হরতাল সাহেব মারা গেছেন! by মনজুরুল হক

মৃত্যুর সংবাদ সর্বদা বেদনাদায়ক নয়। বাংলাদেশে হরতাল সাহেবের যে মৃত্যু, সেই সত্য আবারও আমাদের সামনে প্রতিভাত হলো। আর হরতাল সাহেবের এই মৃত্যুর জন্য যে টোটকা চিকিৎসক এর চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন, সেই সালাহউদ্দিন আহমদকেও অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয় বাংলাদেশকে হরতাল নামের এক অভিশাপ থেকে মুক্ত করার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায়। আমার  মনে হয় না, জুতসই একটি রাজনৈতিক অস্ত্রের এতটা ঢালাও অপপ্রয়োগে তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা নিয়োজিত না থাকলে এতটা সহজে হরতাল সাহেবের খপ্পর থেকে আমরা মুক্ত হতে পারতাম। হরতাল যে দাবি আদায়ের শেষ অস্ত্র, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে সেই দাবি আদায়ের প্রক্রিয়া জনতা এর সঙ্গে যুক্ত থাকলেই কেবল গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, অন্যথায় নয়। এই সত্য যাঁদের জানা নেই, হরতাল তাঁদের কাঁচা হাতের খেলায় এমন ভোঁতা অস্ত্র হয়ে ওঠে, জনগণের অধিকার আদায়ের বদলে যা কিনা নাগরিক জীবনকে করে তোলে অতিষ্ঠ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ও এর সূত্র ধরে হরতালের মৃত্যু সেই ধ্রুব সত্যকেই নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করে দিল। আর তাই আশা করা যায় যে অর্থহীন হরতালের তিক্ত যন্ত্রণা থেকে আমাদের সমাজ আর অর্থনীতি এখন মুক্ত হয়ে আবারও সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশে হরতালের মতো আত্মঘাতী পথ অবলম্বন করা কতটা বাস্তবসম্মত, সেটা চিন্তা করে দেখার উপযুক্ত সময় মনে হয় এখন উপস্থিত। বিশ্বায়নের কথা যাঁরা বলে বেড়ান, বিশ্বের দিকে আরেকটু ভালোভাবে নজর দিলে হরতালের এই আত্মঘাতী দিক এবং সে কারণে বিশ্বজুড়ে সেই পথে রাজনীতিবিদদের পা না বাড়ানো তাঁরা নিশ্চয় আরেকটু ভালোভাবে অনুভব করতে সক্ষম হবেন।
প্রথমেই যে বিষয়টি হরতাল-সমর্থকদের বিবেচনা করে দেখা দরকার, তা হলো মানবাধিকারের সংজ্ঞার দিক থেকে হরতাল কতটা গ্রহণযোগ্য। সর্বজনীন মানবাধিকারের যে সনদ জাতিসংঘ অনুমোদিত এবং বিশ্বের সব কটি দেশে স্বীকৃত, সেই সনদের ১৩ নম্বর ধারার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
রাষ্ট্রীয় সীমানার ভেতরে প্রত্যেক মানুষের চলাচল ও বসবাসের স্বাধীনতা রয়েছে।
মানবাধিকার সনদের এই ধারার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হলে হরতাল আমাদের অবশ্যই বর্জন করা দরকার। আমার চলাচলের স্বাধীনতার ওপর প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করিয়ে দেওয়ার অধিকার হরতাল আহ্বানকারীর আছে কি? মানবাধিকারের সংজ্ঞা তো সেই অধিকার তাকে দেয় না।
তার পরও কেন হরতাল? পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এভাবে বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত গায়ের জোরে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার নজির নেই। উন্নত বিশ্বের কথা আমরা নাহয় বাদই দিলাম, কেননা সেখানে সে রকম কিছু একটা কেউ করতে গেলে আইনের মারপ্যাঁচে তার বা সেই গোষ্ঠীর কুপোকাত হয়ে পড়া অবধারিত। শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে শ্রীঘরবাসের ব্যবস্থাও এর মধ্য দিয়ে তাদের জন্য হয়ে যাবে। উন্নত সেই বিশ্বের বাইরে নজর দিলেও খুব বেশি দৃষ্টান্ত খুঁজে বের করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এর আরেকটি কারণ বিশ্বায়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
