দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ ক্ষতি

সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে দুর্ঘটনাকবলিত অয়েল ট্যাংকার ‘সাউদার্ন স্টার-৭’ এ মজুদ থাকা সাড়ে তিন লাখ লিটার তেলই ভেসে গেছে। সেখানকার নদীগুলোর তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে এই ফার্নেস অয়েল। সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় পাঁচ দিন ধরে পানিতে তেল ভাসায় জলজ ইকোসিস্টেম আক্রান্ত হয়েছে। এতে অতিক্ষুদ্র জীবগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এগুলো খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না বলে এই মুহূর্তে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর বিরূপ প্রভাব উদ্ভিদ, জলজ প্রাণী ও পশুপাখির ওপর পড়বে বলে আশংকা বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আপাত দৃষ্টিতে বুঝা না গেলেও ভবিষ্যতে ডলফিন, কুমীর, বাঘ, হরিণসহ অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাবে না। ওই এলাকায় বসবাসকারী প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা কমে যাবে। নদীর দুই তীরের ২০০ গজ পর্যন্ত এলাকার গাছ-গাছালি আক্রান্ত হবে। তারা জানান, ইন্দোনেশিয়া, পানামা, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে দুর্ঘটনায় তেল ছড়িয়ে পড়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। দ্রুত ওইসব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু সুন্দরবনের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনে এত বড় ঘটনা ঘটলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো পাঁচ দিনেও তেল অপসারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। দুর্ঘটনা তদন্তে গঠিত নৌমন্ত্রণালয়ের কমিটির আহ্বায়ক মো. নুর-উর রহমান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, তেলবাহী ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ জাহাজকে অন্য আরেকটি নৌযান এমটি টোটাল ধাক্কা দেয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। আঘাতকারী নৌযানটি সাইড থেকে বাড়ি মেরে ওপরে উঠে গিয়েছিল। এতে সাউদার্ন স্টার-৭ নৌযানের চেম্বার ফেটে সব তেল বেরিয়ে গেছে।
সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর সূত্র জানায়, ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ জাহাজটিতে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৮ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল। আর বন অধিদফতর জানিয়েছে, সুন্দরবন অভ্যন্তরে আনুমানিক তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ বর্গকিমি এলাকায় এই ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সাউদার্ন স্টারের মালিক আমির হোসেন ফরিদ যুগান্তরের কাছে দাবি করেছেন, দুর্ঘটনায় ছয়টি চেম্বারের চারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দুটি অক্ষত রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। মঙ্গলবার ভোররাতে শ্যালা নদীতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনাকবলিত ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ জাহাজ উদ্ধার করা হয়েছে।
নদীতে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ার ক্ষতিকর দিক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, ফার্নেস অয়েল তেলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর তেল। বিটুমিনের পরই ফার্নেস অয়েলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর কেমিক্যাল রয়েছে। তবে সুন্দরবনে ডুবে যাওয়া ফার্নেস অয়েল পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য ক্রয় করায় এই তেলের ক্ষতিকর অংশ বেশি থাকবে না। কিন্তু দির্ঘমেয়াদি এর ক্ষতির প্রভাব পড়বে বলে তিনি জানান। তার মতে যদি পেট্রল কিংবা অকটেন হতো তাহলে কোনো ক্ষতি হতো না। এমনকি ডিজেল হলেও ক্ষতি বেশি হতো না। এতদিনে