আয় ১,৭৪,১২৯ কোটি টাকা  ব্যয় ২,২২,৪৯১ কোটি টাকা  ঘাটতি ৪৮,৩৬২ কোটি টাকা ‘অশোভনীয় আশাবাদের’ বাজেট

দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট দিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এই বাজেট দৈর্ঘ্যে বড়, আকারে বিরাট এবং প্রতিশ্রুতিতেও বিশাল। চার বছরের উন্নয়নের খতিয়ান দিতে গিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ১৮৫ পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি।
নির্বাচনী বছরে ব্যয়ের বিশাল চাপ মেনে প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটি টাকার বড় আকারের বাজেট তৈরি করেছেন। আর সবাইকে খুশি করতে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী।
বড় প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, মোট দেশজ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। কমবে মূল্যস্ফীতি। ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য অর্থমন্ত্রীর। বাড়বে বিনিয়োগ। আদায় হবে রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, তার কোনো পরিকল্পনা বাজেটে নেই। বিনিয়োগ বাড়াতে অর্থমন্ত্রী জোর দিয়েছেন নানা ধরনের শুল্ক ছাড়ের ওপর। অথচ বিনিয়োগ না হওয়ার বড় কারণ অবকাঠামোর সমস্যা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। শুধু শুল্ক ছাড়ের ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা কতখানি সফল হবে, সে প্রশ্নের উত্তর দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতার কোথাও দেননি অর্থমন্ত্রী।
ফলে শেষ পর্যন্ত এবারের বাজেট আশাবাদের বাজেট। তবে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ধার করে বলা যায়, আগামী ২০১৩-১৪ অর্থবছরের নতুন বাজেট জনতুষ্টে ‘অশোভনীয় আশাবাদের’ বাজেট।
অর্থমন্ত্রী সবাইকে খুশি করতে চেয়েছেন। প্রায় সব খাতেই দিয়েছেন নানা ধরনের কর ছাড়ের সুবিধা। আবার খানিকটা রবিনহুডের ভূমিকাও নিতে চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বড়লোকদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে গরিবদের মাঝে বিলানোর মতো করে বেশি সম্পদশালীদের ওপর অতিরিক্ত কর বসানো হয়েছে। তবে বড় সখ্য দেখিয়েছেন কালোটাকার মালিকদের ওপর। কালোটাকার মালিকদের সঙ্গে একটা গোপন সম্পর্ক সব সময়ই সরকারের থাকে। আর নির্বাচনী বছরে সেই সম্পর্ক ডালপালা ছড়ায়। কালোটাকার মালিকদের সঙ্গে এই সখ্য যে রাজনীতিতে একধরনের সমঝোতা, তা অর্থমন্ত্রী তিন বছর আগেই বলেছিলেন। আবারও সমঝোতা করলেন তিনি। যদিও তিনি মেনে নিয়েছেন যে, কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ আগে অনেক দেওয়া হলেও কখনোই তেমন ফল পাওয়া যায়নি। তার পরও কেন বারবার একই সুযোগ দেওয়া হয়, সেই ব্যাখ্যা অবশ্য অর্থমন্ত্রী দেননি।
সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। গবেষকেরা বলছেন, গত চার বছরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ। তবে সরকার কখনোই তা স্বীকার করেনি। বরং আয় বাড়ার নানা বক্তৃতা দেওয়া হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় কমার একধরনের স্বীকৃতি পাওয়া গেল অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেটে। তিনি সীমিত আয়ের মানুষের জন্য নানা ধরনের ছাড় দিয়েছেন। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে, বাড়িভাড়া ও যাতায়াত ভাতায় বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে। এতে আগের তুলনায় কম আয়কর দিতে হবে অসংখ্য করদাতাকে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা সীমিত আয়ের মানুষ এর ফলে অনেকটাই স্বস্তি পাবেন। স্থানীয় উদ্যোক্তাদেরও নানাভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে নতুন বাজেটে। শুল্ককাঠামোয় কিছু পরিবর্তনও এসেছে।
সব মিলিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে ভোটারদের খুশি করতে একটি জনতুষ্টিমূলক বাজেটই দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ব্যয় বাড়িয়েছেন। ব্যয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে বড় আয়েরও পরিকল্পনা দিয়েছেন। রাজস্ব অংশে কর আদায়ের তুলনায় কর রেয়াতের কথাই বেশি বলেছেন অর্থমন্ত্রী। ভোটারদের মন জয়ের কথাই সম্ভবত বেশি ভেবেছেন তিনি। এত বড় রাজস্ব আদায় নিয়ে শঙ্কা আছে খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)।
