কন্যাশিশুর ভ্রূণ হত্যা করবেন না by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

দিন দুয়েক আগে ঘটনাটি রাজধানীর এক ক্লিনিকে দেখা। ক্লিনিকের রিসিপশনে বসে কাঁদছে এক নারী। তার স্বামী কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। কিছুক্ষণ পরপর স্বামী ওই নারীর কাছে এসে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
দুই কন্যার মা ওই নারী বর্তমানে গর্ভবতী। আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোর্টে এসেছে_ গর্ভের ভ্রূণটি কন্যা। সে কারণে এই সন্তান ভূমিষ্ঠ করাতে রাজি নন তার স্বামী। কিন্তু ওই নারীর মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। অনেক অনুরোধের পরও স্বামীর মন গলেনি। তার সাফ কথা_ ছেলে না হলে আর কোনো সন্তানের প্রয়োজন নেই তার। বাধ্য হয়ে ওই নারীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই গর্ভপাত করাতে হলো।
বিশ্বজুড়ে গর্ভপাতের পক্ষ-বিপক্ষের লোকেরা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি উপস্থাপন করে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে থাকেন। অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানী, বিভিন্ন ধর্মীয় পণ্ডিত এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এভাবে গর্ভপাত সরাসরি শিশুহত্যা। কেননা, ভ্রূণ মানেই হচ্ছে শিশুর আকার। অন্যদিকে গর্ভপাতের পক্ষে তারা বলছেন, ভ্রূণ হত্যা মানে শিশুহত্যা নয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ভ্রূণ যদি মানবের পুরোপুরি আকারে রূপান্তর না হয় তাহলে তা শিশুহত্যা হতে পারে না। মোটকথা, বিশ্বজুড়ে গর্ভপাত নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক।
অনেকে অবশ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারকে এ পরিস্থিতির জন্য বেশি দায়ী করছেন। দম্পতিরা আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের মাধ্যমে গর্ভজাত সন্তানকে শনাক্ত করে এবং কন্যাশিশু হলে তার গর্ভপাত ঘটায়। বিরুদ্ধবাদীরা অবশ্য এটাকে প্রযুক্তির অপব্যবহার হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের মতে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানব সমাজের যে প্রভূত উন্নতি হয়েছে, এর তুলনায় প্রযুক্তির অপব্যবহারের চিত্র বেশি নয়। আর এ জন্য এককভাবে প্রযুক্তিকেও দায়ী করা চলে না। বস্তুত অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও বিভিন্ন কুসংস্কারমূলক সামাজিক রীতিনীতিই গর্ভপাতের প্রধান কারণ।
গর্ভপাতের নানা পদ্ধতি রয়েছে। যে কোনো পদ্ধতিতে গর্ভস্থ শিশুকে গর্ভের ভেতরেই মেরে ফেলা খুবই অমানবিক ও নৃশংস কাজ। এ কাজ মানুষের সহজাত প্রকৃতির বিরোধীও। ভ্রূণ হত্যার নৃশংসতা সেই অন্ধকার যুগকেই স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন মানুষ নিজ সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত। ইসলাম ধর্মে গর্ভপাতকে মারাত্মক পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। গর্ভবতী মায়ের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকলেই কেবল চিকিৎসকের অনুমতিসাপেক্ষে ইসলাম গর্ভপাতের অনুমতি দেয়। ইসলাম ধর্মমতে, গর্ভস্থ ভ্রূণ মানব সন্তান এবং অন্য সবার মতো ভ্রূণশিশুরও বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। ভ্রূণশিশু অস্তিত্ব লাভের পর কেউ তা হত্যা করার অধিকার রাখে না। যেমনিভাবে সন্তান জন্মলাভের পর বাবা-মা তার সন্তানকে হত্যার অধিকার রাখে না।
অনেকে গর্ভপাতকে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করলেও স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্নটি উঠে আসে তাহলো, ব্যক্তিস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে আসলে সমাজের মানবিক মূল্যবোধকে কোথায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? কারা কোণঠাসা করে দিচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ? অথচ বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের গর্ভপাত আইন (১৮৬০-এর ব্রিটিশ পেনাল কোড) অনুযায়ী গর্ভবতীর জীবন বাঁচানো ছাড়া অন্য কোনো কারণে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। এমনকি ধর্ষণ, শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক কারণ, ভ্রূণের বিকলাঙ্গতা_ এসব কারণেও গর্ভপাত আইনসিদ্ধ নয়। বাংলাদেশে গর্ভপাতকে কখনোই পরিবার পরিকল্পনার উপায় হিসেবে দেখা হয়নি এবং কোনো নারীকে তার অমতে গর্ভপাতে বাধ্য করা হলে দোষী ব্যক্তির ১০ বছরের জেল দেওয়ার বিধান রয়েছে।
বর্তমান সময়ে সাধারণত গর্ভপাত করানো হয় দুই কারণে। এক. অভাব; দুই. সামাজিকভাবে দুর্নাম ঘুচানো। বহু আগেই আল্লাহতায়ালা কোরআন কারিমে এ দুটি কারণ সূরা বনি ইসরাইলের ৩১ ও ৩২নং আয়াতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করে ইরশাদ করেন_ 'নিশ্চয় তোমার পালনকর্তা যাকে ইচ্ছা অধিক জীবনোপকরণ দান করেন এবং তিনিই তা সংকুুচিতও করে দেন। তিনিই তার বান্দাদের সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত, সবকিছু দেখছেন। দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। তাদের এবং তোমাদের আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদের হত্যা করা মারাত্মক অপরাধ। আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।'
বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে কী সংখ্যক গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে তা অজানা। বোধ করি এর সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরেও নেই। একটি গর্ভপাতের ঘটনার সঙ্গে অনেক বিষয় ও প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু সঙ্গত কারণেই গর্ভপাত সংক্রান্ত কোনো জবাবদিহিতার কথা কোনো জায়গা থেকেই শোনা যায় না। সামাজিক শিক্ষা ও আচার-আচরণ এসব বিষয়ে নীরব থাকতে উৎসাহিত করে সবাইকে। কিন্তু এই নীরবতা দিন দিন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসছে সমাজে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্বজুড়ে মানুষ এখন ভ্রূণ হত্যার প্রতিবাদে মুখর হচ্ছে। এই অন্যায়ের বিরোধিতা করছে। এ বিষয়ে সচেতনতা ও ধর্মীয় অনুশাসনের অনুগামিতাই পারে সমাজকে এই অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.