উড়ে যেত। কিন্তু ফার্নেস অয়েল ভারি হওয়ায় এই তেল উড়ে না গিয়ে পানিতে ভেসে রয়েছে। এই অবস্থায় পানির নিচে থাকা মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীরা অক্সিজেন পাচ্ছে না। যার কারণে দীর্ঘ মেয়াদে এসব প্রাণীর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি এই তেল অপসারণে অবিলম্বে আমেরিকার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। তার মতে একমাত্র আমেরিকা ছাড়া অন্য কোনো দেশে এ ধরনের বিপর্যয় এড়ানোর মতো যন্ত্রপাতি নেই। অধ্যাপক ইজাজ হোসেন জানান, ফার্নেস অয়েলও বাতাসে উড়ে যায়। কিন্তু তাতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে।
ত্বরিত তেল অপসারণ করতে না পারায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. সাব্বির মোস্তফা খান যুগান্তরকে বলেন, ম্যানগ্রোভ এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ পদক্ষেপ না নেয়ায় জোয়ার-ভাটায় আশপাশের নদী-নালাসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে কেমিক্যাল পাউডার ছিটিয়ে তেল নষ্ট করে দেয়া হয়। কিন্তু সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কেন এমন পদক্ষেপ নেয়া হল না তা বোধগম্য নয়। সরকারের আদৌ এমন প্রস্তুতি আছে কিনা তা জানি না। তবে ভালো দিক হচ্ছে, ছিটিয়ে থাকা তেল কেনা হচ্ছে। এতে গ্রামবাসী তেল সংগ্রহে আগ্রহী হয়েছে। সুন্দরবনের ওপর ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, পাঁচ দিন তেল ছড়িয়ে পড়ায় পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাবে। এতে সুন্দরবনের ওপর দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
দীর্ঘমেয়াদে ক্ষয়ক্ষতি : সুন্দরবনের নদীগুলোতে পাঁচ দিন ধরে তেল ভাসতে থাকায় এবং জোয়ার-ভাটায় নদীর দুই পাড়ে তেল জমে থাকায় জলজ প্রাণী, পশু-পাখি ও উদ্ভিদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এমএ বাশার বলেন, ম্যানগ্রোভ বনে ১০ হাজার হেক্টর এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ার এই ঘটনাটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর আগে ইন্দোনেশিয়া, পানামা, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। তবে সর্বোচ্চ ৫ হাজার হেক্টর এলাকায় তেল সীমাবদ্ধ রেখে অপসারণ করে দেশগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে না পারায় সুন্দরবনের ১০ হাজার হেক্টর এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল ছড়িয়ে বিপর্যয়ের ঘটনা।
তেল ছড়িয়ে পড়ার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে অধ্যাপক ড. এমএ বাশার বলেন, জোয়ার-ভাটায় তেল ছড়িয়ে পড়ায় ম্যানগ্রোভ বন নষ্ট হবে। নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় জলজ ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পানির গতির সঙ্গে চলমান ক্ষুদ্র জীবগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ৮০ ভাগ মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এগুলো খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না বলে ক্ষয়ক্ষতি বুঝা যাচ্ছে না। ক্ষুদ্র জীবগুলোই জলজপ্রাণীর প্রথম ধাপের খাবার। এসব নষ্টের কারণে ওই এলাকায় খাবার সংকট দেখা দেবে। এছাড়া কোরাল জাতীয় অমেরুদণ্ডী প্রাণী, কেঁচো জাতীয় প্রাণী, চিংড়ি, কাকড়া জাতীয় প্রাণী এবং তাদের ডিম ও লার্ভা, শামুক, তারা মাছ, হাঙ্গর জাতীয়, মৎস্যজাতীয় এবং উভয়চর প্রাণী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি শ্বাসতন্ত্র বন্ধ হয়ে এসব প্রাণী একপর্যায়ে মারা যাবে। তিনি বলেন, পরোক্ষভাবে সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী যেমন কুমীর, সাপ ও কচ্ছপ ক্ষতির মুখে রয়েছে। অনেক প্রাণী মারা যাবে। যেসব বেঁচে থাকবে তাদের প্রজনন ক্ষমতা কমে আস্তে আস্তে বিলুপ্তির দিকে যাবে। তিনি আরও বলেন, বাঘ, হরিণসহ স্তন্যপায়ী প্রাণী পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। মৌমাছি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মধু উৎপাদন কমে যাবে।
