অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের শপথ, মুরসি গৃহবন্দি

মিসরে সেনা হস্তক্ষেপে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার শপথ নিয়েছেন সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি আদলি মনসুর।
এর আগে বুধবার রাতে গণবিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্ট মুরসিকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। এর পরপরই সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এক বিবৃতিতে সংবিধান স্থগিত করে আদলি মনসুরকে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব দেন।
প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরপরই মোহাম্মদ মুরসিকে প্রথমে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর গৃহবন্দি করে রেখেছে সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে সরকারে তাঁর শীর্ষ সহযোগীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় মুরসির ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির ধর্মীয় সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের শীর্ষ ৫০ নেতার বিরুদ্ধে। তবে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে কোথায় রাখা হয়েছে এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে।
বুধবার রাতে ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরপরই আন্দোলনকারী লাখ লাখ মানুষ রাজধানী কায়রোতে সমবেত হয়ে উল্লাস প্রকাশ করে এবং সেনাবাহিনীর পক্ষে স্লোগান দেয়। তবে রাতে মুরসির পক্ষেও লাখো সমর্থক রাস্তায় নেমে সেনা হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানায়। একই সঙ্গে বিশ্ব নেতৃত্বও সামরিক হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট মুরসির অপসারণের ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
মিসরে মুরসির ইসলামিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা মোকাবিলায় ব্যর্থতার অভিযোগ এনে সরকার পতনের ডাক দেয় বিরোধীপক্ষ। সম্প্রতি সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৫০ জন নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য গত সোমবার ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এই আলটিমেটাম শেষ হওয়ায় বুধবার রাতে মুরসির সরকারকে সরিয়ে দিল সেনাবাহিনী।
মুরসির ক্ষমতাচ্যুতি : মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান বুধবার রাতে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, দেশকে বাঁচাতে মুরসিকে সরিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী তাদের 'ঐতিহাসিক' দায়িত্ব পালন করেছে। মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুরসি জনগণের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন।
এর আগে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদসহ রাজধানী কায়রোর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ট্যাংক, সাঁজোয়া যানে সজ্জিত সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। রাষ্ট্রীয় আল-আহরাম পত্রিকায় বলা হয়, স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে সেনাপ্রধান সিসি প্রেসিডেন্ট মুরসিকে জানিয়ে দেন, তিনি আর মিসরের প্রেসিডেন্ট নেই। তবে মুরসির কার্যালয় সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্টের ফেসবুক ও টুইটারে এটিকে 'অবৈধ' বলে অভিহিত করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের শপথ গ্রহণ : মিসরের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে গতকাল বৃহস্পতিবার শপথ নেন প্রধান বিচারপতি আদলি মানসুর। সকালে সাংবিধানিক আদালতের সামনে শপথ নেওয়ার সময় তিনি বলেন, 'আল্লাহর নামে শপথ নিচ্ছি যে, প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার, সংবিধান ও আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করব এবং জনগণকে সুরক্ষা দেব ও জাতিকে রক্ষা দেব।'
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হওয়ার মাত্র চার দিন আগে গত সোমবার তাঁকে সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট মুরসি। আর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে তিনি গতকালই প্রধান বিচারপতি হিসেবেও শপথ নেন। এ সময় সাংবিধানিক আদালতে অবস্থানকালে তিনি জানান, তিনি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করছেন। তিনি দেশের সেনাবাহিনী ও জনগণের প্রশংসা করে তিনি বলেন, 'সরকারকে তোয়াজ করার দিন শেষ।'
সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা : গতকাল রাতে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান আদলি মানসুর তাঁর নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের আলোচনা শুরু করেছেন। জানা গেছে, সেনাবাহিনীর নির্বাচনী রোডম্যাপ মাথায় রেখে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে যাচ্ছেন মানসুর। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের সমন্বয়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদ গঠন করতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তাতে বিরোধী দল ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্টের (এসএসএফ) নেতা আবদেল গাফফার জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিপরিষদে মোহাম্মদ আল-বারাদি, বিখ্যাত সার্জন মোহাম্মদ গোনেইম, মিসরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফারুক আল ওকদা স্থান পেতে পারেন।
মুরসির অবস্থান অজানা : ক্ষমতাচ্যুত করতে গিয়ে সেনাবাহিনী সংবিধান স্থগিত, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল এবং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে অবস্থান নেওয়ায় কার্যত মুরসিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। এরপর থেকে মুরসি কোথায় আছেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ ব্যাপারে মিসরের ধর্মীয় সংগঠন ও মুরসির সমর্থক গোষ্ঠী মুসলিম ব্রাদারহুডের মুখপাত্র আহমেদ আরেফ গতকাল সংবাদমাধ্যমকে জানান, ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি 'কর্তৃপক্ষের' হাতে বন্দি রয়েছেন। সর্বশেষ গতকাল সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, 'প্রতিরোধমূলক' ব্যবস্থা হিসেবে মুরসিকে আটক করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'তাঁর ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আটক থাকবেন। কারণ, মুরসির বিরুদ্ধে বিরোধীদের ওপর নির্যাতনের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হতে পারে।'
এ ছাড়া পুলিশ এরই মধ্যে মুরসির ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রধান সাদ আল কাতাতনি এবং তাঁদের ধর্মীয় সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রধান উপদেষ্টা (সুপ্রিম গাইড) মোহাম্মদ বাদেই ও ডেপুরি সুপ্রিম গাইড রাশাদ বাওয়ামীকে গ্রেপ্তার করেছে।
বিশ্ব নেতাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া : সামরিক হস্তক্ষেপে মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনায় বিশ্বে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এক বিবৃতিতে সরকার পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে উদ্বেগ জানান। তিনি বলেন, 'আমি অনুধাবন করতে পারছি যে, মিসরের জনগণ গভীর হতাশার মধ্যে আছেন। সামরিক হস্তক্ষেপ যেকোনো দেশের জন্যই উদ্বেগজনক।'
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক বিবৃতিতে জানান, তিনি এ ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। শিগগিরই বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার আহ্বান জানান তিনি। তবে এ ঘটনার তিনি নিন্দা জানাননি। অবশ্য সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে মিসরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা প্যাকেজ পর্যালোচনা করা হবে জানিয়েছেন তিনি।
যুক্তরাজ্য সামরিক হস্তক্ষেপের সমালোচনা করে বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ এক বিবৃতিতে বলেন, 'একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রাজনৈতিক সংকট নিরসনের উপায় হিসেবে সামরিক হস্তক্ষেপকে কখনো সমর্থন করে না যুক্তরাজ্য।' ফ্রান্স মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির পর দ্রুত দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ঘোষণা দেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান ক্যাথেরিন অ্যাস্টন এক বিবৃতিতে বলেন, 'আমি সব পক্ষকে দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাই। গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে এবং সংবিধানকে অনুমোদন দিতে হবে।' অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড বলেন, মিসরে যত দ্রুত সম্ভব পূর্ণ গণতন্ত্র দেখতে চান তাঁরা। মিসরে অবস্থানরত সব অস্ট্রেলিয়ান নাগরিককে ওই দেশ ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সৌদি আরবের বাদশা আবদুল্লাহ মিসরের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান আদলি মানসুরকে অভিনন্দন জানিয়ে গতকাল একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, 'মিসরের এই সংকটময় সময়ে সৌদি জনগণের পক্ষ থেকে আমরা আপনাদের অভিনন্দন জানাই।'
মিসরের সেনাবাহিনীর উদ্যোগের প্রশংসা করে দেশটির রাজনৈতিক পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে মিসরের জনগণ এই সংকটকালীন মুহূর্ত পার করতে সক্ষম হবে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ গতকাল মিসরের জনগণের সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রশংসা করেছেন। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মুরসির অপসারণকে তিনি 'রাজনৈতিক ইসলামের' সমাপ্তি বলে মন্তব্য করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.