নীরব ভোটার by লায়েকুজ্জামান ও এমএ হায়দার সরকার

ভোটাররা নীরব। মুখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কোন প্রার্থীকেই কথা দিচ্ছেন না। প্রার্থীরা গেলে হু বলে বিদায় দিচ্ছেন। দু’পক্ষেই মাথা নাড়ছেন। দু’প্রার্থীর চা, পান, বিড়ি নিচ্ছেন হাসিমুখে।
ভোটারদের এ নীরবতায় বাস্তবে জয়-পরাজয়ের কোন ধারণা নিতে পারছেন না প্রার্থীরা। ভোটারদের ব্যাপক এ নীরবতায় উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগ। চার সিটি করপোরেশন এবং সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের বিপুল বিজয়ে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগ কর্মীরা। সেদিক থেকে উল্লসিত বিএনপি শিবির। ওই সব বিজয়ের কথাই জোরেশোরে গাজীপুরে প্রচার করছে বিএনপি। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কৌশল বদল করে গণসংযোগে নেমেছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা। জাতীয় রাজনীতির বদলে তিনি প্রচারণায় সামনে তুলে ধরছেন স্থানীয় বিষয়াদি, তার দীর্ঘদিনের সেবার কথা। অন্যদিকে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নান সামনে আনছেন জাতীয় রাজনীতির নানা ঘটনা, সরকারের সাফল্য, ব্যর্থতা, হামলা-মামলা এবং হেফাজতের বিষয়।
নতুন গঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এটা প্রথম ভোট। উত্তর-দক্ষিণে ২০ এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৬ কিলোমিটার আয়তনের বিশাল ওই সিটি করপোরেশনের ভোটার সংখ্যা ১০ লাখ ২৬ হাজার ৯৩৮। তাদের মধ্যে নারী ভোটার ৪ লাখ ৯৯ হাজার ১৬১। সাবেক টঙ্গী পৌরসভা, গাজীপুর পৌরসভা এবং মাঝখানে গাজীপুর সদর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন। সদর উপজেলার ওই ৬টি ইউনিয়ন হচ্ছে- পুবাইল, গাছা, বাসন, কাউলতিয়া, কোনাবাড়ি ও কাশিমপুর। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লা’র বাড়ি টঙ্গীবাজার এলাকায়। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী এমএ মান্নানের বাড়ি গাজীপুরের কাউলতিয়া ইউনিয়নে। পুরো সিটি করপোরেশন এলাকা নিয়ে জাতীয় সংসদের গাজীপুর-২ আসন। ওই আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের জাহিদ আহসান রাসেল। বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী এমএ মান্নান ওই আসনের সাবেক এমপি। ১৯৯১ সালে তিনি ওই আসন থেকে এমপি হয়ে মন্ত্রী হন। আজমত উল্লা টঙ্গী পৌরসভার সাবেক মেয়র, তিনি তিনবারের নির্বাচিত মেয়র। সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার আগে গাজীপুর ও টঙ্গী দুটি পৌরসভারই সাবেক মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগদলীয়। গাজীপুরে ছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং টঙ্গীতে আজমত উল্লা। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলেই ভাগাভাগি আছে, গ্রুপিং আছে। আওয়ামী লীগে আজমত উল্লা’র সঙ্গে সুপ্ত বিরোধ আছে এমপি জাহিদ আহসান রাসেলের। সে বিরোধ টঙ্গী ছাড়িয়ে গড়িয়েছে গাজীপুর পর্যন্ত। জেলা নেতা আতাউল্লাহ মণ্ডল ও এডভোটে ওয়াজিউদ্দিন জড়িয়ে আছেন সে বিরোধে। আওয়ামী লীগের সুপ্ত বিরোধের ফসল হচ্ছে বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। দলের ওই বিদ্রোহী প্রার্থী এখন পুরো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এক বিষফোঁড়া। তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও রেশ থেকে যাবে নির্বাচনে- এমনটাই ধারণা করছে এখানকার রাজনৈতিক মহল। গাজীপুরে বিভক্তি আছে বিএনপিতেও। এখানে বিরোধ আছে এমএ মান্নান ও হাসানউদ্দিন সরকারের মধ্যে। সে বিরোধে অংশ আছে গাজীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শাহান শাহ আলমেরও। একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড স্থানীয় বিএনপির বিরোধের একটি মীমাংসা করেছে হাসানউদ্দিন সরকারকে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। সিটি করপোরেশন এলাকায় টঙ্গী একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সেই স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকাল থেকে। শিল্প-কারখনা এবং শ্রমিক আধিক্যের কারণে টঙ্গীর ওই রাজনৈতিক গুরুত্ব। বর্তমানে টঙ্গী এলাকার ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ২৫ হাজার। এখন গাজীরপুর সদরের দিকে ভোটার বেশি। সেখানে ভোটার ৭ লাখের ওপরে। টঙ্গী ও গাজীপুরে সব নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ফ্যাক্টর আগত ভোটার। এখানে ১০ লাখ ভোটারের মধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখ ভোটারই অস্থানীয়। বিভিন্ন জেলা থেকে এসে এরা টঙ্গী ও গাজীপুরে বসতি গড়েছে। নির্বাচনে স্থানীয় ও অস্থানীয় ইস্যুটি মাথাচড়া দিয়ে ওঠে। এখানে ভোটের আরেকটি বড় ফ্যাক্টর শ্রমিক ভোটার। ছোট-বড় গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার শিল্প-কারখান আছে সিটি করপোরেশন এলাকায়। শিল্প-কারখানার মধ্যে এখন গার্মেন্টের সংখ্যা বেশি। নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, এখানে শ্রমিক ভোটার সংখ্যা আড়াই লাখের কিছু বেশি। ওই ভোটারদের মধ্যে একটি বড় অংশ এসেছে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও বৃহত্তর ফরিদপুর থেকে। এরা বেশির ভাগ গার্মেন্ট শ্রমিক। অন্য পেশার সিংহভাগ শ্রমিক নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার। টঙ্গীতে বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় একচেটিয়া মালিকানা কুমিল্লা ও নোয়াখালী থেকে আগত লোকদের হাতে। এমএ মান্নান ও আজমত উল্লা দু’জনই এখানকার আদি বাসিন্দা। তাদের পূর্বপুরুষরা এখানকার লোক।
বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নান এলাকায় জনপ্রিয়। ৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ নেই মানুষের। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী এডভোকেট আজমতা উল্লা ব্যক্তিজীবনে ভাল মানুষ হিসেবে পরিচিত। তার ব্যক্তি আচরণ নিয়ে কারও অভিযোগ নেই। তিনবার তিনি টঙ্গী পৌরসভার মেয়র হয়েছেন। দুর্র্নীতির কোন অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে। নির্বাচনের রূপ স্থানীয় হলে সুবিধা পাবেন আজমত উল্লা। জাতীয় ইস্যু প্রাধান্য পেলে সুবিধা যাবে এমএ মান্নানের কাছে- এমনটাই জানা গেছে এখানকার রাজনৈতিক-সচেতনদের সঙ্গে কথা বলে।

No comments

Powered by Blogger.