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু নিজ অর্থে করার পরিকল্পনা দিয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারের (পিপিপি) আওতায় বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলেছিলেন প্রথম বাজেটে। একই কথা বললেন এবারও। অর্থনীতিতে পিপিপির অবদান শূন্য।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে অর্থমন্ত্রী এবার ভর্তুকি কমিয়েছেন। আবার রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগাতে থোক বরাদ্দ বাড়িয়েছেন। সরকারি কর্মচারীদের খুশি করতে নতুন বেতনকাঠামো করার কথা বলেছেন। ফলে চারদিকেই ব্যয় বাড়ানোর বিশাল এক পরিকল্পনা আছে বাজেটে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী যখন এই বাজেট উপস্থাপন করেন, তখন বিরোধী দল বিএনপি উপস্থিত ছিল না। জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বিএনপি এলেও বাজেট পেশের সময় না থাকাটা চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কথাই বলে দেয়। এর স্বীকৃতিও রয়েছে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায়। তিনি বলেছেন, ‘হঠকারী রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে দেশের অর্থনীতির ওপর প্রায় জমে যায় কালো মেঘের ছায়া। তবে মনে হচ্ছে, নৈরাজ্য সৃষ্টির এই প্রচেষ্টা বাধা পেয়েছে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’ অর্থমন্ত্রীর আরও একটি আশাবাদ রয়েছে। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আমি মনে করি, আমাদের পরে যাঁরাই আসবেন, তাঁরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব তুলে নেবেন।’
বাজেট পরিসংখ্যান: জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত এই বাজেট ছিল মহাজোট সরকারের শেষ বা পঞ্চম বাজেট। নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী দুই লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বাজেটের প্রস্তাব করেছেন।
বাজেটের মোট আকারের মধ্যে রাজস্ব প্রাপ্তি ও বৈদেশিক অনুদান মিলিয়ে সরকারের আয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৭৪ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে তা ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে মোট প্রাপ্তির মধ্যে করের অংশ এক লাখ ৪১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর-নিয়ন্ত্রিত কর এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা এবং এনবিআর-বহির্ভূত কর পাঁচ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া কর ব্যতীত প্রাপ্তি ২৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক অনুদান ছয় হাজার ৬৭০ কোটি টাকা।
এনবিআর-নিয়ন্ত্রিত করের মধ্যে আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) থেকে। পরিমাণ ৪৯ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে এর পরিমাণ নয় হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বেশি। এর পরই রয়েছে আয় ও মুনাফার ওপর কর, ৪৮ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য তা ছিল ৩৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
ব্যয়: ব্যয়ের মধ্যে মূল অঙ্কটিই হলো অনুন্নয়নমূলক ব্যয়। এই অঙ্ক এক লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। আর অনুন্নয়ন রাজস্ব ব্যয় হলো এক লাখ ১৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ২৬ হাজার তিন কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ এক হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া রয়েছে অনুন্নয়নমূলক মূলধন ব্যয় ২০ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা এবং ঋণ ও অগ্রিম ১৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা।
বাজেটে মোট উন্নয়ন ব্যয় ৭২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। এর বাইরেও এডিপি-বহির্ভূত প্রকল্পের জন্য উন্নয়ন ব্যয় রয়েছে তিন হাজার ১৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাজস্ব বাজেট থেকে উন্নয়ন খাতে যাবে এক হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা এবং এডিপির বাইরে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ও স্থানান্তর বাবদ ব্যয় হবে এক হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা।
অর্থসংস্থান: অর্থসংস্থানের মধ্যে মোটা দাগে দুটি ভাগ রয়েছে। বৈদেশিক ঋণ ও অভ্যন্তরীণ ঋণ। আগামী অর্থবছরের জন্য বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ২৩ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে নয় হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামীবারের জন্য নিট বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেবে ৩৩ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেবে ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে স্বল্প মেয়াদে ১১ হাজার ৬৩৮ কোটি এবং দীর্ঘ মেয়াদে ১৪ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা।
আর ব্যাংক-বহির্ভূত উৎস থেকে নেওয়া হবে সাত হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প থেকে চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে তিন হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে।
জিডিপি ও ঘাটতি: আগামী অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরেও এই হার একই ধরা হয়েছিল। জিডিপির মোট আকার চলতি অর্থবছরের ১০ লাখ ৪১ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৮৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে অনুদান বাদে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে অনুদানসহ বাজেট ঘাটতি ৪৮ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা অর্থাৎ জিডিপির ৪ শতাংশ। দেশের মানুষের মাথাপিছুু আয় বেড়ে হয়েছে এখন ৭৪ হাজার ৩৮০ টাকা বা ৮৩৮ ডলার।

No comments

Powered by Blogger.