নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম আপনারা আইনের ঊর্ধ্বে? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

আদালতের সিদ্ধান্তে একজন চিকিৎসককে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে চট্টগ্রামের সব চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিয়েছেন। কার্যত বন্ধ রয়েছে রোগ নির্ণয়কেন্দ্রগুলোর সেবাও।
৬০ লক্ষাধিক জনসংখ্যার একটি শহরে এ ধরনের ‘প্রতিবাদ কর্মসূচি’ কী পরিমাণ ভীতিকর ও বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে, তা সহজেই বোধগম্য। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অবশ্য অব্যাহত রয়েছে চিকিৎসাসেবা। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় সরকারি হাসপাতালের শয্যা তো বটেই, মেঝেতে পর্যন্ত যখন রোগীর স্থান সংকুলান হয় না, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বার-ফেরত রোগীরাও ভিড় জমালে নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হতে বাধ্য।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘এ কর্মসূচি কোনো চিকিৎসককে রক্ষার জন্য নয়, পেশাগত মর্যাদা অটুট রাখার জন্য। চিকিৎসকদের এমন কর্মসূচি নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। মানবিক বিবেচনায় সব সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবা অব্যাহত রাখা হয়েছে। প্রাইভেট সেবা বন্ধ রাখার কারণে বিভিন্ন ডায়াগনসিসও বন্ধ রয়েছে। এমন কর্মসূচির কারণে কিছুটা দুর্ভোগ সৃষ্টি হলেও নিরুপায় হয়ে তা করতে হচ্ছে। আশা করি সংশ্লিষ্ট মহল এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিরসন করবে।’
‘মানবিক বিবেচনায়’ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সেবা দান অব্যাহত রাখার আশ্বাস বিএমএ নেতা দিয়েছেন বটে, কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, মা ও শিশু হাসপাতাল এবং জেনারেল হাসপাতাল ছাড়া আর তেমন কোনো পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল এ শহরে আছে কি না, সেটাও ভাবতে হবে। তা ছাড়া গত বুধবার হাসপাতালে রোগীদের ফেলে রেখে চিকিৎসকেরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন মানববন্ধন করতে। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলেছে এই কর্মসূচি। এ ধরনের কর্মসূচি তো আশ্বস্ত করার বদলে রোগীদের আতঙ্কিত করার কথা।
বিএমএ নেতা আশা করেছেন, সংশ্লিষ্ট মহল সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিরসন করবে। অর্থাৎ আদালতের রায় ‘সঠিক সিদ্ধান্ত’ নয়, সৃষ্ট পরিস্থিতি নিরসন করতে হলে সিদ্ধান্তটি পাল্টাতে হবে। প্রশ্ন আসে, রোগীদের জিম্মি করে যে সিদ্ধান্তটি তাঁরা চাইছেন, সেটি আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা কি না।
২০১২ সালের ৩০ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমিনুল ইসলামের মলদ্বারের অস্ত্রোপচার করার সময় শরীরের ভেতর সুচ রেখে দেন চিকিৎসক মো. সুরমান আলী। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাপারোস্কপিক, কলোক্টেরাল ও জেনারেল সার্জন। অস্ত্রোপচারের পর প্রচণ্ড ব্যথায় ভুগতে থাকেন আমিনুল। তাঁর মনে হতে থাকে, অপারেশনের স্থানে কিছু একটা রয়ে গেছে, এ কথা চিকিৎসককেও জানান তিনি। পরে আরও দুই দফায় অস্ত্রোপচার করা হয়। আমিনুলের ধারণা, এই দুই দফা অস্ত্রোপচারে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে আসলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতারণা করা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হলে চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে হয় তাঁকে। গত বছরের ৩০ জুন অ্যাপোলো হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে শরীর থেকে সুচটি বের করেন সেখানকার চিকিৎসক। এ ঘটনায় গত ২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করেন আমিনুলের মা। আরেকজন চিকিৎসক জাকির হোসেন অবশ্য দাবি করেন, যে অস্ত্রোপচারটির সময় শরীরে সুচ রেখে দেওয়া হয়েছিল, তার সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন। তাঁর কাছে আমিনুল এসেছিলেন অন্য একটি সমস্যা নিয়ে। তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। আত্মসমর্পণের পর সুরমান আলীর জামিন বাতিল করে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