সুন্দরবনের ভেতরের নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. হামিদা খানম। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পানিতে তেল ছড়িয়ে থাকায় জোয়ার-ভাটায় অনেক দূর এলাকা পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। এর প্রভাবে জীববৈচিত্র্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তেল ছিটিয়ে থাকায় অক্সিজেনের মাত্রা কমে জলজ প্রাণীর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি জলজ প্রাণীগুলো খাদ্য ও পুষ্টির সংকটে পড়বে। এসব প্রাণী পানির সঙ্গে তেল পান করায় বিষক্রিয়া হওয়ার আশংকা রয়েছে। তিনি বলেন, বড় জলজ প্রাণীর খাদ্য হচ্ছে নদীর ছোট মাছ, কাকড়াসহ ছোট প্রাণীগুলো। তেলের কারণে এসব ছোট জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। বড় প্রাণীগুলো ওই সব ছোট প্রাণী খেয়ে আক্রান্ত হতে পারে, যা অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে ড. হামিদা খানম বলেন, আপাতত গাছ-পালার ক্ষয়ক্ষতি তাৎক্ষণিক চোখে দেখা না গেলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে। নদীর দুই তীরবর্তী ১০০ থেকে ২০০ গজ পর্যন্ত এলাকার গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, মাটি থেকে পানি, পুষ্টি, মিনারেল, খনিজ টেনে নেয় গাছ-পালা। তেলের কারণে স্বাভাবিকভাবে এই প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া যেসব এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে ডলফিনের অভয়াশ্রম রয়েছে। দীর্ঘদিন তেল পানিতে ভাসমান থাকায় বড় প্রাণী যেমন ডলফিন, মাছ, শুশুক ও কুমীর ওই এলাকা ছেড়ে নিরাপদ এলাকায় চলে যাবে। ফলে ওই এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাকড়া-শামুকের মতো উভয়চর প্রাণী নদী ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে যাবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক বলেন, পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব অভাবনীয়। যেহেতু জোয়ার-ভাটার কারণে পানি অনেক দূরে চলে গেছে। ফলে এ এলকায় জলজ প্রাণী যা আছে অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে। যার ফলে কিছুদিন গেলে দেখা যাবে কিছু প্রাণী মরে ভেসে উঠছে। এছাড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তরে যখন জোয়ারের পানি প্রবেশ করবে তখন এর ভেতরে থাকা প্রাণী ও গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক্ষেত্রে প্রাণীর মধ্যে হরিণ, বানর এবং গাছের মধ্যে সুন্দরী গাছের বেশি ক্ষতি হওয়ার আশংকা প্রকাশ করেন তিনি। এছাড়া আশপাশের গ্রামগুলোতে থাকা গৃহপালিত পশু-পাখির ওপরেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন এই পরিবেশ বিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা নতুন। তাই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এ ধরনের ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদেরকে কাজ করতে হবে। এ সময় তিনি সমস্যাটি নিরসনে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলেন। প্রথম আগুন লাগিয়ে পুরিয়ে দেয়া, তবে উপকূলীয় এলাকা ছাড়া দ্বীপে এটি করা যায় না বলে জানান তিনি। তেলটাকে পাইপলাইনের মাধ্যমে উঠিয়ে রিফাইন করে পানি ও তেল আলাদা করা। এছাড়া ছোট উদ্যোগে স্থানীয় পদ্ধতিতে তেল উত্তোলনের মাধ্যমেও সমস্যাটি কিছুটা সমাধান হতে পারে বলে জানান তিনি। সরকারের করণীয় হিসেবে তিনি আরও বলেন, তেল পরিবহন রুট পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া যেসব ট্যাংকারে তেল বহন করা হয়, সেগুলোর ফিটনেসের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে দুর্ঘটনাকবলিত অয়েল ট্যাংকার ‘সাউদার্ন স্টার-৭’ এ মজুদ থাকা সাড়ে তিন লাখ লিটার তেলই ভেসে গেছে। সেখানকার নদীগুলোর তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে এই ফার্নেস অয়েল। সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় পাঁচ দিন ধরে পানিতে তেল ভাসায় জলজ ইকোসিস্টেম আক্রান্ত হয়েছে। এতে অতিক্ষুদ্র জীবগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এগুলো খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না বলে এই মুহূর্তে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর বিরূপ প্রভাব উদ্ভিদ, জলজ প্রাণী ও পশুপাখির ওপর পড়বে বলে আশংকা বিশেষজ্ঞদের।
