সপ্তাহের নায়ক মেহেজাবিন আহমেদ, শিক্ষার্থী

সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জ শহরের মধ্যে একটি খাল (কোটগাঁও-গনকপাড়া-দেওভোগ খাল) ভরাট করা হয়। মেহেজাবিন খাল ভরাটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্যোগ নেন। প্রতিবাদস্বরূপ স্মারকলিপি, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি প্রদান করে এলাকার জনগণকে একত্র করেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—তানভীর হাসান

খাল ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর প্রথম জনমত তৈরির উদ্যোগটা কি আপনি নিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, আমিই প্রথম নিয়েছিলাম। এরপর আমার উদ্যোগের সঙ্গে আস্তে আস্তে এলাকার লোকজন সাড়া দিয়ে প্রতিবাদে নেমে পড়ে।
প্রতিবাদ করার সাহস পেলেন কী করে?
আসলে সাহসটা ভেতর থেকেই হঠাৎ করে জাগ্রত হয়েছে। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, আমার জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি, বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গেছে কোটগাঁও-গনকপাড়া-দেওভোগ খালটি। এই খালে ছোটবেলায় গোসল করেছি। আজ সেই খালটিই একটি প্রভাবশালী চক্র ভরাট করে ফেলছে। এলাকার বৃষ্টি ও বন্যার পানি এই খাল দিয়েই নেমে থাকে। খালটি যখন ভরাট করা হচ্ছিল, তখন দেখে খুব খারাপ লাগছিল। মনে মনে ভেবেছি, কী করা যায়। মা-ভাইবোনদেরও মন খারাপ। এমন সময় খাল ভরাটকে কেন্দ্র করে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আর সেই প্রতিবেদন দেখে প্রশাসনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে খাল ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে নোটিশ প্রদান করা হয়। আর এসব দেখেই সাহস পেলাম। এরপর বিষয়টি গ্রামের মানুষের সঙ্গে আলোচনা করলাম। তাঁরাও প্রতিবাদ জানানোর ব্যাপারে একমত হলেন।
প্রতিবাদের ধরনটা কী ছিল?
প্রথমে আমরা একটা স্মারকলিপি তৈরি করি। সেখানে ভরাট করা খালটি পুনরুদ্ধারের জন্য কোটগাঁও, গনকপাড়া ও দেওভোগ—এই তিন গ্রামের মানুষের স্বাক্ষর নিই। এরপর সেই স্মারকলিপি জেলা প্রশাসক, পৌর মেয়র, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বরাবর প্রদান করি। শুধু স্মারকলিপি দিয়েই ক্ষান্ত থাকিনি, এরপর আমরা খাল ভরাটের প্রতিবাদে একটা মানববন্ধন করি। ওই মানববন্ধন করার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল। আমরা জানতে পারলাম, খাল ভরাটকারীদের পক্ষে একটি শ্রেণী তদবির করছে। বিষয়টি জানতে পেরে আমরা মানববন্ধনের প্ল্যাকার্ডে সেই বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করি, যাতে তদবিরকারীরা সতর্ক হয়ে যায়।
এর পরের খবর বলুন
খালের বিষয়ে ঢাকায় পরিবেশ অধিদপ্তর এনফোর্সমেন্ট খাল ভরাটকারীকে তলব করে দুই লাখ টাকা জরিমানা করে। আর খালকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়। এই খবর পেয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে কী যে আনন্দ।
আনন্দের মধ্যেও ক্ষোভ কিন্তু কমেনি। এরই মধ্যে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে পানি সরতে না পেরে এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। খালটিও পানির নিচে ডুবে যায়। মানুষের রান্নাঘর ও বাথরুম তলিয়ে যায়। আরও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এলাকার লোকজন। গত শনিবার সকাল সাতটায় এলাকাবাসী খাল থেকে বালু সরানোর দাবিতে জেলা প্রশাসক ও পৌর মেয়রের বাসভবন ঘেরাও করে। পরের দিন আবারও জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করি। আমরা খাল রক্ষায় একটুও হাল ছাড়িনি। সর্বশেষ ২ জুলাই গ্রামবাসী নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে খালের মুখে কালভার্টটি উন্মুক্ত করে দিই। এতে জলাবদ্ধ পানি নিষ্কাশিত হয়।
প্রতিবাদ করতে গিয়ে কোনো হুমকি পেয়েছেন কি?
আমাকে সরাসরি হুমকি দেওয়া না হলেও শুনেছি অন্যদের নাকি হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তবে আমাকে হুমকি না দিলেও আমি কিছুটা ভয়ে আছি। খাল ভরাটকারীরা অনেক শক্তিশালী। তারা সুযোগ পেলে আমাদের ক্ষতি করতে পারে।
খালটি কি পুরোপুরি মুক্ত হয়েছে?
না, এখনো হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তরের রায় এখনো কার্যকর হয়নি। ভরাটকারীরা এখন সেই থেকে রক্ষায় নানা তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে।
এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?
পরামর্শ একটাই, এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খালটি পুনরুদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই।
কোটগাঁও খালের মতোই দেশের বিভিন্ন স্থানেও ঘাটে যাওয়া খাল দখল ও ভরাটের বিরুদ্ধে সাহস করে প্রতিবাদ করতে আপনার মতোই এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন কি? এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
পরামর্শ একটাই, দেশের পরিবেশ বাঁচানোর জন্য খালগুলো আমাদের রক্ষা করতে হবে। এই ক্ষেত্রে কেউ একজন সাহস করে উদ্যোগ নিলেই দেখবেন আস্তে আস্তে অন্যরাও এগিয়ে আসছে, যোগ দিচ্ছে। প্রথমে তো কাউকে না কাউকে শুরু করতেই হবে।

No comments

Powered by Blogger.