মাছের দেখা নেই : ডলফিন লাপাত্তা

সুন্দরবনের শ্যালা নদী ও বনের অভ্যন্তরের শাখা খাল থেকে সনাতন পদ্ধতিতে তেল অপসারণের অভিযান শুরু করেছে বন বিভাগ। শনিবার সকাল ৮টা থেকে এ অভিযান শুরু হয়। এতে শতাধিক নৌকা নিয়ে দুই শতাধিক স্থানীয় জেলে ও গ্রামবাসী অংশ নিয়েছেন। এ পর্যন্ত ১০ হাজার লিটার তেল অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে বলে জানা গেছে। তেল ট্যাংকারডুবির ঘটনায় রোববার আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডাকা হয়েছে। ট্যাংকারডুবির ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ১৮ ডিসেম্বর তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়া হবে। এছাড়া তেল নষ্ট করতে আসা জাহাজ কাণ্ডারি থেকে যে তরল রাসায়নিক পদার্থ ছিটানো হবে তাতে পরিবেশের ক্ষতি হবে কিনা তা যাচাইয়ে বুয়েটে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
শ্যালা নদী দিয়ে সব ধরনের পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে মংলা বন্দরের ওপর। বন্দরের বহির্নোঙরে থাকা বাণিজ্যিক জাহাজের খালাস ও বোঝাই কাজে লাইটারেজ সংকট দেখা দিয়েছে। পশুর চ্যানেলের বহির্নোঙরে সার ও ক্লিংকারসহ পণ্যবাহী ১০টি বাণিজ্যিক জাহাজ অবস্থান করছে। শ্যালা নদীর শরণখোলা এলাকায় আটকে পড়েছে ২শরও বেশি পণ্যবাহী নৌযান। পর্যাপ্ত কার্গো না থাকায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
শেষ খবর অনুযায়ী ফার্নেস অয়েল শ্যালা, পশুর, বলেশ্বর ও শিবসা নদী ছাড়িয়ে বঙ্গোপসাগরে ছড়িয়ে পড়ছে। তেল ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ এলাকায় মাছের দেখা মিলছে না। এছাড়া ৫ দিন ধরে কোথাও ডলফিনের দেখা মেলেনি। মাছ ধরতে না পেরে বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় ৩০ হাজার জেলে। তেলের কারণে তাদের জাল নষ্ট হয়ে গেছে। আর এখন পেটের দায়ে তারা তেল অপসারণের কাজে লেগেছেন।
এদিকে সুন্দরবনের ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে বিপর্যয়ের মুখে বিআইডব্লিউটিএ সুন্দরবনের সুপতি-কচিখালী নদী দিয়ে নতুন করে নৌযান চলাচলের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। রোববার এ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
অন্যদিকে সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে শনিবার এক মানববন্ধনে অভিযোগ করা হয়েছে, শ্যালা নদীতে ডুবে যাওয়া ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ ট্যাংকারটি আসলে একটি বালুবাহী কার্গো ছিল। পরবর্তীকালে বিধি লংঘন করে সেটি ট্যাংকারে রূপান্তর করা হয়েছে।
যুগান্তরের খুলনা ব্যুরো অফিস থেকে মো. হেদায়েৎ হোসেন, বাগেরহাট থেকে শওকত আলী বাবু, মংলা থেকে আমির হোসেন আমু ও শরণখোলা থেকে বাবুল দাস জানান-
বাগেরহাট : শনিবার সকালে সুন্দরবনের শ্যালা নদীসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কালো তেলের ছপছপে চিহ্ন দেখা গেছে। তেলের কারণে নদীতে মাছের দেখা নেই। তেলে জাল নষ্ট হয়ে যাওয়া ও মাছ না থাকায় জেলেরা মাছ ধরতে পারছে না। বেকার হয়ে পড়া জেলেরা এখন পাল্লা দিয়ে নদীর ভাসমান তেল তুলতে শুরু করেছে। বিক্রি করছে ৩০ টাকা লিটারদরে। শ্যালা, পশুর, বলেশ্বর ও শিবসা ছাড়িয়ে তেল চলে গেছে বঙ্গোপসাগরে। যতদূর তেল গড়িয়েছে ততদূরের নদী-খালে মাছের কোনো দেখা মিলছে না। মংলার জয়মনিসহ আশপাশের উপকূলের মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা। তেলের কারণে অনেকের জাল নষ্ট হয়ে গেছে। মাছ না থাকায় বাকিরাও নদীতে নামছে না। এতে সুন্দরবননির্ভর অন্তত ৩০ হাজার জেলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বন বিভাগের পাস-পারমিট নিয়েও অনেকে যাচ্ছেন না বনে। ফলে জেলে পরিবারেও চরম অভাব দেখা দিয়েছে। সুন্দরবনের বনের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, এ রেঞ্জে বর্তমানে জেলেদের পাস-পারমিট ও রাজস্ব আয় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তিনি জানান, বনের নদী ও খালের তেল-তেলের বর্জ্য অপসারণে বন সংলগ্ন স্থানীয় গ্রামবাসী ও জেলেদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া মিলেছে। জনপ্রতি ৪শ টাকা করে মজুরি দেয়া হচ্ছে তাদের। যতদিন প্রয়োজন ততদিন চলবে বন বিভাগের এ শুদ্ধি অভিযান।