<a href='http://platinum.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/ck.php?n=acd94d5f' target='_blank'><img src='http://platinum.ritsads.com/ads/server/adserve/www/delivery/avw.php?zoneid=780&n=acd94d5f' border='0' alt='' /></a>
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আপাত দৃষ্টিতে বুঝা না গেলেও ভবিষ্যতে ডলফিন, কুমীর, বাঘ, হরিণসহ অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাবে না। ওই এলাকায় বসবাসকারী প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা কমে যাবে। নদীর দুই তীরের ২০০ গজ পর্যন্ত এলাকার গাছ-গাছালি আক্রান্ত হবে। তারা জানান, ইন্দোনেশিয়া, পানামা, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে দুর্ঘটনায় তেল ছড়িয়ে পড়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। দ্রুত ওইসব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু সুন্দরবনের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনে এত বড় ঘটনা ঘটলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো পাঁচ দিনেও তেল অপসারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। দুর্ঘটনা তদন্তে গঠিত নৌমন্ত্রণালয়ের কমিটির আহ্বায়ক মো. নুর-উর রহমান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, তেলবাহী ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ জাহাজকে অন্য আরেকটি নৌযান এমটি টোটাল ধাক্কা দেয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। আঘাতকারী নৌযানটি সাইড থেকে বাড়ি মেরে ওপরে উঠে গিয়েছিল। এতে সাউদার্ন স্টার-৭ নৌযানের চেম্বার ফেটে সব তেল বেরিয়ে গেছে।সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর সূত্র জানায়, ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ জাহাজটিতে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৮ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল। আর বন অধিদফতর জানিয়েছে, সুন্দরবন অভ্যন্তরে আনুমানিক তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ বর্গকিমি এলাকায় এই ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সাউদার্ন স্টারের মালিক আমির হোসেন ফরিদ যুগান্তরের কাছে দাবি করেছেন, দুর্ঘটনায় ছয়টি চেম্বারের চারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দুটি অক্ষত রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। মঙ্গলবার ভোররাতে শ্যালা নদীতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনাকবলিত ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ জাহাজ উদ্ধার করা হয়েছে।নদীতে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ার ক্ষতিকর দিক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, ফার্নেস অয়েল তেলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর তেল। বিটুমিনের পরই ফার্নেস অয়েলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর কেমিক্যাল রয়েছে। তবে সুন্দরবনে ডুবে যাওয়া ফার্নেস অয়েল পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য ক্রয় করায় এই তেলের ক্ষতিকর অংশ বেশি থাকবে না। কিন্তু দির্ঘমেয়াদি এর ক্ষতির প্রভাব পড়বে বলে তিনি জানান। তার মতে যদি পেট্রল কিংবা অকটেন হতো তাহলে কোনো ক্ষতি হতো না। এমনকি ডিজেল হলেও ক্ষতি বেশি হতো না। এতদিনে উড়ে যেত। কিন্তু