শ্রেনীকক্ষের তরিকা by মোস্তফা জামান

বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে নানা মাত্রায়, নানা আঙ্গিকে নতুন ও পুরোনো প্যারাডাইস জারি আছে। আধুনিক কালের বৈশ্বিক নব উৎক্ষেপ এ দেশের শিল্পে যে পরিবর্তন এনেছে, এরও ভালো ও মন্দ দুই চেহারাই আমরা প্রত্যক্ষ করে আসছি দুই দশক ধরে।
কিন্তু শিল্প নতুন বা পুরোনো কোনো পরিসরেই থেমে থাকেনি। অর্থাৎ এর বিবর্তন হয়েছে, এখনো হচ্ছে। অথচ ২০তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজনে এতসব পরিবর্তনের ছাপ নেই। কারণ, আয়োজকদের তরফ থেকে নতুন শিল্পভাষা, যা অনেকের হাতে ভাসা-ভাসা হলেও কিছু শিল্পীর হাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে—অমন নব সৃষ্টির স্বীকৃতি প্রদানের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যেমন কনসেপচুয়াল কিংবা স্থাপনাশিল্পের কোনো ক্যাটাগরি আজও তৈরি হয়নি, এমনকি মান যাচাইয়ের জ্ঞানগত কাঠামো নির্মাণের চেষ্টাও লক্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। অথচ স্থাপনার নামে নির্বিচারে বহু অশিল্প শিল্প নামে জায়গা করে নিচ্ছে জাতীয় পর্যায়ের প্রদর্শনীগুলোয়। এবারের আয়োজনও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে, যে শঙ্কা সবচেয়ে বেশি মনে জাগে তা হলো, একাডেমিতে প্রচলিত বা বাস্তবানুগ শিল্পচর্চার স্বাক্ষর আছে এমন শিল্পকর্মের জয়জয়কার; অর্থাৎ সৃষ্টিশীলতার মাত্রা অর্জনের শিল্প প্রাধান্য না পেয়ে, অনুশীলন পর্যায়ের শিল্পকর্ম সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা, যা স্পষ্টতই লক্ষ করা যায় এবারের প্রদর্শনীতে। সৃষ্টিশীল মাত্রা বলতে কোনো শিল্পীর নিজস্ব ভাষা তৈরির প্রজেক্ট বোঝায়—যা বাদ দিয়ে শিল্পী হওয়া সম্ভবপর নয়। যা আছে বিধায় রবীন্দ্রনাথের শিল্প সৃষ্টিশীলতায় উত্তীর্ণ বলে আমরা দাবি করে থাকি। মাধ্যমের কারিকুরি প্রদর্শন আর নিজ ভাষার ব্যবহার করে চিত্রকল্প নির্মাণের সর্বজনগৃহীত কোনো ছক না থাকলেও জাতীয় পর্যায়ের প্রদর্শনীতে ‘এক্সপেরিমেন্টাল’ অভিধা ব্যবহার করে আগে যেভাবে কাজ বাছাই করা হতো, আজকাল তা-ও হচ্ছে না বলেই এমন ব্যত্যয় লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। পুরস্কার প্রদানের ধরন বিশ্লেষণ করে উপর্যুক্ত সিদ্ধান্তের পক্ষে প্রমাণ মেলে। এবারে শিল্পকলা একাডেমীর যে জাতীয় পুরস্কার মাঈনউদ্দীনের ‘মোনাজাত’ নামের অনুশীলনধর্মী কাজের কপালে জুটল, তা সত্যিকার শিল্পভাষায় শিল্পচর্চাকারীদের উদ্যমের অগ্নিতে পানি ঢালার শামিল। এমনকি রাসেল কান্তি দাশের ‘পরিস্থিতি-৮’ ও জাহিদা আখতারের ‘ভবঘুরে-১’ শিরোনামের কাজ দুটিও (প্রথমটি তেলরঙে আঁকা ও পরেরটি নারকেলের ছোবড়াজাতীয় বস্তুতে গড়া ভাস্কর্য) মাস্টার ডিগ্রিতে জমা দেওয়া কাজের সঙ্গে তুলনীয়। আনিসুজ্জামান মামুনের ‘রিয়েলিটি শো-২০১৩-০১’ শিরোনামের ক্যানভাসও তথৈবচ—যাতে ইলাস্ট্রেশনধর্মী কনসেপ্ট নির্মাণের চেষ্টা স্পষ্ট। এই শিল্পী দীপা হক পুরস্কার পেয়েছেন, আর অপর দুজন যথাক্রমে ‘এবি ব্যাংক’ ও ‘বেগম আজিজুন্নেসা চারুকলা’ পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রদর্শনীর অন্যান্য কাজেও শিল্পভাষা নির্মাণের প্রচেষ্টার চেয়ে মাধ্যম ফলানোর আয়োজনের প্রতি পক্ষপাত লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে বললে সত্যের অপলাপ করা হয় না। সমীর মজুমদারের কালি-কলমের কাজ, শিরীন আক্তারের ‘বন্ধন’—যা কাঠের কাজ, কিংবা রাহুল ব্যানার্জির ‘দুর্নিবার-২’, মুকুল দত্তের ‘দিস ইজ এ লাভ সং’, বা মোহাম্মদ জাকির হোসেনের ‘বেদে দম্পতি’—সবই শ্রেণীকক্ষের তরিকা জানান দেয়, যেখানে মাধ্যম ও তার ব্যবহারের নীতি শিক্ষক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই শিল্পীদের পাশাপাশি আরও অগণিত শিল্পীর নাম উচ্চারণ করা যায়—যাঁরা জাতীয় পর্যায়ের প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের রসদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হননি, হয়তো আপন আপন শ্রেণীকক্ষে ভালো ‘ফল’ পাচ্ছেন।
