সুশাসনের অভাবে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে

(ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত রাজনৈতিক অর্থনীতি, জবাবদিহি ও সুশাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান l প্রথম আলো) রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সুশাসন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আর সুশাসনের অভাবে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ স্বচ্ছ, জবাবদিহি ও সুসংহত গণতন্ত্রের মাধ্যমেই উন্নয়নের সুফল প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি, জবাবদিহি এবং সুশাসন’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে গতকাল বৃহস্পতিবার এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)। তিন দিনের এই সম্মেলন আয়োজনে সহযোগিতা করেছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থিঙ্ক ট্যাংক ইনিশিয়েটিভ, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার এবং ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের গবেষণা সংস্থা ইফেকটিভ স্টেটস অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট (ইএসআইডি)। সম্মেলনের একটি কর্ম-অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রাজনীতি কতটা ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। অর্থনীতির প্রসার রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধরনের সত্য আবির্ভূত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশের উন্নয়নে এনজিও সম্পৃক্ত হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সেবা প্রদান করছে এসব এনজিও। রেহমান সোবহানের মতে, এ দেশে বিপুলসংখ্যক সামাজিক কর্মী তৈরি হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পোশাক খাতে ৪০ লাখ কর্মী রয়েছেন। দুই হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তাঁরা রপ্তানিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। এভাবে রাজনৈতিক সুবিধার বাইরে বিকল্প হিসেবে দেশের উন্নয়নে বেসরকারি উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে, যা রাজনীতির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রূপ নিয়েছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য ভালো নয়। অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, সংবিধান ও অন্যান্য উন্নয়ন দলিলে বাংলাদেশকে উন্নয়নমুখী ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বলা হয়েছে। অথচ এ লক্ষ্যে প্রণীত বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সুশাসনের মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। ফলে রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সুশাসনের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল হয়েছে। তা সত্ত্বেও গত দুই দশকে দারিদ্র্য বিমোচন ও জনকল্যাণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। মাহমুদ বলেন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো পরিচালিত হয়। বিভিন্ন কর্মসূচির অর্থ ও সুবিধাগুলো স্থানীয় সাংসদের মাধ্যমে দেওয়া হয়। কিন্তু সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারায় এতে লুটপাট হয়, মানুষ সুফল পায় না। তাঁর মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতির কাঠামো বিরাজমান। এ ছাড়া দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব রয়েছে। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশের সংসদ যদি কার্যকর না থাকে, তাহলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠানও এ দেশে দুর্বল। অনুষ্ঠানে ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের অধ্যাপক ও ইএসআইডির গবেষণা পরিচালক কুনাল সেন বলেন, কার্যকর সুশাসনের দিক থেকে মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা ভালো। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অর্থনীতির অধ্যাপক মুশতাক এইচ খান বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে চলবে না। ভারতের অনেক রাজ্য বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। আবার অনেক রাজ্য বাংলাদেশের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে। তবে ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অনেক শক্তিশালী। সে কারণে ভারতের মতো দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় এবং তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যও হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকেও সেভাবে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। নেপালের পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শংকর পি শর্মা বলেন, ‘নেপালে ১৩ বছর ধরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সে কারণে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতি বেড়ে গেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। রাজনৈতিক অনাগ্রহের কারণেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়নি। যদি হেরে যাই—এই ভেবে ক্ষমতাসীন দল এই নির্বাচন দিচ্ছে না।’
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সমালোচনা করে বলেন, ‘আমি একা একা একটা নির্বাচন করলাম। এরপর মনে করতে থাকলাম যে সবকিছু আমার। এটা যারা মনে করছে, তারা শিগগিরই বুঝতে পারবে এভাবে বেশি দিন দেশ চলবে না।’
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘প্রক্সি ইলেকশন’ উল্লেখ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আতাউর রহমান বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন ছাড়া দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করা সম্ভব নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের (এসএমই) উদ্যোক্তারা শতভাগ ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে যান। অবশ্য তিনি এ-ও বলেন, উচ্চবিত্তদের বাজে চর্চা (ব্যাড কনডাক্ট) এবং সুশাসনের ঘাটতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
এর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কানাডার চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ব্রায়ান অ্যালিমেকিন্ডারস বলেন, সুশাসন ছাড়া গণতন্ত্র আসবে না। আর গণতন্ত্র ছাড়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হবে না। বাংলাদেশে এখন সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। সুশাসনের জন্য এটা দূর করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, রাজনৈতিক অর্থনীতির মানে হলো কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। আবার অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো অন্যান্য সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। তিনি বলেন, গণমাধ্যম সরকারের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে। এর মাধ্যমে জনগণ সরকারকে বিচার করার সুযোগ পায়। অনুষ্ঠানে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য সৈয়দ সাদ আন্দালিব, বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক সুলতান হাফিজ রহমান, ইএসআইডির কর্মসূচি ব্যবস্থাপক জুলিয়া ব্রান্ট প্রমুখ বক্তব্য দেন।

No comments

Powered by Blogger.