ফার্নেস অয়েল ভারি হওয়ায় এই তেল উড়ে না গিয়ে পানিতে ভেসে রয়েছে। এই অবস্থায় পানির নিচে থাকা মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীরা অক্সিজেন পাচ্ছে না। যার কারণে দীর্ঘ মেয়াদে এসব প্রাণীর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি এই তেল অপসারণে অবিলম্বে আমেরিকার হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। তার মতে একমাত্র আমেরিকা ছাড়া অন্য কোনো দেশে এ ধরনের বিপর্যয় এড়ানোর মতো যন্ত্রপাতি নেই। অধ্যাপক ইজাজ হোসেন জানান, ফার্নেস অয়েলও বাতাসে উড়ে যায়। কিন্তু তাতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে।ত্বরিত তেল অপসারণ করতে না পারায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. সাব্বির মোস্তফা খান যুগান্তরকে বলেন, ম্যানগ্রোভ এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ পদক্ষেপ না নেয়ায় জোয়ার-ভাটায় আশপাশের নদী-নালাসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে কেমিক্যাল পাউডার ছিটিয়ে তেল নষ্ট করে দেয়া হয়। কিন্তু সুন্দরবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কেন এমন পদক্ষেপ নেয়া হল না তা বোধগম্য নয়। সরকারের আদৌ এমন প্রস্তুতি আছে কিনা তা জানি না। তবে ভালো দিক হচ্ছে, ছিটিয়ে থাকা তেল কেনা হচ্ছে। এতে গ্রামবাসী তেল সংগ্রহে আগ্রহী হয়েছে। সুন্দরবনের ওপর ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, পাঁচ দিন তেল ছড়িয়ে পড়ায় পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাবে। এতে সুন্দরবনের ওপর দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।দীর্ঘমেয়াদে ক্ষয়ক্ষতি : সুন্দরবনের নদীগুলোতে পাঁচ দিন ধরে তেল ভাসতে থাকায় এবং জোয়ার-ভাটায় নদীর দুই পাড়ে তেল জমে থাকায় জলজ প্রাণী, পশু-পাখি ও উদ্ভিদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এমএ বাশার বলেন, ম্যানগ্রোভ বনে ১০ হাজার হেক্টর এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ার এই ঘটনাটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর আগে ইন্দোনেশিয়া, পানামা, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। তবে সর্বোচ্চ ৫ হাজার হেক্টর এলাকায় তেল সীমাবদ্ধ রেখে অপসারণ করে দেশগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে না পারায় সুন্দরবনের ১০ হাজার হেক্টর এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল ছড়িয়ে বিপর্যয়ের ঘটনা।তেল ছড়িয়ে পড়ার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে অধ্যাপক ড. এমএ বাশার বলেন, জোয়ার-ভাটায় তেল ছড়িয়ে পড়ায় ম্যানগ্রোভ বন নষ্ট হবে। নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় জলজ ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পানির গতির সঙ্গে চলমান ক্ষুদ্র জীবগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ৮০ ভাগ মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এগুলো খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না বলে ক্ষয়ক্ষতি বুঝা যাচ্ছে না। ক্ষুদ্র জীবগুলোই জলজপ্রাণীর প্রথম ধাপের খাবার। এসব নষ্টের কারণে ওই এলাকায় খাবার সংকট দেখা দেবে। এছাড়া কোরাল জাতীয় অমেরুদণ্ডী প্রাণী, কেঁচো জাতীয় প্রাণী, চিংড়ি, কাকড়া জাতীয় প্রাণী এবং তাদের ডিম ও লার্ভা, শামুক, তারা মাছ, হাঙ্গর জাতীয়, মৎস্যজাতীয় এবং উভয়চর প্রাণী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি শ্বাসতন্ত্র বন্ধ হয়ে এসব প্রাণী একপর্যায়ে মারা যাবে। তিনি বলেন, পরোক্ষভাবে সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী যেমন কুমীর, সাপ ও কচ্ছপ ক্ষতির মুখে রয়েছে। অনেক প্রাণী মারা যাবে। যেসব বেঁচে থাকবে তাদের প্রজনন ক্ষমতা কমে আস্তে আস্তে বিলুপ্তির দিকে যাবে। তিনি আরও বলেন, বাঘ, হরিণসহ স্তন্যপায়ী প্রাণী পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। মৌমাছি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মধু উৎপাদন কমে যাবে।