শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর পঙক্তির চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জাতি আজ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে শ্রদ্ধাবনত হবে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। আজ ১৪ ডিসেম্বর ভোরে জনতার ঢল নামবে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ আর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে বাঙালি জাতি যখন আসন্ন বিজয়ের আনন্দে উন্মুখ, ঠিক তখন দখলদার পাকিস্তানিদের এদেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস-ঘাতকরা রাতের অন্ধকারে মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞে। তারা হত্যা করে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। ৪২ বছর পর সেই ঘাতকদের একজন মিরপুরের কসাই নামে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তাই শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের এ বছর প্রথমবারের মতো জাতি স্মরণ করবে কিছুটা ভিন্নভাবে। অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর সারা দেশ থেকে সহস াধিক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে তারা। অনেকের লাশই পাওয়া যায়নি। এভাবে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার হীনচক্রান্তে মেতে ওঠে নির্মম ঘাতক-দালালরা। দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নিজ কর্মের মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠকদের প্রভূত প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। মুক্তিকামী জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। হানাদাররা সেদিন কেবল ঢাকাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ প্রায় দেড়শ বুদ্ধিজীবী-কৃতীসন্তানকে অপহরণ করে মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। সেই থেকে ১৪ ডিসেম্বর এক শোকাবহ দিন।
এ শোকাবহ দিনটি ৪২ বছর কেটেছে হত্যার বিচার না পাওয়ার আক্ষেপে। কিন্তু এখনকার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঘাতক-দালালদের বিচারের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। মিরপুরের কসাইখ্যাত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আর বিচারের সব ধাপ অতিক্রম করে ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষায় রয়েছে জামায়াত নেতা নরঘাতক কামারুজ্জামানের। শাস্তির অপেক্ষায় জেলখানায় দিন কাটছে বাকি ঘাতকদের। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর ঢাকাসহ সারা দেশে সহিংসতা চালিয়েছে ওই ঘাতকের দল জামায়াত এবং তাদের অনুসারী শিবির। তাদের সহিংসতা থেমে নেই, চলছে। তাই এবারের বুদ্ধিজীবী দিবসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সর্বস্তরের মানুষ নতুন করে শপথ নেবেন, কলংকমোচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে ঘাতকদের সব ধরনের ষড়যন্ত্র ও সহিংসতা প্রতিহত করে বাকি ঘাতকদের বিচারের রায় কার্যকর করার।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ পৃথক বাণী দিয়েছেন। তারা আজ ভোরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারীদের অবদান কোনো দিন ম্লান হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোনো ষড়যন্ত্রই জাতিকে ঘাতকদের রায় বাস্তবায়নের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। তিনি যুদ্ধাপরাধী জামায়াত চক্রের সব ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। রওশন এরশাদ বলেন, বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে যাবেন।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হানাদাররা সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার মাধ্যমে শুরু করে বাঙালি নিধনযজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস হানাদাররা বাংলাদেশে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রাখে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই নিজেদের পরাজয় অনিবার্য জেনে দখলদাররা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার গোপন নীলনকশা গ্রহণ করে। কৃতী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে তা তুলে দেয় তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র ক্যাডার গ্র“প আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর হাতে। ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই হিটলিস্ট অনুযায়ী পাক বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্যতম অপকর্মে এ তিনটি ঘাতক গ্র“প মেতে ওঠে। কারফিউর মধ্যে রাতের অন্ধকারে বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে ধরে এনে চোখ বেঁধে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে নির্মম-নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর সারা দেশে একযোগে সর্বাধিকসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্যানুযায়ী এ পর্যন্ত সারা দেশে ৪৬৭টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। কেবল ঢাকা ও এর আশপাশে ৪৭টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন- অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ডা. মোহাম্মদ শফি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার আবু তালেব, আনম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, সৈয়দ নাজমুল হক, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদ, ড. আবদুল খায়ের, ড. সিরাজুল হক খান, ড. ফয়জল মহী, ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, সেলিনা পারভীন, হবিবুর রহমান, মেহেরুন্নেসা, গিয়াস উদ্দীন আহমদ প্রমুখ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্মৃতিচারণ, চিত্র প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বাংলাদেশ বেতার, বিটিভি, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও এফএম রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিকগুলোতেও বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে।
বিভিন্ন দলের কর্মসূচি : বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে রয়েছে সূর্যোদয়ের ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ। সকাল ৮টা ১০ মিনিটে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, সকাল ৯টা ১০ মিনিটে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ এবং বিকাল ৩টায় খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের উদ্যোগে বিকাল ৪টায় মুক্তিভবনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম বিকাল ৩টায় রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক এবং ৩টা ৩০ মিনিটে একই স্থানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বেগবান ও দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকরের দাবিতে মানববন্ধন করবে।
রূখে দাঁড়াও বাংলাদেশ সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পতাকা মিছিল করবে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সকাল ১১টায় এর কার্যালয়ে আলোচনা সভা করবে। জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ সকাল ১০টায় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করবে। জাতীয় জনতা পার্টি বিকাল ৪টায় জনতা ভবনে আলোচনা সভার আয়োজন করবে।
এছাড়া জাকের পার্টি, গণআজাদী লীগ ন্যাপ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ প্রভৃতি সংগঠন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.