চিকিৎসকদের পেশা ঝুঁকিপূর্ণ এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। চিকিৎসার ত্রুটি বা অবহেলার কারণে রোগীর নানা সমস্যা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হওয়ার ঘটনা এ দেশে যেমন ঘটছে, বিদেশেও এর নজির আছে। কিন্তু ব্যতিক্রম তো নিয়ম নয়। আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা প্রায় নিয়মে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কি না, এ প্রশ্নটিই আজ বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভুল চিকিৎসার কারণে, অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ আত্মীয়স্বজন হাসপাতাল বা বেসরকারি ক্লিনিকে ভাঙচুর চালানোর ঘটনা পত্রপত্রিকায় দেখা যায় প্রায়ই। এটা কাঙ্ক্ষিত নয় মোটেই, এতে শেষ পর্যন্ত ভোগান্তিতে পড়তে হয় অন্যান্য চিকিৎসাপ্রার্থীকে। তদুপরি অনেক সময় চিকিৎসকদের ত্রুটি ছাড়াও রোগীর আকস্মিক মৃত্যু তো ঘটতে পারে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ আত্মীয়স্বজনের এসব হামলা-ভাঙচুরের সঙ্গে চিকিৎসকদের ওপর একধরনের অবিশ্বাস বা আস্থাহীনতার সম্পর্ক আছে কি না ভেবে দেখতে বলি চিকিৎসক সমাজকে।
অধিকাংশ রোগ নির্ণয়কেন্দ্রের সঙ্গে চিকিৎসকের যোগসাজশ আছে বলে অভিযোগ আছে। এসব কেন্দ্রে রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের শতকরা ৩০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ান্তে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে দেওয়া আজ অলিখিত নিয়ম। বেশির ভাগ রোগনির্ণয় কেন্দ্রে টেকনিশিয়ানদের দেওয়া রিপোর্টের ওপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা শুধু স্বাক্ষর করে দায়িত্ব সারেন, এমন অভিযোগও নতুন নয়। ফলে একেকটি রোগনির্ণয় কেন্দ্র থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়া যেমন আজ স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি রোগীর দেহে ভুল করে দুরারোগ্য রোগের অস্তিত্ব আবিষ্কারের মতো ঘটনাও তো ঘটছে। এ ছাড়া ওষুধ কোম্পানিগুলোর ‘উপহার-উপঢৌকন’ গ্রহণ যেখানে নিয়মিত ও স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে চিকিৎসকদের নৈতিকতার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।
আমিনুলের মায়ের মতো সবাই আদালতে যান না বটে, কিন্তু বিশ্বাসে তো ফাটল ধরে। বলি না এ দেশে যোগ্য, দক্ষ ও ভালো চিকিৎসক নেই। কিন্তু নানা কারণে দেশের চিকিৎসক ও পুরো চিকিৎসাব্যবস্থা আজ ভাবমূর্তির সংকটে। চট্টগ্রামের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ‘প্রতিবাদ কর্মসূচি’ সেই সংকটকে আরও গভীর করবে।
সুরমান আলীর বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের বিষয়টি যদি অন্যায় ও অন্যায্য মনে হয়, আদালতে যেতে পারত বিএমএ। আইনি লড়াইয়ের পরিবর্তে রোগীদের জিম্মি করে ‘পেশাগত মর্যাদা অটুট রাখার’ প্রক্রিয়াটি তাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েই থাকল। আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত যেমন বলেছেন, ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধের নামে চিকিৎসকদের এই আন্দোলন বেআইনি। এর মাধ্যমে তাঁরা আদালত অবমাননার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে অপরাধীকে ছাড়ানোর জন্য আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।’
মাত্র কয়েক দিন আগে ইন্টার্নি চিকিৎসকদের ধর্মঘটে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চমেক শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতির ওপর ছাত্রশিবিরের কর্মীদের হামলার প্রতিবাদে কর্মবিরতিতে গিয়েছিলেন ইন্টার্নি চিকিৎসকেরা। হাসপাতাল গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। এতে একদিকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন রোগীরা, অন্যদিকে তাঁদের আত্মীয়স্বজন পড়েছিলেন কঠিন দুর্ভোগে। রোগীর দেখভাল করা, দোকান থেকে ওষুধ বা বাড়ি থেকে খাবার আনা-নেওয়ার সুযোগও পাননি অনেকে।
ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ আমাদের দেশে নিয়মিত ঘটনা। সতীর্থের ওপর হামলা-সহিংসতা হলে তার প্রতিবাদ নিশ্চয়ই করবেন ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা। কিন্তু মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের তো মনে রাখতে হবে, তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি মানুষের সবচেয়ে দুঃসময়ের আশ্রয়স্থলও!
যা-ই হোক, চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধের প্রসঙ্গটিতে ফিরে আসি। আর কদিন এ কর্মসূচি চলবে এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি বলেছেন, যত দিন পর্যন্ত এ মামলা প্রত্যাহার ও আটক চিকিৎসককে মুক্তি দেওয়া না হবে, তত দিন এই কর্মসূচি চলবে।
সবিনয়ে প্রশ্ন করি, এই সময়ের মধ্যে যেসব রোগী চিকিৎসার অভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়বেন, মৃত্যুবরণ করবেন—তার দায় কার? এই রোগীদের অনেকেই দিনের পর দিন এই চিকিৎসকদের চেম্বারে গিয়ে টাকা দিয়ে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন, চিকিৎসার ধারাবাহিকতা রক্ষার ন্যূনতম দায়টাও কি অস্বীকার করতে পারেন তাঁরা? মানুষের জীবন-মরণের ব্যাপারটি সামনে রেখে যাঁরা ‘সংশ্লিষ্ট মহল’-এর সঙ্গে দর-কষাকষি করতে চান, তাঁদের কর্মসূচিকে আর যা-ই হোক ‘মানবিক’ বলার উপায় নেই।
 বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.