সুন্দরবনের ভেতরের নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. হামিদা খানম। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পানিতে তেল ছড়িয়ে থাকায় জোয়ার-ভাটায় অনেক দূর এলাকা পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। এর প্রভাবে জীববৈচিত্র্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তেল ছিটিয়ে থাকায় অক্সিজেনের মাত্রা কমে জলজ প্রাণীর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি জলজ প্রাণীগুলো খাদ্য ও পুষ্টির সংকটে পড়বে। এসব প্রাণী পানির সঙ্গে তেল পান করায় বিষক্রিয়া হওয়ার আশংকা রয়েছে। তিনি বলেন, বড় জলজ প্রাণীর খাদ্য হচ্ছে নদীর ছোট মাছ, কাকড়াসহ ছোট প্রাণীগুলো। তেলের কারণে এসব ছোট জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। বড় প্রাণীগুলো ওই সব ছোট প্রাণী খেয়ে আক্রান্ত হতে পারে, যা অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে।দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে ড. হামিদা খানম বলেন, আপাতত গাছ-পালার ক্ষয়ক্ষতি তাৎক্ষণিক চোখে দেখা না গেলেও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে। নদীর দুই তীরবর্তী ১০০ থেকে ২০০ গজ পর্যন্ত এলাকার গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, মাটি থেকে পানি, পুষ্টি, মিনারেল, খনিজ টেনে নেয় গাছ-পালা। তেলের কারণে স্বাভাবিকভাবে এই প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া যেসব এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে ডলফিনের অভয়াশ্রম রয়েছে। দীর্ঘদিন তেল পানিতে ভাসমান থাকায় বড় প্রাণী যেমন ডলফিন, মাছ, শুশুক ও কুমীর ওই এলাকা ছেড়ে নিরাপদ এলাকায় চলে যাবে। ফলে ওই এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাকড়া-শামুকের মতো উভয়চর প্রাণী নদী ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে যাবে।জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক বলেন, পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব অভাবনীয়। যেহেতু জোয়ার-ভাটার কারণে পানি অনেক দূরে চলে গেছে। ফলে এ এলকায় জলজ প্রাণী যা আছে অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে। যার ফলে কিছুদিন গেলে দেখা যাবে কিছু প্রাণী মরে ভেসে উঠছে। এছাড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তরে যখন জোয়ারের পানি প্রবেশ করবে তখন এর ভেতরে থাকা প্রাণী ও গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক্ষেত্রে প্রাণীর মধ্যে হরিণ, বানর এবং গাছের মধ্যে সুন্দরী গাছের বেশি ক্ষতি হওয়ার আশংকা প্রকাশ করেন তিনি। এছাড়া আশপাশের গ্রামগুলোতে থাকা গৃহপালিত পশু-পাখির ওপরেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন এই পরিবেশ বিজ্ঞানী।তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা নতুন। তাই পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এ ধরনের ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদেরকে কাজ করতে হবে। এ সময় তিনি সমস্যাটি নিরসনে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলেন। প্রথম আগুন লাগিয়ে পুরিয়ে দেয়া, তবে উপকূলীয় এলাকা ছাড়া দ্বীপে এটি করা যায় না বলে জানান তিনি। তেলটাকে পাইপলাইনের মাধ্যমে উঠিয়ে রিফাইন করে পানি ও তেল আলাদা করা। এছাড়া ছোট উদ্যোগে স্থানীয় পদ্ধতিতে তেল উত্তোলনের মাধ্যমেও সমস্যাটি কিছুটা সমাধান হতে পারে বলে জানান তিনি। সরকারের করণীয় হিসেবে তিনি আরও বলেন, তেল পরিবহন রুট পরিবর্তন করতে হবে। এছাড়া যেসব ট্যাংকারে তেল বহন করা হয়, সেগুলোর ফিটনেসের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। - See more at: http://www.jugantor.com/first-page/2014/12/14/189215#sthash.bs1M7ZCX.dpuf

No comments

Powered by Blogger.