খেটে খাওয়া এ মানুষগুলো এখন নিরুপায় হয়েই টাকার লোভে নদী থেকে তেল সংগ্রহ করছে। এখানকার অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশু নেট জাল এবং ফোম দিয়ে তেল সংগ্রহ করছে। আর এ তেল কেনার জন্য পদ্মা অয়েল ডিপো কয়েকটি কেন্দ্র খুলেছে। কেন্দ্রগুলো ৩০ টাকা লিটারে এ তেল কিনে নিচ্ছে। স্থানীয় লোকজনকে তেল আহরণে উদ্বুদ্ধ করতে চলছে মাইকিং। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার লিটার সংগ্রহ করেছে কর্তৃপক্ষ।
আবারও সুন্দরবনের ভেতরে নৌরুট : সুন্দরবনের শ্যালা নদীর ভেতর দিয়ে চলা অবৈধ নৌরুটে অয়েল ট্যাংকারডুবির পর ওই রুটটি বন্ধ করে দেয় বিআইডব্লিউটিএ। অয়েল ট্যাংকার ডুবে সুন্দরবনের ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ায় মহাবিপর্যয়ে পড়েছে সুন্দরবন। এ অবস্থার মধ্যে বিআইডব্লিউটিএ সুন্দরবনের সুপতি-কচিখালী নদী দিয়ে নতুন করে নৌযান চলাচলের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। রোববার এ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। শনিবার সুন্দরবন পরিদর্শন শেষে জয়মনি এলাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী এ তথ্য জানান।
পাঁচ দিনেও দেখা মেলেনি ডলফিনের : কয়েক বছর আগেও প্রাণিবিজ্ঞানীদের কাছে ইরাবতি ছিল হারিয়ে যাওয়া ডলফিন। সুন্দরবনে শ্যালা নদীতে মঙ্গলবার ফার্নেস অয়েল বোঝাই ট্যাংকারডুবির পর তেল ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। মঙ্গলবার থেকে শ্যালা নদীতে ডলফিনের অভয়াশ্রমে আর দেখা মিলছে না ইরাবতিসহ ৬ প্রজাতির ডলফিনের। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, ইরাবতিসহ সুন্দরবনের ৬ প্রজাতির ডলফিন খুবই স্পর্শকাতর। তারা যখন বুঝেছে তাদের অভয়াশ্রম আক্রান্ত হয়েছে তারা দ্রুতই স্থান ত্যাগ করেছে এমনটিই মনে হচ্ছে। গত ৫ দিনে শ্যালা নদীসহ তার আশপাশের কোথাও কেউ ডলফিনের দেখা পায়নি।
শ্যালা রুট বন্ধে বিআইডব্লিউটিএকে ৩ বছরে ৭টি চিঠি : সুন্দরবনের শ্যালা নদী দিয়ে নৌচলাচল বন্ধ করতে সুন্দরবন বিভাগ গত ৩ বছরে ৭ বার চিঠি দেয় বিআইডব্লিউটিএকে। সুন্দরবন বিভাগের ওই সব চিঠিতে জাহাজ চলাচলে শ্যালা নদীতে বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতি ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিনের অভয়াশ্রম ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য বা ইকো সিস্টেমে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে বলা হয়। সুন্দরবনকে বাঁচাতে ২০১১ সালের ২১ আগস্ট থেকে ৩ বছরে এসব চিঠিতে কর্ণপাত না করে অবৈধভাবে জাহাজ চলাচল অব্যাহত রাখে বিআইডব্লিউটিএ। এ তথ্য জানিয়েছেন পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও আমির হোসাইন চৌধুরী।
