শান্তি নাকি অশান্তি! by মাসুদ রানা আশিক

ছোটবেলায় আমার একতরফা নিয়ন্ত্রণ ছিল টিভির রিমোটের ওপর। আমার নিয়ন্ত্রণ হরণের চেষ্টা কেউ করলেই বেধে যেত রাজ্যের সব কান্নার একযোগে আগমন। আমার কান্নার কারণেই মা আমার সঙ্গে পেরে উঠতেন না। তিনি কোনোভাবেই তার প্রিয় অনুষ্ঠান দেখতে পারতেন না। আমি শুধু দেখতাম ক্রিকেট। লাইভ হোক বা রিপিট, আমার ক্রিকেট খেলা দেখা চলবেই। শুধু আমার ছোট ভাই আমার পাশে বসে পিটপিট করে চেয়ে থেকে খেলা দেখত। সে কী বুঝত সেটা বড় হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পাইনি। বাবা যখন বাড়ি আসতেন, তখন আমার আর মায়ের মাঝে সংলাপের কথা বলতেন। তিনি বলতেন, 'সমস্যা তোমাদের মাঝে। আমি এর মাঝে নাক গলিয়ে কোনো ফায়দা হবে বলে মনে হয় না।' তিনি শুধু সংলাপের কথাই বলে যেতেন কিন্তু কে আগে সংলাপের ডাক দেবে, সে নিয়ে ছিল ঘোর অমানিশার মতো অন্ধকার।
আমি আমার অবস্থান থেকে ছাড় দিতে নারাজ। হঠাৎ একদিন আমার ছোট ভাই আমাকে এসে বলল, 'তাইয়া, তংলাপ হবে।' তারপর আমার ছোট ভাই আমার হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে মায়ের রুমে গেল। আমার আর মায়ের মাঝে শুরু হলো সংলাপ। বলাই যাই সেই সংলাপ ফলপ্রসূ হয়েছিল। আমি সংলাপে মাকে বলেছিলাম, 'এই সংলাপে আমি স্থিরচিত্তে দরাজ গলায় বলতে চাই, নিজের অবস্থান থেকে এক চুল নড়ে আমি শুধু লাইভ ক্রিকেট খেলার প্রতি নজর দেব।' এ সংলাপ ফলপ্রসূ হওয়ার ফলে মা শান্তিমতো তার প্রিয় অনুষ্ঠান দেখতে পারতেন। আমিও লাইভ ক্রিকেট খেলা দেখতাম।
ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে শান্তি এসেছিল। কিন্তু এখন, বিয়ের পর? আমার বিয়ের এখনও এক বছর অতিবাহিত হয়নি। তাতেই আমি মনে করছি সংলাপের প্রয়োজনীয়তা। আমার এখন মনে হয়, শুধু কি রাজনীতিতে? সাংসারিক, পারিবারিক বহু ক্ষেত্রেই সংলাপের প্রয়োজনীতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কে কীভাবে শোবে, সন্তানকে কে কখন কীভাবে দেখবে, কে মশারি টানাবে এসব বিষয়ে সংলাপের অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা আছে। ঘটনা হলো, আমার স্ত্রী হুদাই খরচ করে। সে কেমন পরিমাণ খরচ করে সেটা বলে বোঝানো কষ্টকর। সকালে একবার, বিকালে একবার তার মার্কেটে যাওয়া চাই। কিছু কিনুক আর না কিনুক মার্কেটে তার যেতেই হবে। নইলে পেটের ভাত হজম হবে না তার। তার এমন খরচে আমার পকেটে যে নিদারুণ করুণদশা হয়ে যাচ্ছে সেটা সে বুঝতেই চায় না। এমন পরিস্থিতিতে শরণাপন্ন হলাম আমাদের মহল্লার আজিজ ভাইয়ের কাছে। যে কি-না স্বঘোষিত সমাধান বিশারদ। তার সমাধান বিফলে গেছে বলে আমার জানা নেই। আজিজ ভাইকে সমস্যার কথা বলতেই বললেন, 'সংলাপ!' আমি শুনে একটু হতভম্ব হয়ে গেলাম। এখানেও সংলাপ। যেটা কি-না বর্তমান সময়ে হট অব দ্য বাংলাদেশ। আমি আজিজ ভাইকে বললাম, 'আজিজ ভাই, সংলাপের প্রয়োজন কেন। আমি তো এমনিতেই প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংলাপ করি।'
'থাম বাছা, অন্য বিষয় নিয়ে করলে তো হবে না। তোর পকেটের অবস্থা যে দিন দিন ফকির হওয়ার দিকে যাচ্ছে সে বিষয়ে সংলাপ হতে হবে। এটাই তো এখন সমস্যা ইন টু দি পাওয়ার ফোর।'
'তা আজিজ ভাই, চায়ের দাওয়াত দিয়ে কি সংলাপের ব্যবস্থা করা হবে নাকি আমি একাই এই সংলাপ বাড়িতে বসে করব?'
'গাধা! একা একা তুই সংলাপ করতে পারবি না। একজন মধ্যস্থতাকারী থাকতে হবে, আর আমি হবো সেই মধ্যস্থতাকারী!'
আমি আজিজ ভাইয়ের কথা শুনলাম, বুঝলাম এবং সেই অনুযায়ী কাজ করলাম। বউকে বললাম সংলাপ আয়োজনের কথা। শর্তযুক্ত সংলাপের কথা বলল আমার একমাত্র বউ রিনা। কিন্তু আমি নিঃশর্ত সংলাপের পক্ষে। অবশেষে কোনো প্রকার শর্ত-নিঃশর্তের বেড়াজালে বন্দি না থেকে সংলাপের আয়োজন করলেন আজিজ ভাই। সেটাও আবার তাদের বাড়িতেই। সামনে ধূমায়িত তিন কাপ চা। আমরা বসে আছি টেবিলের পাশে দুটো চেয়ারে। শুরু করলেন আজিজ ভাই, 'রিনা, আমি শুনলাম তুমি নাকি শুধু শুধু খরচ করে আমার ভাইটাকে ফকির হওয়ার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে চাইছ, যা আমার দৃষ্টিকোণ থেকে অনভিপ্রেত, সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। কারণ বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারে এত খরচ বেমানান, অতি বেমানান। তাই এই সংলাপ থেকে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, যাতে তুমি খরচটা একটু কমিয়ে দিয়ে আমার ভাইটাকে ফকির হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে। তা না হলে এক সময় দেখবে গৃহযুদ্ধ লেগে গেছে।'
কথা শেষ করতে পারলেন না আজিজ ভাই। শুরু করল রিনা, 'শোনেন আজিজ ভাই, যাই কিছু বলেন না কেন, তালগাছটা আমার। বউয়ের খরচ বহন করতে পারবে না, কিন্তু বিয়ে করতে পারবে এমন হিসাব মানা যায় না। এমন হিসাব করলে বিয়ে নামক যুদ্ধে না আসাই উচিত ছিল। আর একটা কথা বলি আজিজ ভাই, আপনারে দিয়া সে এই সংলাপের আয়োজন করেছে। আজ বাসায় এমনিতেই গৃহযুদ্ধ লাগবে। আজ বোঝাব কত সংলাপের কত ঝাল।' আর কথা বলল না রিনা। গটগট করে হেঁটে চলে গেল। আমি তাকালাম আজিজ ভাইয়ের দিকে। আজিজ ভাইও কোনো সদুত্তর না পেয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। সংলাপের আয়োজন করে সংসারে আরও বড় কোনো অশান্তি ডেকে আনলাম কি-না বুঝতে পারলাম না।

No comments

Powered by Blogger.