নোয়াখালীর এক শিল্পনগরে জমি নেই, অন্যটিতে শিল্প নেই by সুজয় মহাজন ও মাহবুবুর রহমান

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার একাংশ।
আর নোয়াখালী বিসিক শিল্পনগরে (ইনসেটে) অধিকাংশ প্লট খালি পড়ে আছে
৩ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নোয়াখালীতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) দুটি শিল্পনগর রয়েছে। একটি বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগর আর অন্যটি নোয়াখালী শিল্পনগর। প্রথমটির অবস্থান নোয়াখালীর চৌমুহনী চৌরাস্তা-সংলগ্ন মূল সড়কের পাশে। অন্যটি সোনাপুর জিরো পয়েন্ট থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এ দুই শিল্পনগরের মধ্যে ব্যবধান ১৫ কিলোমিটার।
জেলার দুই প্রান্তে দুই শিল্পনগর। আর তাতে স্পষ্ট বৈপরীত্য। একটিতে শিল্প স্থাপনের জায়গা চেয়ে পাচ্ছেন না শিল্পোদ্যোক্তারা। আর অন্যটিতে প্লট বরাদ্দ হলেও বছরের পর বছর তাতে কোনো শিল্প গড়ে উঠছে না। বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরের ৭৯টি শিল্পের মধ্যে উৎপাদনে বা সচল রয়েছে ৭২টি। আর নোয়াখালী বিসিক শিল্পনগরের ৬৪টি শিল্পের মধ্যে উৎপাদনে বা সচল রয়েছে মাত্র ২২টি।
একই জেলার মাত্র ১৫ কিলোমিটারের ব্যবধানে গড়ে ওঠা শিল্পনগরে কেন এ বৈপরীত্য, তার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ-স্বল্পতাই এর মূল কারণ। বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরে গ্যাস-বিদ্যুৎ শিল্পসহায়ক হলেও অন্যটিতে গ্যাসের যে চাপ, তা দিয়ে ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠা রীতিমতো দুরূহ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, নোয়াখালী শিল্পনগরটি এ এলাকার গ্যাস সরবরাহ লাইনের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। অর্থাৎ ওই শিল্পনগরের পর ওই এলাকায় আর গ্যাস-সংযোগ নেই। ফলে গ্যাসের চাপ খুব কম থাকে। সঞ্চালন লাইন পরিবর্তন করা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলেও মনে করছেন বিসিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বেগমগঞ্জ শিল্পনগরের কর্মকর্তা তপন কুমার মিত্র জানান, ১৯৮৪ সালে এ শিল্পনগরের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। ২৫ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এ শিল্পনগরে ১৩২টি শিল্প প্লট রয়েছে, যা ৭৯টি শিল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৭২টি শিল্প বর্তমানে সচল, তিনটি রুগ্ণ ও তিনটি নির্মাণাধীন রয়েছে। মামলার কারণে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে এখনো প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।
তপন কুমার মিত্র জানান, শিল্পনগরে এখনো শিল্প প্লটের বিপুল চাহিদা রয়েছে। সরকারের কাছে শিল্পনগর সম্প্রসারণের জন্য আবেদনও করা হয়েছে। কিন্তু জায়গা না থাকায় এলাকাটি সম্প্রসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সম্প্রতি সরেজমিনে বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরটি ঘুরে দেখা যায়, মাঝে একটি পুকুরকে কেন্দ্র করে চারপাশজুড়ে এটির অবস্থান। আর তাতে গড়ে উঠেছে স্থানীয় ও রপ্তানি বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনকারী ভারী, মাঝারি ও হালকা শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সরেজমিন পরিদর্শনকালে সেখানকার অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এটির বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
রেললাইনের স্লিপার, ফিশপ্লেটসহ রেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স অটোমোবাইলসের উৎপাদন ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ শিল্পনগরে পানি ও শিল্পের বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা, মানসম্মত পানির সমস্যা প্রকট। সে সঙ্গে রাস্তাঘাটগুলোও ভাঙাচোরা। ফলে প্রতিনিয়ত পণ্য পরিবহনসহ নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে এখানকার শিল্পমালিক ও শ্রমিকদের। তবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের তীব্র কোনো সমস্যা সেখানে নেই।
বেগমগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরের সবচেয়ে বৃহৎ শিল্প হলো গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস। নোয়াখালীতে উৎপাদিত প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দেশের বাজারে বিক্রির পাশাপাশি মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কায় রপ্তানি হয়। পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা হুমায়ূণ কবীর প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ থাকলেও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের চাপ নেই। তাই গ্যাসচালিত জেনারেটর দিয়েই উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিসিক কর্মকর্তারা জানান, এ শিল্পনগরের ছোট-বড় বিভিন্ন শিল্পে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
অন্যদিকে নোয়াখালী শিল্পনগরটি পরিদর্শনকালে দেখা যায়, সেখানে বেশির ভাগ শিল্পই এখনো চালু হয়নি। বরাদ্দ করা অনেক শিল্প প্লট খালি পড়ে আছে। আবার কোনোটিতে শিল্পের নামে শুধু স্থাপনা তৈরি হলেও শিল্পের কোনো কার্যক্রম নেই। কোনো কোনো শিল্প প্লটে গরু-ছাগল চরতেও দেখা গেছে। তবে এ নগরের সড়কের অবস্থা বেগমগঞ্জ শিল্পনগরের সড়কগুলোর চেয়ে উন্নত।
এ নগরের বিসিক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, ২০০৩ সালে ১৫ একর জায়গার ওপর এ শিল্পনগরের জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হয়ে শেষ হয় ২০০৭ সালে। এটির মোট ১০৭টি শিল্প প্লট ৬৪টি শিল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তার মধ্যে বর্তমানে সচল শিল্পের সংখ্যা ২২টি। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি শিল্প এখনো চালু হয়নি। ২৯টি শিল্প নির্মাণাধীন এবং মামলা ও বরাদ্দ বাতিলের কারণে ১৩টি শিল্প স্থাপনের কার্যক্রম স্থবির রয়েছে।
এ শিল্পনগরে সাত হাজার লোকের সম্ভাব্য কর্মসংস্থানের হিসাব ধরা হলেও সেখানে বর্তমানে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৪০০ লোকের। সেখানে বৃহৎ শিল্পের মধ্যে রয়েছে প্রিমিয়ার ফার্মা নামের একটি ওষুধ উৎপাদনকারী ও বাটন অ্যান্ড ট্রিমস নামের একটি বোতাম প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো মাঝারি মানের।
নোয়াখালী শিল্পনগরের হিমায়িত বা মৎস্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান ডলফিন সি ফুডের ব্যবস্থাপক রেদোয়ানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ নগরে গ্যাসের যে চাপ রয়েছে, তা দিয়ে শিল্প চালানো সম্ভব নয়। এ ছাড়া পানি ও বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থাটিও দীর্ঘদিন ধরে প্রায় অকেজো হয়ে আছে। সে কারণে এখানকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
ভরা মৌসুমে ইলিশ মাছ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তা সংরক্ষণ করে পরবর্তী সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি।

No comments

Powered by Blogger.