অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের একটি রচনা by রায়হান রাইন

তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচার ও সংস্কারে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। সম্প্রতি তাঁর বাস্তুভিটা বিক্রমপুর অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়েছে একটি বৌদ্ধস্থাপনা
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সুবর্ণদ্বীপে কাটিয়েছিলেন এক যুগ সময়। বর্তমানে দেশটির নাম সুমাত্রা। একসময় প্রাচ্যে এটি ছিল বৌদ্ধধর্মের প্রধান একটি কেন্দ্র। পাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে এ দেশের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। অতীশ সুবর্ণদ্বীপ যাত্রা করেছিলেন খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকের গোড়ার দিকে, তাঁর ৩১ বছর বয়সে। সুবর্ণদ্বীপে যাওয়ার আগে তিনি অধ্যয়ন করেন কৃষ্ণগিরি বিহার ও নালন্দা মহাবিহারে। অতীশ যখন সুবর্ণদ্বীপে চন্দ্রকীর্তির ছাত্র, তখন সুবর্ণদ্বীপের রাজা গুরুপাল দেবমতী নামের এক সন্তকে পাঠিয়েছিলেন অতীশের কাছে। অনুরোধ করেছিলেন সত্য প্রসঙ্গে কিছু লিখতে। তিনি তখন রচনা করেন ‘সত্যদ্বয় অবতার’ (দুই প্রকার সত্য প্রসঙ্গে ভূমিকা) নামে সংক্ষিপ্ত একটি নিবন্ধ।
দুই প্রকার সত্যের ধারণা এই উপমহাদেশে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। পিতাপুত্রসমাগম-সূত্রে এমন উল্লেখ আছে যে এই দুই ধরনের সত্যকে জানার ভেতর দিয়েই বোধি লাভ করেছিলেন সিদ্ধার্থ গৌতম। বুদ্ধদর্শনে মাধ্যমিক মতের প্রতিষ্ঠাতা নাগার্জুন তাঁর মাধ্যমিককারিকা গ্রন্থে বলেন, ‘বুদ্ধ যে ধর্ম শিক্ষা দিয়েছেন, তার ভিত্তি সুনির্দিষ্টভাবেই দুই ধরনের সত্য: পার্থিব সত্য ও পরমার্থ সত্য।’ (২৪:৮) বুদ্ধের এই সত্যের ধারণার সঙ্গে বুদ্ধদর্শনের সত্তাবিষয়ক তত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্বের নিবিড় যোগাযোগ। অন্তহীন দুঃখ-সমুদ্র আমাদের এই সংসার, এ থেকে মুক্তি বা নির্বাণ পেতে হলে দরকার বন্ধনমুক্তির। এই বন্ধন আসে বাসনা বা মোহ থেকে। কাজেই কেউ যদি সংসারের সঙ্গে লিপ্ত বাসনা ও মোহকে জয় করতে চায়, তাকে উপলব্ধি করতে হবে সংসারের স্বভাবকে। বুদ্ধমতের পার্থিব বা ব্যবহারিক সত্যের ধারণা থেকে আমরা বুঝতে পারি, কীভাবে এই সত্য সংসার-জ্ঞানের ভিত নির্মাণ করে দেয়। এই বাস্তবের জ্ঞান প্রোথিত থাকে ভাষা ও ধারণাগত কাঠামোর গভীরে। পরমার্থ সত্যের জ্ঞান থেকে আমরা বুঝতে পারি, বাস্তবতার চূড়ান্ত স্বভাব ঠিক কেমন। পরম জ্ঞান আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করে দেয় সংসারের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রজ্ঞাসম্পন্ন দৃষ্টি।

