স্নোডেন একা নন

এক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন মার্কিন সরকারের। ঘরের শত্রু বিভীষণ সেনাসদস্য ব্র্যাডলি ম্যানিং আর হ্যাকার অ্যারন সোয়ার্জও চুনকালি মাখিয়েছেন ভালোই। এবার এডওয়ার্ড স্নোডেন সর্বনাশের ষোলোকলা পূরণ করতে যাচ্ছেন হয়তো।
এবার আর নিছক সন্দেহভাজন জঙ্গির ওপর নির্যাতন বা ‘দখলদারি’ বজায় রাখতে বেসামরিক মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির মতো ‘লঘু পাপ’ নয়, প্রায় গোটা দুনিয়ায়, এমনকি মিত্রদের ওপরও নজরদারির মতো কাজের জবাবদিহি করতে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে।
শুরুতে স্নোডেন শুধু মার্কিন জনগণ এবং চীন ও হংকংয়ের কম্পিউটার হ্যাকের অভিযোগ তুললেও এবার বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কয়েকটি কার্যালয়, জোটের কয়েকটি সদস্য দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে আড়ি পেতেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইইউর সম্পর্ক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
এডওয়ার্ড স্নোডেনের দাবি, তিনি অন্য দশজনের মতোই একজন মানুষ। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য হলো, তিনি দিনের পর দিন মার্কিন নজরদারি প্রকল্পের কার্যালয়ের মতো স্পর্শকাতর স্থানে বসেছেন। তিনি যে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিতও হয়েছে। ৩০ বছর বয়সী স্নোডেন বিশ্বাস করেন, জবাবদিহি ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হলো মুক্ত সমাজের ভিত্তি। এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো লোকের সংখ্যা সমাজে কমই। আর এ জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার মতো মানুষ নিশ্চয়ই আর কম। কিন্তু অন্তত স্নোডেনের মতো ভাবেন এমন মানুষ আরও আছেন; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই। তাঁদের মধ্যে আছেন হ্যাকার অ্যারন সোয়ার্জ ও ইরাক যুদ্ধের মার্কিন সেনা ব্র্যাডলি ম্যানিং। তাঁরা মনে করেন, গোপনীয়তা ও নজরদারি হলো জুলুমবাজির দ্বাররক্ষক।
অ্যারন লিখেছিলেন, ‘অন্যায্য আইন দিয়ে কখনোই ন্যায়বিচার হয় না।’ ২০০৮ সালেই তিনি গোপন সব তথ্য প্রকাশের ডাক দিয়েছিলেন। গত জানুয়ারিতে আত্মহত্যা করেন ২৬ বছর বয়সী অ্যারন। তিনি মার্কিন কেন্দ্রীয় আদালতের কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ঢুকে লাখ লাখ নথি প্রকাশ করে দেন। এসব নথির প্রতিটি পাতায় ঢুকতে ফি দিতে হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়েই এ কাজ করেন অ্যারন। পরে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলোজির তথ্যভান্ডারে ঢুকে বিপুল পরিমাণ নথি ডাউনলোডের চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে বিচারের মুখোমুখি করতে আদালতে হাজির করার আগেই আত্মহত্যা করেন তিনি।
অন্যদিকে, গোপনীয়তাবিরোধী ওয়েবসাইট উইকিলিকসকে লাখ লাখ মার্কিন গোপন নথি সরবরাহ করার অভিযোগে সামরিক আদালতে ম্যানিংয়ের (২৫) বিচার চলছে। ‘আমি জনগণকে তথ্য জানিয়ে দিতে চেয়েছি। কারণ, তথ্য ছাড়া তুমি জানতে পারবে না, সরকার কী করছে,’ ২০১০ সালে এক হ্যাকার বন্ধুর কাছে লিখেছিলেন ম্যানিং। বিভিন্ন সময় এ সেনাসদস্য বলেছেন, বিবেকের তাড়না থেকে গোপন নথি ফাঁস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
২৮ বছর বয়সী কম্পিউটার হ্যাকার জেরেমি হ্যামন্ড নিউইয়র্কে গত ২৮ মে ই-মেইল, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য ও একটি বেসরকারি পরামর্শ প্রতিষ্ঠানের তথ্য চুরি করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। দোষ স্বীকার করার পর তিনি এক ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ‘আমি এ কাজ করেছি। কারণ, আমি মনে করি, সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দরজা বন্ধ করে কী করছে, তা জানার অধিকার আমার আছে। যা বিশ্বাস করি, তা-ই করেছি আমি।’
স্নোডেনকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মার্কিন জনগণের অবস্থান কী?
টাইম সাময়িকী এ ব্যাপারে সম্প্রতি একটি জরিপ করেছে। জরিপে দেখা গেছে, ৫৩ শতাংশ মার্কিন মনে করেন, স্নোডেনকে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। আর ২৮ শতাংশ মনে করেন, তাঁর বিচার করা ঠিক হবে না। তাঁরা মনে করেন, স্নোডেন যেসব তথ্য প্রকাশ করেছেন, তা জানার অধিকার জনগণের আছে।
তবে স্নোডেন বা ম্যানিংয়ের বয়সী (১৮ থেকে ৩৪ বছর) মার্কিন নাগরিকদের বেশির ভাগই মনে করেন, তাঁরা ঠিক কাজই করেছেন। এই বয়সী ব্যক্তিদের ৪৩ শতাংশই মনে করেন, স্নোডেন ঠিক কাজ করেছেন।
নজরদারির ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন হয়—এমন বিষয়গুলো বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন ৪৩ শতাংশ। ২৮ শতাংশ মনে করেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রমের মধ্যে একটি ভারসাম্য এনে নজরদারি চালিয়ে যাওয়া দরকার। তবে ২০ শতাংশ মনে করেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হলেও সন্ত্রাসবাদ রোধে আরও কার্যকর নজরদারি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
স্নোডেন, ম্যানিং, অ্যারন বা জেরেমি ২০০১ সালে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার সন্ত্রাসবাদী হামলার সময় ছিলেন কিশোর। ওই হামলার পর থেকে বিভিন্নভাবে মার্কিন প্রশাসনের নজরদারি বেড়ে যায় বহুগুণ। এই নজরদারি থেকে যে মার্কিন জনগণও বাদ পড়েনি, তা এখন সবার জানা। বিষয়টি বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন প্রযুক্তির বহুল ব্যবহারকারীরা। এটি স্নোডেন-ম্যানিং প্রজন্মের ওপর প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
 মাহফুজার রহমান

No comments

Powered by Blogger.