ব্যক্তিশিল্পী কোনো যাচাই-বাছাইয়ের, এমনকি পর্যালোচনার উপলক্ষ হতে পারে না, শিল্পীর ভাষাই তাঁর পরিচয়। ভাষা পাকাপোক্ত অথচ বর্তমান প্রদর্শনীতে তাঁর মূল্যায়ন হয়নি—এমন শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নাসিমা হক, জয়া শাহরীন হক, জিহান করিম ও সঞ্জয় চক্রবর্তী এবং তাঁদের মতো আরও অনেকে। এঁদের ভাষা তৈরি হয়ে আছে অথচ জায়গা দেওয়ার ক্ষেত্রেও অবিচার করা হয়েছে। যেমন নাসিমার দুটি কাজের উপস্থাপনা পাশাপাশি হওয়াটা জরুরি ছিল।
নকশাধর্মিতা, বাস্তববাদী ফিগারধর্মিতার পাশে আরেকটি নব্য একাডেমিক প্রপঞ্চ। কাঠের কাজে বুননশিল্পে এমনকি দ্বিমাত্রিক ছবিতে নকশার বুনট মূল ভূমিকা রাখছে আজকাল। সিরামিক ভাস্কর্যও ঠিক শিল্পমুখী হয়ে উঠতে পারেনি—অধিকাংশ কাজই ঘর সাজানোর নিমিত্তে গড়া বলে মনে হয়।
এই ছন্দোবদ্ধ নয়েজের বিপরীতে যে সৃষ্টিশীলতার বিস্তার, সেখানে অনেক ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু কৌতূহলোদ্দীপক কাজ হচ্ছে। যেমন রাজীব দত্তের ‘হাইওয়ে সুইটস’, যাতে বাম রাজনীতির অবক্ষয় কৌতুকের ছলে পোস্ট ইডিয়লজিক্যাল সময়ের আইকন পূজার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। এমন কালচারবিষয়ক সমালোচনা বাংলাদেশের শিল্পে জরুরি।
প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের মধ্যে আতিয়া ইসলাম এ্যানি, কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ, আনিসুজ্জামান কিংবা শিল্পকলা একাডেমী সম্মান পুরস্কারপ্রাপ্ত মোহাম্মদ হাসানুর রহমান তাঁদের আপন ভাষার দৃঢ়তা নিয়েই সামনে এনেছেন সাম্প্রতিকতম শিল্পকর্ম। তথাপি অনুতাপের বিষয় হলো, দেশের অনেক নামী শিল্পীর সাম্প্রতিকতম উৎক্ষেপ এই প্রদর্শনীতে অনুপস্থিত। নামসর্বস্ব প্রদর্শনী যেমন অদরকারি, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর অনুপস্থিতিও কাম্য নয়। কারণ এতে চারুকলার জাতীয় মাত্রা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। জায়গা নিয়ে বিতর্কের কারণে আবদুস সালামের ‘রাজনৈতিক বার্তা’ শিরোনামের স্থাপনা শিল্পী ফিরিয়ে নিয়েছেন, এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপস্থিতি এই মাপের প্রদর্শনীতে কাম্য নয়।
সবার শেষে যে ভাবনায় পুনরায় ফিরে যেতে হয়, তা হলো, একাডেমিতে নম্বর পাওয়া হাত মাথায় গরিব-দুঃখী মানব-অবয়বের বিস্তার। দারিদ্র্য বিক্রি করে ফটোগ্রাফাররা একপর্যায়ে বিদেশ থেকে পুরস্কার নিয়ে এসেছেন ভূরি ভূরি, তাঁদেরই অনুকরণে দুঃখ বিক্রির প্রজেক্ট এই সময়ে বেমানান। তবে, মানান-বেমানান—এমন শব্দপ্রপঞ্চ বাদ দিয়ে জ্ঞান ও সৌন্দর্যের বহুবিধ মান ব্যবহার করে শিল্প যাচাই শুরু হওয়ার এখনই সময়—এর ব্যত্যয় বাংলাদেশের বিক্ষিপ্ত শিল্প পরিসরকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে। যাঁরা শিল্পকলায় কমিটিতে নিষ্ঠার সঙ্গে শ্রম ও মেধা ব্যয় করেন, এ বিষয়গুলো তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে বলে আশা করি। ২২ জুন শুরু হওয়া প্রদর্শনী চলবে ১২ জুলাই পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.