সংকটে সুন্দরবনের ৩৫ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ : সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছটিয়ে থাকা ৫০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের মধ্যে ৩৫টি প্রজাতি রয়েছে আমাদের সুন্দরবনে। তবে সুন্দরবনের থাকা ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালার মধ্যে মাত্র ৩৭ প্রজাতিই ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদ। সুন্দরবনে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনে বাংলাদেশ অংশে স্থলভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার। আর ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খাল নিয়ে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার। অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ চুরির কারণে ৩৭ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ১৪৪ কিলোমিটার। সুন্দরী গাছ কমেছে ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
মংলা : শনিবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে বন বিভাগের উদ্যোগে সনাতন পদ্ধতিতে তেল অপসারণের কাজ। সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমির হোসেন চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মংলা বন্দরে আমদানি-রফতানি ব্যাহত : বন্দর সূত্র জানায়, বর্তমানে শ্যালা নদীর দুপ্রান্তে আটকে আছে ২ শতাধিক নৌযান বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম মাস্টার। বন্দর ব্যবহারকারী স্টিভিডরস মেসার্স নূর অ্যান্ড সন্সের মালিক এইচএম দুলাল জানান, সুন্দরবনের শ্যালা নদীর নৌরুট বন্ধ থাকায় বন্দরের বাণিজ্যিক জাহাজের খালাস বোঝাই কাজে লাইটারেজ (বার্জ-কার্গো) পাওয়া যাচ্ছে না।
সুন্দরবন রক্ষায় খুলনা ও শরণখোলায় মানববন্ধন : সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে শনিবার খুলনায় পৃথকভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলন, পরিবেশ বাঁচাও, জনউদ্যোগ খুলনার আহবানে এ কর্মসূচি পালিত হয়। সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলনের আহবানে মানববন্ধন চলাকালে আয়োজিত সমাবেশে বক্তৃতা করেন এম নূরুল ইসলাম দাদু, মনিরুজ্জামান মনি, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সাহারুজ্জামান মোর্তজা, সেকেন্দার আলী ডালিম, শফিকুল আলম মনা, রেজাউল করিম, শেখ মোশাররফ হোসেন, আমির এজাজ খান প্রমুখ।
পরিবেশ বাঁচাও ও জনউদ্যোগ খুলনার আহবানে বিকালে পিকচার প্যালেস মোড়ে আয়োজিত মানববন্ধন চলাকালে সমাবেশে বক্তৃতা করেন পরিবেশ বাঁচাওয়ের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু নাসের খান, ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, শ্যামল সিংহ, মোমিনুল ইসলাম, শামীমা সুলতানা শীলু, এসএম সোহরাব হোসেন, শেখ সাদী ভুঁইয়া, আবদুল হাকিম প্রমুখ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন কুদরতই খুদা।
সুন্দরবনের অভ্যন্তর রুট দিয়ে জাহাজ চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ, ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া তেল দ্রুত অপসারণ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দাবিতে শনিবার দুপুরে এদিকে বাগেরহাটের শরণখোলায় মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুন্দরবন সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি (আইপ্যাক) শরণখোলা রেঞ্জের উদ্যোগে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কে অনুষ্ঠিত এ কর্মসূচিতে সুশীল সমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক, উন্নয়ন কর্মীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধন শেষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য দেন সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সহ-সভাপতি ও রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন, সুন্দরবন রক্ষা কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম, মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান ফরাজী ও পিপলস ফোরামের সভাপতি তুহিন বয়াতি প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.