সময়চিত্র জয়-পরাজয়ের রাজনীতি by আসিফ নজরুল

বিএনপি ৬: আওয়ামী লীগ ২। গত তিন বছরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোর ফলাফল এই। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর একমাত্র নির্ভেজাল বিজয় ছিল ২০১২ সালে রংপুর সিটি কপোরেশন নির্বাচনে।
বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন ২০১০ সালে চট্টগ্রাম ও ২০১২ সালে কুমিল্লায়। অন্যদিকে গত বছর নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে জিততে পারেননি বড় দুই দলের সমর্থিত প্রার্থীদের কেউই। সেলিনার বিজয় আওয়ামী লীগেরই বিজয় হিসেবে দেখলে সিটি করপোরেশনগুলোতে তাই আওয়ামী লীগের ফলাফল তেমন হতাশাব্যঞ্জক ছিল না। কিন্তু গত মাসে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট আর বরিশালের সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর অবস্থার বড় পরিবর্তন ঘটেছে। এতে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার ব্যবধান প্রকট হয়ে উঠেছে। আগামীকাল গাজীপুর নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিজয়ের সম্ভাবনা তেমন উজ্জ্বল নয়। এসব নির্বাচনের ফলাফলকে কীভাবে দেখছে বা দেখবে আওয়ামী লীগ? কী প্রভাব ফেলতে পারে এসব নির্বাচন আগামী দিনের রাজনীতিতে? আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের চিন্তাভাবনার কোনো পরিবর্তন কি হবে এতে?
উন্নত গণতন্ত্রে সরকারের মেয়াদের মধ্য বা শেষভাগে নির্বাচনে পরাজয় কিংবা বিভিন্ন জরিপে জনপ্রিয়তা হারানোর স্পষ্ট আলামত দেখে আগাম নির্বাচন দেওয়ার নজির রয়েছে। আমাদের দেশে আপাতত ঘটছে উল্টো ঘটনা। চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভরাডুবির পর বরং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রতিজ্ঞা আবারও জোরেশোরে প্রকাশ করা হচ্ছে। এমনকি আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচন না দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে।
নির্বাচনের ফলাফল কী বার্তা প্রদান করছে, তা নিয়েও আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্যদের মতভেদ রয়েছে। এসব ফলাফল হেফাজত বা কট্টর ইসলামপন্থীদের উত্থান হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। অন্যদিকে এসব নির্বাচনে বিপর্যয় সরকারের প্রতি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেখা হচ্ছে। যে ব্যাখ্যাই সত্যি হোক, এসব নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের জন্য সুখকর নয়। বরং এটিকে আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক পরাজয়ের ইঙ্গিত হিসেবে দেখা যেতে পারে। যদি তা-ই হয়, তাহলে নিতান্ত বাধ্য না হলে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার ঝুঁকি গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের এই মনোভাবকে সংসদ নির্বাচনে কারচুপির চেষ্টা হিসেবে দেখলে বিএনপি তা সর্বাত্মকভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে বলে ধারণা করা যায়। সার্বিক বিবেচনায় তাই সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনের ফলাফল আগামী দিনের রাজনীতিকে আরও সংঘাতময় করে তুলতে পারে।