বিশ্বের কোনো দেশের অর্থনীতিই এখন আর আগের মতো সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির চাকা অবিরাম সচল থাকার মুখে নিজের দেশে সেই চাকা বন্ধ করে দেওয়া অন্যের জন্য যতটা না ক্ষতিকর, নিজের জন্য সেই ক্ষতির মাত্রা হচ্ছে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি। হরতালের মধ্য দিয়ে যেনতেন উপায়ে অধিকার আদায় করে নেওয়া সম্ভব হলেও সেই ক্ষতি কোনো অবস্থাতেই পুষিয়ে নেওয়ার নয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে বিদেশের ক্রেতাদের ইদানীংকার ভাবনাচিন্তা তো সে কথাই বলে। উন্নত বিশ্বের তৈরি পোশাকের বাজার ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। শীত মৌসুম শেষ হয়ে আসার আগেই বসন্তের নতুন ডিজাইনের সাজ-পোশাকে দোকান সাজিয়ে নিতে না পারলে দোকানির লোকসানের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। যে মৌসুমে দুই মাসের টানা হরতালের খপ্পরে আমরা পড়ে গেছি, সেটা হচ্ছে পাইকারদের বসন্তের পণ্য সরবরাহ পাওয়ার মৌসুম। জটিল অঙ্কের হিসাব নয়, বরং সাধারণ যুক্তি বলে দেয় যে হরতাল আর অবরোধে যোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে পড়লে পশ্চিমের পাইকারেরা হরতাল শেষ হওয়ার অপেক্ষায় না থেকে যে দেশ হরতালমুক্ত অবস্থায় সরবরাহ দিতে সক্ষম, সেই দেশের দিকে ঝুঁকে পড়বে। মূল্য এ ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি দিতে হলেও আপত্তি তাদের নেই। বাস্তবেও ঘটছে কিন্তু তা–ই।
জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে টোকিওতে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের বেশ কিছু পোশাক ও চামড়াশিল্পের প্রতিষ্ঠান যোগ দিয়েছিল। তবে জাপানি পক্ষের সাড়া সেখানে ছিল খুবই সতর্কতামূলক। এর কারণ এই নয় যে বাংলাদেশে তৈরি পণ্যের মান নিয়ে তারা অসন্তুষ্ট। বরং কারণটি ছিল সেই একই উদ্বেগ, অর্থাৎ রাজনৈতিক টালমাটালে মৌসুম ধরতে পারা আমদানিকারকদের পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে দেখা দেওয়া দুর্ভাবনা। এ রকম এক সময়ে সেটা ঘটেছে, যার মাত্র কিছুদিন আগে জাপানের বৈদেশিক বাণিজ্য সংগঠন জেট্রো বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনার ওপর প্রকাশিত একটি বইয়ের শিরোনামে উল্লেখ করেছিল, ‘এখনই সময়’, যার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সক্রিয় হয়ে ওঠা বিনিয়োগ পরিবেশের সুযোগ নিতে হলে জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য এটাই হচ্ছে সঠিক সময়। আমরা জানি, এর ঠিক পর পর শুরু হয়ে যায় টানা হরতাল, যার মধ্য দিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে সেই বিনিয়োগ পরিবেশের অনেকটাই আমরা এখন নষ্ট করে দেওয়ার পথে রয়েছি।
