোড়া শরীর নিয়ে ছটফট করছিলেন বেলাল হোসাইন। তাই তো বার্ন ইউনিটের প্রেসক্রিপশন নিয়ে স্টেশন মাস্টার নিপেন্দ্র সাহার কাছে ছুটে এলেন উদ্বিগ্ন ভাই রুবেল। প্রেসকিপশন এগিয়ে দিয়ে বললেন, ভাইকে নিয়ে বার্ন ইউনিট থেকে এসেছি। গতকাল অগ্রিম টিকিটও কেটেছি। প্রভাতী এখনও আসেনি? ভাইয়ের অবস্থা ভাল না। এমন আবেদনে স্টেশন মাস্টার ওয়াকিটকি দিয়ে খোঁজ নিয়ে তৎক্ষণাৎ জানালেন, দুশ্চিন্তার কারণ নেই। প্রভাতী কিছুক্ষণ (সোয়া ৩টা) আগে এসেছে। তবে ধারাবাহিক শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে ইঞ্জিনস্বল্পতা আছে। সেজন্য ট্রেনটি ছাড়তে আরও ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে। অতঃপর গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে যায় প্রভাতী। অর্থাৎ শনিবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী মহানগর প্রভাতী ছেড়ে যেতে দেরি করে ১০ ঘণ্টা। শনিবার স্টেশন মাস্টার নিপেন্দ্র সাহা মানবজমিনকে বলেন, কোনভাবেই শিডিউল বিপর্যয়টা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না। প্রতিদিন এই স্টেশনে হাজারো মানুষ শিডিউল বিপর্যয়ে ভুগছেন। মানুষ হিসেবে আমিও সেটা উপলব্ধি করছি। কিন্তু কিছু তো করার নেই। স্টেশন মাস্টার হিসেবে মানুষের অভিযোগ শুনছি আর শিডিউল বিপর্যয় কমিয়ে আনার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। এদিকে কমলাপুর স্টেশনে সরজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত দুই মাসে শিডিউল জটিলতায় সবচেয়ে বেশি ভুগছেন উত্তরবঙ্গের যাত্রীরা। এসব অঞ্চলের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া একতা, লালমনি, দ্রুতযান এক্সপ্রেসের শিডিউল বিপর্যয়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। জানা যায়, এখনও এ অঞ্চলের প্রতিটি ট্রেনের মূল সময়সূচি থেকে ন্যূনতম ৫ থেকে ৮ ঘণ্টা বিলম্ব হয়। একই অবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটেও। তবে ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অঞ্চলের ট্রেনে শিডিউল বিপর্যয়ের হার কমে এসেছে অনেকাংশে। টানা প্রায় দুই মাসেও রেলসূচির বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের যাত্রী মোসলেম উদ্দিন (৫৫)। তিনি বলেন, রেলগাড়ি এখন মুড়ির টিন হয়ে গেছে। আমাদের সময়ের মূল্য নেই। সব তাদের খেয়ালখুশি। তিনি জানান, ময়মনসিংহে যাওয়ার জন্য শুক্রবার অগ্রিম টিকিট কেটেছেন স্টেশন কাউন্টার থেকে। শনিবার স্টেশনে সময়মতো এসে দেখেন তার টিকিট চট্টগ্রামের সুবর্ণ এক্সপ্রেসের! তাও আবার ৩রা জানুয়ারির পুরনো টিকিট। টিকিট দেখিয়ে তিনি বলেন, আমরা অশিক্ষিত গরিব বলে এমন প্রতারণা করবে? স্টেশন মাস্টার নিপেন্দ্র সাহা বলেন, রেলের সূচি একবার ভেঙে গেলে সেটাকে স্বাভাবিকে আনা খুব কঠিন কাজ। আমরা চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত। কিন্তু হরতাল-অবরোধ-সহিংসতা বন্ধ না হলে আমাদের তো কিছু করার নেই। স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক গতিতে রেল চলছে এখন। এর সঙ্গে স্লিপার খুলে রাখা, উপড়ে ফেলা আর পেট্রলবোমা আতঙ্ক তো রয়েছেই। ফলে রেলের স্বাভাবিক সূচি ও গতি ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনৈতিক সহিংসতা থামতে হবে। না হলে যাত্রী দুর্ভোগ আর আমাদের উদ্বেগ কমার সুযোগ নেই।

No comments

Powered by Blogger.