সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য -১৬৪ by ড. একেএম শাহনাওয়াজ

কলকাতার শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা পূর্ব বাংলার অনুন্নত ও অবহেলিত মুসলমানদের উন্নতির বিষয়টি সুনজরে দেখেননি। তারা জানতেন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে নবগঠিত প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা। এ অবস্থা কলকাতাবাসী ব্যবসায়ী, উকিল ও শিক্ষিত সমাজের স্বার্থবিরোধী হবে বলে মনে করা হয়। কলকাতায় অবস্থানকারী পূর্ব বাংলার জমিদাররাও বিলাসিতা ছেড়ে পূর্ব বাংলায় ফিরে যেতে উৎসাহী ছিলেন না। এসব কারণে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। হিন্দু নেতৃবৃন্দ তথা কংগ্রেসের বঙ্গভঙ্গবিরোধী কার্যক্রম মুসলমান নেতৃত্বকে চিন্তিত করে তোলে। তারা অনেকেই ভাবতে থাকেন, কংগ্রেস মুসলমানদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করছে না। এ কারণে তারা মুসলমানদের জন্য আলাদা রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার পদক্ষেপ নেন। এরই ফল ছিল মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা।
আলীগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসা মুসলমান নেতৃত্বের অনেকেই মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। যদিও পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে ইংরেজদের সঙ্গে মুসলমানদের দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের দীর্ঘদিনের রাজত্ব কেড়ে নেয়ায় তারা ইংরেজদের প্রধান শত্র“ বিবেচনা করে। যে কারণে ইংরেজ শাসন যুগে তারা ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। উনিশ শতকের কয়েকজন শিক্ষিত মুসলমান নেতা বুঝেছিলেন মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করে তুললে তারা জাতি হিসেবে অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। এদিকে দৃষ্টি রেখে নওয়াব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখ শিক্ষিত মুসলিম নেতা প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে মুসলমানদের এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। মুসলমানরা ইতিমধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা অর্জন করেছিল বলে ১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস গঠিত হলেও অনেক মুসলমান নেতাই এতে যোগ দেননি। অতঃপর ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে প্রেরণা দেয়।
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই মুসলিম লীগ গঠনের পটভূমি রচিত হয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত হিন্দু নেতৃবৃন্দই কংগ্রেস গঠন করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ সংগঠনের মধ্য দিয়ে তারা যেন সরকারের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নিতে পারে এবং ভারতে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে। এ সময় মুসলমান সমাজের কোনো কোনো শিক্ষিত নেতা বুঝেছিলেন, কংগ্রেসের মাধ্যমে মুসলমানের কোনো উপকার হবে না। তাই সর্বজন মান্য মুসলিম নেতা স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থে ভারতীয় মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ দিতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি আলীগড়ে একটি কলেজ স্থাপন করে একে কেন্দ্র করে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলন শুরু করেন, যা আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত। আলীগড় আন্দোলন মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নে যে ভূমিকা রেখেছিল, তার মধ্যেই মুসলিম লীগ গড়ার একটি প্রেরণা খুঁজে পাওয়া যায়।
বাংলার মুসলমানদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা। বাংলার অধিকাংশ মুসলমান পূর্ব বাংলায় বাস করে। কিন্তু শাসনকেন্দ্র কলকাতায় থাকায় নানা ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা ছিল অবহেলিত। তাই বঙ্গভঙ্গের সূত্রে ঢাকা পূর্ব বাংলার রাজধানী হলে এ অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হবে। এ কারণে পূর্ব বাংলার মানুষ, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা শুনে উল্লাস প্রকাশ করে। কিন্তু অচিরেই এই উল্লাসের বেলুন চুপসে যায়। কলকাতা কেন্দ্রিক কংগ্রেস ও অন্য হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ বাতিলের দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করে। এবার মুসলমান নেতৃত্ব বুঝতে পারেন, তাদের সম্প্রদায়ের অধিকারের দাবি সরকারের কাছে উত্থাপনের জন্য নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। এ পটভূমিতেই গঠিত হয়েছিল মুসলিম লীগ।

No comments

Powered by Blogger.