সহজ এই বিষয়টি আমরা বুঝতে না পারলেও বিদেশে অনেকেই কিন্তু সেটা বুঝতে পারছেন এবং বুঝতে পারছেন বলেই বাংলাদেশের জন্য একধরনের বেদনাও তাঁরা বোধ করছেন। বাংলাদেশকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসেন সে রকম একজন বিদেশি হলেন জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাৎসুশিরো হোরিগুচি। জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় এক দশকের বিরতিতে বাংলাদেশ সফর করেন তিনি। সেটা ছিল হরতাল আর অবরোধের সময়। জাপানে ফিরে এসে ছোট একটি নিবন্ধ তিনি লিখেছিলেন টোকিওতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করার জন্য। গত এক দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি যে চোখে পড়ার মতো, তার উল্লেখ করে সেখানে তিনি বলেছেন:
‘বাংলাদেশে থাকা অবস্থাতেই যে ভাবনা একসময় আমার মাথায় এসেছিল তা হলো, মাতৃভাষার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতাসংগ্রাম পর্যন্ত যে লাখ লাখ মানুষ তাঁদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, স্বাধীন দেশ হিসেবে গত ৪৪ বছরের অগ্রগতিকে তাঁদের আত্মা কীভাবে দেখবেন। আমার ভাবতে ইচ্ছা করে যে এঁদের প্রায় সবাই জনতার কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে অর্জিত অগ্রগতিতে সন্তোষ বোধ করলেও তাঁরা হয়তো এ রকমও ভাববেন যে এত বেশি জীবনের মূল্যের বিনিময়ে পাওয়া দেশটি হয়তো আরও একটু এগিয়ে যেতে পারত। তাঁরা হয়তো এ রকমও ভাববেন যে সেই অর্জন অবশ্যই সম্ভব হতো, রাজনৈতিক দলগুলো যদি একে অন্যের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে হরতাল, নাগরিকদের জীবনহানি, সম্পদ ধ্বংস করা, অর্থনীতির ক্ষতিসাধন ও পথচারীদের সুখী জীবন বাধাগ্রস্ত করায় জড়িত না হতো।’
নিজেদের পায়ে সমানে কুঠারাঘাত করে যাওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলো রাজনীতির চোখ ধাঁধানো চমকে আমাদের চোখে না পড়লেও বাংলাদেশের দিকে ভালোবাসার চোখ মেলে তাকানো বিদেশিরা কিন্তু তা ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন। ফলে মানবাধিকার বলুন আর অর্থনীতির হিসাব-নিকাশই বলুন, কোনো দিক থেকেই দেশের উপকারে আসার মাধ্যম হরতাল হতে পারে না। সংকীর্ণ ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থই কেবল এর মধ্য দিয়ে উদ্ধার হতে পারে এবং শুধু সেটুকুই।
আসুন, হরতালের মৃত্যুতে তাই কেবল আনন্দ অনুভব করাই নয়, বরং একই সঙ্গে সে রকম শপথও আমরা নিই যে মৃত হরতালের প্রেতাত্মা পুনর্জন্ম লাভ করে আবারও যেন ফিরে আসতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা সজাগ থাকব। যত দিন আমরা পরাধীন ছিলাম, নিজেদের অস্তিত্বের লড়াই যত দিন আমাদের চালিয়ে যেতে হয়েছে, হরতালের গ্রহণযোগ্যতা তখন সার্বিক জনসম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে
স্বীকৃতি পেলেও স্বাধীন দেশে জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় সেই কৌশলের প্রয়োগ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকে নিজের ক্ষতি ডেকে আনাই নয়, একই সঙ্গে তা হচ্ছে মানুষের স্বীকৃত অধিকারকেই অপমানিত করা। রাজনৈতিক অধিকারের নামে হরতালে যাঁরা সায় দিচ্ছেন, এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে তাঁরাও উপকৃত হবেন এবং বিদেশি অর্থের চালান আসার অপেক্ষায় প্রহরও তাঁদের গুনতে হবে না।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷

No comments

Powered by Blogger.