যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব যে কোন সময়ের চেয়ে ভাল -ড্যান ডব্লিউ মজিনা

ঘড়ির কাঁটার শব্দ শুনিয়ে বক্তৃতার শুরু। নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশীদের অনুষ্ঠানে তখন পিনপতন নীরবতা। একটি মাত্র মাইক্রোফোন অন। সবগুলো ক্যামেরার চোখ একজনের ওপর। কথা বলছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর ফিরে গেলেন তিন বছর আগের একটি বিশেষ দিনে। যে দিন ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ককে আরও বিস্তৃত, গভীর ও শক্তিশালী করার মিশন দিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন তিনি। আর ক’দিন বাকি। তার সেই মিশনের পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। ঢাকার ৩ বছরের কাজের মাধ্যমে ৩৩ বছরের কূটনৈতিক জীবনের ইতি টেনে অবসরে যাচ্ছেন। তিনি নিজেই তার বিদায়ের ঘোষণা দিলেন। জানালেন, চলতি সপ্তাহই তার ক্যারিয়ারের শেষ সপ্তাহ।
‘আমেরিকা-বাংলাদেশ সম্পর্ক: অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনার মূল আকর্ষণ ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানের আয়োজক সেন্টার ফর নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশীজ। রাজনীতিক, নাগরিক সমাজ, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের একটি অভিজাত হোটেলে গতকাল দুপুরের ওই আয়োজনে মার্কিন দূত বলেন, উপস্থিত সবাইকে নিয়ে আমি সেই দিনটি স্মরণ করতে চাই, যেদিন চমৎকার এই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্বকে বিস্তৃত করার মিশন শুরু করেছিলাম। মডারেট মুসলিম এ দেশটি কৌশলগত দিক থেকে আমেরিকার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি আমার তিন বছরের মিশনের সমাপনী লগ্নে এটি বলতে পারি, আজ অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে দেশ দু’টির সম্পর্ক কেবল বিস্তৃত, গভীর ও শক্তিশালী নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। বিগত দিনগুলোতে দুই দেশের অংশীদারিত্ব ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে। এটিই সত্য যে, ঢাকা-ওয়াশিংটন অংশীদারিত্ব প্রতি দিনই  বাড়ছে। আর এটি হচ্ছে দুই দেশের জনগণের কল্যাণে। মজিনা তার আমলে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্বে বাংলাদেশের যে সব উন্নয়ন হয়েছে তার কিছু অংশ তুলে ধরে বলেন, দুই দেশের সুসম্পর্ক নিয়ে আমি অনেক কথাই বলতে পারি। এ অংশীদারিত্ব আজ সমৃদ্ধ, বহুমুখী, গতিশীল এবং সফল। আমি এর সঙ্গে থাকতে পেরে অত্যন্ত খুশি। মজিনার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সুধীজনও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান অংশীদারিত্ব আগামী দিনে কেবল অটুট থাকাই নয়, সব বাধা পেরিয়ে এটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে- এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে আলোচকরা মজিনার অবসর জীবনের শুভ কামনা করেন। ঢাকায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব শেষ হলেও জীবনের বাকি সময় আমেরিকায় তিনি বাংলাদেশের অনারারি দূত হিসেবে থাকবেন বলে আশা করেন তারা। লিখিত বক্তৃতা শেষ করার মুহূর্তেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ড্যান মজিনা। দেশের সরকার, নাগরিক সমাজ, বিশেষ করে দেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বলেন, চমৎকার এ দেশ ছেড়ে যেতে বুকটা ভারি হয়ে আসছে। বিদায় বেলা এটুকুই শুধু বলবো জাতি হিসেবে বাংলাদেশীরা অনেক বড়। আমি কোন না কোনভাবে বাংলাদেশীদের এই বড়ত্বের গল্প বলতে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করবো। 
বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা দূর করার তাগিদ: গোলটেবিল আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের চেয়ারপারসন এম এস শেকিল চৌধুরী। অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম, সিএম শফি সামী, সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মেজর (অব.) এম হাফিজ উদ্দিন, জিএম কাদের, সাবেক তথ্য কমিশনার ও রাষ্ট্রদূত মো. জমির ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি। আলোচনায় অংশ নেন- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, ব্যাংকার ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী, ড. আহমদ আল কবির,  তোফায়েল সামী, নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হাসিনা নেওয়াজ, এনআরবি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেডের সিনিয়র এডভাইজার সৈয়দ আবদুল মুক্তাদির, তরুণ উদ্যোক্তা ওয়াকিল চৌধুরী প্রমুখ।
আলোচনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ সব আলোচকই বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দেন। বিশেষ করে বাংলাদেশী বংশোদভূত যারা বিভিন্ন দেশে রয়েছে এমন নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশীদের দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার তাগিদ দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বাংলাদেশী বংশোদভূত আমেরিকানদের অবদানের কথাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন মার্কিন দূত। তিনি জানান, তার দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রতি বছর অন্তত ২-৩ সপ্তাহ বাংলাদেশী বংশোদভূত আমেরিকানদের সঙ্গে কাটিয়েছেন। যারা নিউ ইয়র্ক, ডালাসসহ আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করছেন। তাদেরকে দেশে বিনিয়োগে উৎসাহ দিয়েছেন বলেও জানান তিনি। প্রশ্নোত্তর সেশনে ড্যান মজিনা বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতিবন্ধক কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করেন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কট, দুর্নীতি, আইনের শাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে বিনিয়োগের অন্তরায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সদিচ্ছা থাকলে এটিও দূর করা সম্ভব। মজিনা বাংলাদেশের জিএসপি ফিরে পাওয়ার বিষয়ে বলেন, শ্রম ও তৈরী পোশাক খাতে আন্তর্জাতিক মানে উন্নয়নের পথে রয়েছে বাংলাদেশ। অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আরও অনেক কিছু করার বাকি রয়েছে। এটি সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পুনরায় জিএসপি ফিরে পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে সাবেক উপদেষ্টা মীর্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ডিভি ভিসায় (লটারি) পুনরায় সুযোগ দেয়া যায় কি-না তা বিবেচনার অনুরোধ জানান।  দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের অবদানের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, এনআরবি এখন যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। এতে দুই দেশই লাভবান হচ্ছে।
সিএম শফি সামী তার বক্তৃতায় বলেন, সন্ত্রাসবাদ যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের অভিন্ন শত্রু। এটি মোকাবিলায় দুই দেশের যৌথ উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।
সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত করলে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গণতন্ত্র  পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দেন তিনি। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদের বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা সংক্রান্ত ফোরামের বিষয়ে সম্পাদিত টিকফা চুক্তি তার আমলেই সই হয়েছে।
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু বিদেশী কূটনীতিকের অযাচিত হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে বলেন, একজন বিদেশী কূটনীতিক ঢাকা সফরে এসে একটি দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বলে গেলেন। এটি কোন কূটনীতিকের কাজ হতে পারে না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্র বা তাদের প্রতিনিধিদের আরও বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানান বিএনপির ওই নেতা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপড়েনের প্রসঙ্গ টেনে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি গোলাম মওলা রনি বলেন, কেন এই টানাপড়েন এটি ভাবা দরকার। শুধু প্রশংসা বা ইতিবাচক বক্তব্য নিয়ে সন্তুষ্ট না থেকে সম্পর্কের নেতিবাচক বিষয়গুলো বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে টানাপড়েনের কারণ খতিয়ে দেখতে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.