২.
বাংলা ভাষায় ‘সত্য’ কথাটির নানা অর্থে ব্যবহার আছে। এসব অর্থের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শনে কথাটির অর্থের পার্থক্য অনেক। বাংলায় সত্যজ্ঞান শব্দটি ব্যবহার করে এমন জ্ঞানকে নির্দেশ করা হয়, যার উদয়ে মিথ্যাজ্ঞানের আঁধার ঘুচে যায়। ফকির লালন সাঁই গেয়েছেন, ‘সত্য কাজে কেউ নয় রাজি’। এখানে সত্য কাজ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন সঠিক কাজকে। কোনো একটি নৈতিক মানদণ্ডের তুল্যে যে কাজ ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে ওঠে, সেটাই সত্য কাজ। ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ কথাটিতেও নীতিভাব আছে, আছে সত্য রক্ষার দায়বোধও। পাশ্চাত্য চিন্তায় ‘সত্য’ পদটির প্রয়োগ হয় কোনো বাক্য বা ধারণার ক্ষেত্রে। ‘চাণক্য বাবু মারা গেছেন’ বাক্যটি সত্য হবে, যদি বাস্তবে চাণক্য বাবু নামের কেউ মারা গিয়ে থাকেন। তখন চাণক্য বাবুর মৃত্যু-সম্পর্কিত কারও বিশ্বাসও সত্য হবে।
বুদ্ধমতে, সত্য কথাটিকে ব্যবহার করা হয়েছে ‘বাস্তব’ অর্থে। বাস্তবতা চেতনার সামনে যে রূপে হাজির হয়, সেই রূপই সত্য। মাধ্যমিক বুদ্ধমতে, কোনো বস্তুর ভেতর অপরিবর্তনীয় সারসত্তা বলতে কিছু নেই; কোনো প্রপঞ্চের এই সারসত্তাহীনতাই পরম সত্য। অপরিবর্তনীয় সারসত্তা মানে বস্তুর সহজাত প্রকৃতি। বস্তু-সম্পর্কিত এই পরম সত্যকে প্রকাশ করতে বুদ্ধরা ‘শূন্যতা’ কথাটি ব্যবহার করেন। তাঁরা বলেন, প্রপঞ্চমাত্রই শূন্য স্বভাবের। এই শূন্যতার জ্ঞানই পরম সত্যজ্ঞান।
ব্যবহারিক সত্য বলতে মাধ্যমিকেরা বুঝিয়েছেন প্রাতিভাসিক বাস্তবতাকে, যা আমাদের বিশৃঙ্খল ও প্রভেদাত্মক চেতনার সামনে ধরা পড়ে। অবিদ্যাগ্রস্ত মন এই প্রতিভাসকে বাস্তব রূপে দেখে এবং বস্তুগুলোকে পরস্পর থেকে আলাদা করে ও ভ্রান্তিবশে মনে করে যে এই বাস্তবতাই পরম।
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বতে যাওয়ার কয়েক শ বছর আগে আরেক বাঙালিও সেখানে গিয়েছিলেন বুদ্ধমত প্রচার করতে। তিনি শান্তরক্ষিত। নালন্দা বিহারের এই বাঙালি আচার্য তিব্বতে গিয়েছিলেন অষ্টম শতকের শেষ দিকে। শান্তরক্ষিত ছিলেন নাগার্জুনের শূন্যবাদের প্রচারক। এই মতের সঙ্গে নৈয়ায়িক দিগনাগের যৌক্তিক জ্ঞানতাত্ত্বিক মত ও ধর্মকীর্তির যোগাচারী বিজ্ঞানবাদের একটি সুসংগতিপূর্ণ সমন্বয় সাধনের কাজ করেন তিনি। শান্তরক্ষিত তাঁর মাধ্যমিকালঙ্কার গ্রন্থে সত্য প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যখন কোনো সত্তাকে বিশ্লেষণ করা হয়, (আমরা দেখি) তাতে এমন কোনো স্বভাব নেই, যা প্রকৃতই “অবিভক্ত”। তাতে যেহেতু অবিভক্ত বা একক কিছু নেই, কাজেই তাতে এমন কিছুও থাকতে পারে না, যাকে বহুতে বিভক্ত বলা যাবে।’ (মাধ্যমিকালঙ্কার: ৬১) শান্তরক্ষিত তাঁর ‘না-এক-না-বহু’ এই যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে বস্তু-প্রপঞ্চ শূন্য স্বভাবের। বস্তুর ভেতরের স্বনির্ভর ও অপরিবর্তনীয় সারসত্তার ধারণাকে তিনি খারিজ করে দিয়েছেন।

৩.
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তাঁর সত্যদ্বয় অবতার লেখায় দুই ধরনের সত্যের প্রকৃতি সম্পর্কে বলেছেন এবং কীভাবে এই সত্যদ্বয়কে জানা যাবে, সেই যুক্তির প্রক্রিয়াও তাঁর এই লেখার বিষয়। আমরা আকাশে চাঁদ দেখি, এটি একটি ব্যবহারিক সত্য আর জলে বিম্বিত চাঁদও সত্য, তবে তা ভ্রান্ত ব্যবহারিক সত্য। অতীশ তাঁর রচনায় বলছেন, ব্যবহারিক বা প্রাতিভাসিক সত্যকে জানা যায় ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ ও অনুমান দিয়ে। তবে অভ্রান্ত সত্য হচ্ছে তা-ই, যার উদ্ভব ও বিলয় আছে। অতীশ আমাদের চারপাশের বদলে যেতে থাকা বাস্তবতাকেই গণ্য করেছেন ব্যবহারিক সত্যরূপে। তাঁর কাছে পরম সত্য হলো এমন কিছু, যা পরিবর্তনরহিত ও শর্তহীন। এমন একটি অনপেক্ষ সত্তায় কোনো প্রাপঞ্চিকতা নেই। এ কারণেই তা অবাচ্য ও অলক্ষ্য। এখন প্রশ্ন হলো, যা ‘বাগেন্দ্রিয়ে না সম্ভবে’ তাকে প্রকাশ করা যাবে কীভাবে এবং তাকে উপলব্ধিই বা করা যাবে কীভাবে? মহামতি নাগার্জুন এই সত্যকে বুঝেছিলেন, অতীশের গুরু চন্দ্রকীর্তিও বুঝেছেন। মহাযান ধারার সহস্র গ্রন্থের মর্মার্থও এই সত্যেরই উপলব্ধি। অতীশ বলছেন, কেউ যদি পরম সত্যরূপ শূন্যতাকে প্রত্যক্ষ ও অনুমানযোগে কিংবা উপমা প্রমাণের ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করতে চান, তবে তিনি বিফল হবেন। সরাসরি শূন্যতার ধ্যান করে এই সত্যকে জানা যাবে না। এই পরম সত্যকে উপলব্ধি করতে হলে উপায় হিসেবে নিতে হবে ব্যবহারিক সত্যকে। যে প্রতিভাস দিয়ে আমরা পরিবেষ্টিত হয়ে আছি, সেই সত্য থেকে অগ্রসর হয়েই পৌঁছানো যাবে পরম সত্যে। ব্যবহারিক সত্যকে এড়িয়ে গেলে জগতের কারণ ও শর্তগুলো দিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা প্রতারিত হতে থাকব। দুই ধরনের সত্যের প্রভেদকে স্বীকার করে ব্যবহারিক সত্যকে যৌক্তিকভাবে নিরীক্ষণ করতে হবে। চারদিকে প্রতিভাসিত যে জগৎ, তার যৌক্তিক অন্বেষণের ভেতর দিয়েই আমাদের অন্তর্দৃষ্টি উপলব্ধি করবে পরম সত্যকে।

No comments

Powered by Blogger.