২.
চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয় সম্ভবত দলটির জন্য অভাবিত ছিল। ঢাকায় নিশ্চিত পরাজয়ের আশঙ্কা রয়েছে, এমন চিন্তা থেকে ঢাকায় নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে না বলে একটি ধারণা রাজনৈতিক মহলে রয়েছে। সে ক্ষেত্রে চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পরাজয়ের বড় ঝুঁকি রয়েছে, এমন চিন্তা থাকলে সরকারের পক্ষে নির্ধারিত মেয়াদের আগে এসব জায়গায় নির্বাচন দেওয়ার কথা ছিল না। প্রার্থীদের যোগ্যতা এবং গত নির্বাচনগুলোর ফলাফলের ভিত্তিতে এসব জায়গায় আওয়ামী লীগের পরাজয়ের ঝুঁকিও তেমন ছিল না। কিন্তু তার পরও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা গণহারে হেরেছেন চারটি নির্বাচনে। গাজীপুরে একই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি।
গাজীপুরে প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে এগিয়ে। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান বহু বছর ধরে টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষিত, গণমুখী ও কর্মোদ্যমী মানুষ হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক কোনো অভিযোগও নেই। তুলনায় বিএনপির প্রার্থীর বিরুদ্ধে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী এবং তারও আগে কলেজে শিক্ষকতাকালে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া অঞ্চলগত হিসেবেও গাজীপুর বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগের সুশক্ত ঘাঁটি। এসব বিবেচনায় গাজীপুরে আজমত উল্লার বিজয়ের সম্ভাবনা বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার পরও তাঁর বিজয় নিয়ে বিরাট সংশয় সৃষ্টি হয়েছে দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগ সরকারের নানা ব্যর্থতার কারণে।
সদ্য সমাপ্ত চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা, বিশেষ করে বরিশালের প্রার্থী শওকত হোসেন ব্যক্তিগতভাবে জনপ্রিয় ছিলেন, এলাকার উন্নয়নে তিনি বহু কাজ করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে তাঁদের সরকারের অজনপ্রিয়তার বোঝা বহন করতে হয়েছে, তাঁদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে তাই এটিকে দায়ী করা হচ্ছে। হতে পারে যে সরকারের নির্মম আচরণে ক্ষুব্ধ হেফাজতের কর্মীরা উদ্যোগী হয়ে এসব পরাজয়ে ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু হেফাজতের উত্থানের আগেও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় প্রার্থীরা দুটো সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবং আরও বহু স্থানীয় (উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। তখন এসব পরাজয়ের মূল কারণ হিসেবে অ্যান্টি-এনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর অর্থাৎ দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার কারণে সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভকে দায়ী করা হয়েছিল। অ্যান্টি-এনকাম্বেন্সি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতটা প্রকট, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে গত দুটো সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবি।
অ্যান্টি-এনকাম্বেন্সির ভয়াবহতা হচ্ছে এটি চক্রবৃদ্ধি হারে বিস্তার লাভ করে। সুশাসনের অভাব ও সন্ত্রাস-দুর্নীতির কারণে বর্তমান সরকারের প্রতিও মানুষের ক্ষোভ দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এক বছরে হল-মার্ক, রেলে ঘুষ কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুসহ নানা দুর্নীতি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাস, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগে সরকারের জনপ্রিয়তা আরও হ্রাস পেয়েছে বলে ধারণা করা যায়। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয় ঘটলে তা সরকারের জনবিচ্ছিন্নতার আরেকটি বড় প্রমাণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে গাজীপুরে হেফাজতের একটি অংশ আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে, এখানে দলটির প্রার্থী তুলনামূলক যোগ্য এবং জনপ্রিয়, গাজীপুরও ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। আজমত উল্লা পরাজিত হলে এবং তাঁর ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীরের মোট ভোট বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের চেয়ে কম হলে নির্বাচনের ফলাফলকে তাই আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের আরেকটি রেড কার্ড হিসেবে দেখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অন্যদিকে গাজীপুরে আওয়ামী লীগ স্বল্প ব্যবধানে জিতলে আগের চারটি নির্বাচনে পরাজয়ের কারণে তা যতটা না সরকারের, তার চেয়ে বেশি প্রার্থী আজমত উল্লার ব্যক্তিগত বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবং এতে গত সংসদ নির্বাচনের মতো বিশাল ব্যবধানে জিতলেই কেবল আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী তার জনপ্রিয়তায় ধস নামছে বলে যে প্রচারণা চলছে, তার জবাব দিতে পারবে। এই সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের অর্জনের সম্ভাবনার চেয়ে বরং হারানোর আশঙ্কা বেশি।

৩.
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সিটি করপোরেশন ভোটের হিসাবে সবচেয়ে বড় নির্বাচন। সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে জনমতের প্রতিফলন হিসেবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে এর প্রভাব।
গাজীপুরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলেও নয়টি নির্বাচনে তার সাফল্য হবে বিএনপির অর্ধেক। এই ফলাফল আওয়ামী লীগের জন্য যথেষ্ট স্বস্তিকর হতে পারে না। কেয়ারটেকার বা বিরোধী দলের মনঃপূত সর্বদলীয় সরকার তারা মেনে নিলে সংসদ নির্বাচনের আগে এটি বিএনপির আরেকটি বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং নির্বাচনকালে বিএনপির পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টিতে তা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ এসব দাবি না মেনে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রশ্নে আরও অনড় হবে বলে ধারণা করা যায়।
আওয়ামী লীগের সামনে রাস্তা থাকবে দুটো। প্রথমটি হচ্ছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জনরায়কে সম্মান করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে জনমতকে মেনে নিয়ে সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসা। এটি করলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজিত হলেও বিজয়ী হবে গণতন্ত্র। আওয়ামী লীগের অন্য অপশন হচ্ছে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি এড়াতে পছন্দমতো একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা বা এমনকি নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করা। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর পর নির্বাচন না হলে সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সুযোগ রয়েছে। এটি করলে বা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ আপাতত বিজয়ী হতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্র পরাজিত, এমনকি বিপন্ন হবে এতে। আওয়ামী লীগ শুধু নিজেকে নাকি সার্বিকভাবে গণতন্ত্রকে বিজয়ী করতে চায়, তা আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে পরিষ্কার হতে শুরু করবে।
আমার আপাতত আশঙ্কা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ হয়তো দ্বিতীয় পথে যাবে। গতবার ক্ষমতার শেষভাগে এসে বিএনপিও একই কাজ করে যেনতেনভাবে নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করেছিল। এই দুই দলের তিক্ততা বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনকে রোমহর্ষক একটি খেলায় পরিণত করেছে। এই খেলায় যে জেতে সে পাঁচ বছর শিকারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, আর যে হারে সে নানাভাবে সেই শিকারির শিকারে পরিণত হয়। নির্বাচনের এই অর্থ পরিবর্তনের রাজনীতি দেশে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমার আশঙ্কা সম্ভবত অমূলক নয়।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.