মুক্তি মেলেনি নেপালের ‘শ্রমদাস’ কৃষকদের

ভূস্বামীর জমিতে হাল দিচ্ছেন হীরালাল পারিয়ার l ছবি: এএফপি
নেপালে কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা দাসশ্রমের প্রথাকে ২০০৮ সালে নিষিদ্ধ করেছিল মাওবাদী সরকার। সেই সঙ্গে এই মানবেতর প্রথার ভুক্তভোগী শ্রমদাসদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। হীরালাল পারিয়ারের মতো শ্রমদাসরা মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন এতে। তবে আজ সাত বছর হতে চলল, সেই ক্ষতিপূরণ আর মেলেনি। গৃহহীন, নিঃস্ব পারিয়ারের মতো অনেককে আবার তাদের পুরোনো ভূস্বামীদের শ্রমদাসে পরিণত হতে হয়েছে। ৩৮ বছর বয়সী হীরালাল পারিয়ার বলছিলেন, ‘সাত বছরে কিছুই পাল্টায়নি। সেই জন্মের সময় থেকে আজ পর্যন্ত এ জীবন জমিদারের হাতেই বাঁধা।’ নেপালে এ রকম ভূমিহীন শ্রমদাসদের ‘হালিয়া’ বলা হয়। এর অর্থ যে হাল বয় বা কৃষক। ২৪০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসানের পর ২০০৮ সালে নেপালে সাবেক বিদ্রোহী মাওবাদীদের নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। মাওবাদী সরকার শত শত বছরের অসাম্য অবসানের ঘোষণা দেয়। সে বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে নিষিদ্ধ করা হয় দাসশ্রম প্রথা। সেই সঙ্গে একটি নতুন সংবিধান তৈরির মাধ্যমে সার্বিক পরিবর্তনের অঙ্গীকারও করা হয়। তবে আজ পর্যন্ত সেই সংবিধান পায়নি দেশটির মানুষ। কয়েক বছর ধরে সংবিধানের জন্য দেশটির আইনপ্রণেতারা দর-কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছেন। তা ছাড়া বিভিন্ন সময় একাধিক সরকার হালিয়াদের ক্ষতিপূরণ ও জমির মালিকানা দেওয়ার কথা বললেও এসব অঙ্গীকারের কোনোটিই পূরণ হয়নি।
কঠিন শ্রমে কড়া পড়া হাতের আঙুল আর ব্যথায় টনটন করা কাঁধ হীরালাল পারিয়ারকে জোয়াল বওয়ার কষ্ট ভোলার অবকাশ দেয় না। ছয় প্রজন্ম ধরে শ্রমদাস তাঁর পরিবার। মাত্র ১৩ বছর বয়সে মালিকের জমিতে কাজ শুরু করেছিলেন। দৈনিক সেই কাজ চলত ১৫ ঘণ্টা।
হীরালাল বলেন, ‘আমরা যেন মালিকের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি। আমার দাদু ওদের কাজ করেছে, বাবা করেছে, এখন আমি করছি।’
হালিয়ারা নেপালি সমাজে অস্পৃশ্য, তথাকথিত নীচু জাতের মানুষ। দলিত এই মানুষদের উঁচু শ্রেণির মানুষের ঘর বা মন্দিরে ঢোকা নিষেধ। উঁচু জাতের মানুষ এমনকি তাদের গৃহপালিত পশুগুলো যেখান থেকে পানি খায়, সেখান থেকে পানি নেওয়ায় বারণ হালিয়াদের।
উত্তর-পশ্চিম নেপালের প্রত্যন্ত গ্রাম বারাউনসিকে থাকেন হালিয়া গৃহবধূ ননি বিশ্বকর্মা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলছিলেন, ‘উঁচু জাতের মানুষের কাছে আমাদের কদর কেবল আমরা যখন ওদের কাজ করে দিই। এ ছাড়া ওরা আমাদের দিকে ফিরেও চায় না।’
ভাগ্যবঞ্চিত হালিয়াদের মধ্যে এক বিরল ব্যতিক্রম পর্বত সুনার। ব্যতিক্রম এ জন্য যে চরমবঞ্চিত এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। হালিয়াদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করছেন পর্বত। তিনি বলেন, ‘এ দেশের সব আইন উঁচু জাতের মানুষের স্বার্থে তৈরি। সব জমিও তাদের। হালিয়াদের কিছুই নেই।’
২০০৬ সালে মাওবাদীদের সঙ্গে সরকারের সঙ্গে যখন শান্তিচুক্তি হয়, তখন একটি শর্ত ছিল, বৈজ্ঞানিক ভূমি সংস্কার হবে। অবসান হবে সামন্ততন্ত্রের।
পর্বত সুনার জানান, এ পর্যন্ত ১৯ হাজার হালিয়ার মধ্যে মাত্র ৮০টি পরিবার সরকারের কাছ থেকে জমি পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘দেশের আইনপ্রণেতাদের দিকে আমরা বড় আশা করে তাকিয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম ওঁরা সত্যিই এক নতুন নেপাল গঠন করবেন। কিন্তু ওঁরা আসলে কিছুই করেননি।’ সূত্র : এএফপি।

No comments

Powered by Blogger.