ময়মনসিংহে সংস্কৃতি চর্চার সেকাল-একাল

মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরী ময়মনসিংহ শহরের ‘শশীলজ’-এ (বর্তমানে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, মহিলা-ময়মনসিংহ) প্যারিস থেকে তিন লাখ টাকায় একটি মিউজিক্যাল স্টেয়ার কেস-‘সঙ্গীত সিঁড়ি’ স্থাপন করেছিলেন।
দ্বিতল রাজপ্রাসাদের ওপরে ওঠার সিঁড়িতে স্থাপন করা হয়েছিল এই মিউজিক্যাল স্টেয়ার কেস। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় এক ধরনের সঙ্গীত সুর বেজে উঠত এতে। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন বিকেলে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। দেড় মিনিট স্থায়ী এই ভূমিকম্পে জমিদারী বিলাসের সাক্ষী শশীলজ ধসে পড়ে। সুসংয়ের রাজা জগৎকৃষ্ণ সিংহ পুত্রসহ দালানচাপায় মারা যান। এ সময় শশীকান্ত ছিলেন কলকাতায়। টেলিগ্রামে কলকাতায় এই খবর পাঠানো হলে শশীকান্ত প্রথমেই জানতে চাইলেন, হুয়াট এবাউট মাই স্টেয়ার কেস। এরকম সঙ্গীত পাগল ছিলেন ময়মনসিংহের জমিদার পরিবারগুলো। জমিদার পরিবারের এরকম সঙ্গীত পিপাসার প্রভাবেই শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রাচীন জেলা ময়মনসিংহ গান বাজনার দিক থেকে কোন কালেই পিছিয়ে ছিল না। সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক ময়মনসিংহে গান বাজনার চর্চা চলে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। এজন্য কেউ কেউ রসিকতা করে বলে গু-সবহ-ংরহম- আমার মানুষ গান করে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বেলায়েত খাঁ, নজাকত আলী, সালামত আলী, মোহাম্মদ আলী, খাদিম হোসেন খাঁ, মীর কাশিম খাঁর মতো কিংবদন্তি ওস্তাদগণ ময়মনসিংহে এসে সঙ্গীত পিপাসুদের তৃষ্ণা মিটিয়েছেন যুগ যুগ ধরে। মুসলিম গীগের জনসভায় গান গেয়েছেন মরহুম আব্বাস উদ্দিন। সঙ্গীত পিপাসু স্থানীয় জমিদাররা শিল্পীদের লালন ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন নিজেদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, গৌরীপুর, রামগোপালপুর ও শহর ময়মনসিংহের রাজপরিবারে এসব গুণী শিল্পীর ছিল বেশ কদর, অবাধ যাতায়াত। রাজপরিবারের রঙ্গমঞ্চ ছাড়াও সঙ্গীত চর্চা ও নাটকের জন্য ওই সময়ে ময়মনসিংহে গড়ে তোলা হয়েছিল বেশ কয়েকটি ওপেন স্থাপনা। সঙ্গীত পিপাসু গৌরীপুর জমিদারদের নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ ও নাচঘর থাকার পরও সর্বসাধারণের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল আলাদা একটি মঞ্চ। পরে সেটি ঝলমল সিনেমা হল হিসেবে পরিচালনা করা হয়। একইভাবে রামগোপালপুর ও মুক্তাগাছা জমিদারদের বাসাবাড়িতেও ছিল আলাদা রঙ্গমঞ্চ। মুক্তাগাছা রাজবাড়ির ভেতরের নাচঘরে ছিল রিভলভিং স্টেজ। নাচ করার সঙ্গে এই মঞ্চটি অনবরত ঘুরত বলেই এই নামকরণ। তবে ময়মনসিংহে জমিদার পরিবারে এরকম কিছু না থাকলেও নাট্য ও সঙ্গীত চর্চার আয়োজনে কোন কমতি ছিল না।
ব্রিটিশ অধীন অবিভক্ত ভারতে ১৭৮৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা হিসাবে জন্ম লাভ করলেও সঙ্গীত ও নাট্য চর্চাসহ সংস্কৃতির বিকাশে শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছিল না কোন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর উদ্যোগে ১৮৮৬ সালে শহরে প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয় টাউনহল মিলনায়তন। এর নাম ছিল প্রথমে সূর্যকান্ত হল। এই হলরুমে জমিদার পরিবারের সদস্যরা মিলিত হতেন নানা অনুষ্ঠানে। ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের বার্ষিক মুখপত্র অরণি’র ২০০৭ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত শাহাদাত হোসেন খান হীলুর ‘টাউন হল মঞ্চ ও ময়মনসিংহের মঞ্চ প্রসঙ্গ’ থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসক ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আমন্ত্রিত হতেন জমিদার পরিবারের অনুষ্ঠানে। হলরুমের চারপাশে ছিল নানা বৃক্ষরাজির ছায়া শীতল পরিবেশ। সারি সারি বৃক্ষরাজির ফাঁকে ফাঁকে ছিল দর্শক শ্রেুাতাদের বসার কাঠের বেঞ্চ। পাক-ভারত উপ মহাদেশের নামকরা বিখ্যাত সব ওস্তাদ এখানে গানের জলসা বসাতেন এবং তা চলত রাতভর। তখন জমিদার পরিবারের সদস্যদের জন্য এই হলরুমে প্রজেক্টর দিয়ে নির্বাক ছবিও দেখানো হতো। ময়মনসিংহে জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তাগাছা জমিদার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী পরিবারের মুক্তাগাছা রাজবাড়ির নাচঘরে ছিল রিভলভিং স্টেজ (ঘূর্ণায়মান কাঠের মঞ্চ)। পরে কাঠের তৈরি ঘূর্ণায়মান এই রঙ্গমঞ্চটি টাউন হল মিলনায়তনে স্থাপন করা হয়েছিল দর্শক শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখতে। পূর্ব পাকিস্তানে এটিই ছিল একমাত্র ঘূর্ণায়মান মঞ্চ। এছাড়া ওই সময়ে এটি ছিল ময়মনসিংহের নাচ গান ও নাটকের জন্য প্রধান উন্মুক্ত মঞ্চ। তখন এর সঙ্গে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগারও ছিল। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে এর নামকরণ করা হয় ময়মনসিংহ টাউন হল। প্রতি রবিবার প্রজেক্টর দিয়ে এখানে আমেরিকান তথ্য চিত্র দেখানো হতো। একাত্তরে পাক সেনারা টাউন হলে ঘাঁটি করে। এ সময় টাউন হলের মঞ্চের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে পাক সেনারা। তারপরও ঐতিহ্যবাহী এই টাউন হলকে ঘিরে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বহুরূপী নাট্য সংস্থা, জাগ্রত নাট্য গোষ্ঠী ও যাত্রিক নাট্য গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। এসব নাট্য গোষ্ঠীর বছরজুড়ে নাট্যোৎসব ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন টাউন হলে তাদের নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। এসবের বাইরে আন্তঃজেলা নাট্য উৎসব, কবিতা উৎসবসহ সাংস্কৃতিক উৎসবে মুখর থাকত এই টাউন হল। এ সময় কতশত ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে তার সংখ্যা জানা না গেলেও নাট্য ব্যক্তিত্ব ও বহুরূপী নাট্য সংস্থার সভাপতি শাহাদাত হোসেন খান হীলু জানান, এর প্রভাবে ময়মনসিংহে নাট্যকর্মী ও শিল্পী সাহিত্যিকদের মধ্যে একটা ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। জন্ম হয়েছিল অসংখ্য নাট্য গোষ্ঠী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের। হলের পেছনে ছিল পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা দুটি সাজঘর। তবে হলের ভেতরে বসার কোন স্থায়ী ব্যবস্থা ছিল না। আয়োজকদের ভাড়া করে চেয়ার আনতে হতো বাইরে থেকে। হলের এক পাশে ছিল নাট্য গোষ্ঠীর অফিস। সাজগোজ আর রিহার্সেলে ব্যস্ত থাকত তখন এর আঙিনা। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালে টাউন হলের প্রথম সংস্কার করে ৩২০টি স্থায়ী চেয়ার বসানোসহ মঞ্চ মেরামত করে সাজানো হয়েছিল। সচল করা হয়েছিল ঘূর্ণায়মান কাঠের মঞ্চ। ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে আন্তঃজেলা নাট্যোৎসব হয়েছিল এই মঞ্চে। ১৯৯১ সালে ক্যাপেস্টেন ফিল্টার নাট্যোৎসব হয়। আবহ সঙ্গীতের পাশাপাশি এ সময়ে আলোক বিন্যাস ও মঞ্চ সজ্জায় আনা হয় ব্যাপক পরিবর্তন। ফলে দর্শক-শ্রোতাদের উপস্থিতিতে প্রাণ ফিরে পায় ময়মনসিংহের নাট্যঙ্গন। ওই সময়ে বহুরূপী, জাগ্রত ও যাত্রিকের সঙ্গে তরুণ নাট্যদল, চান তারা ক্লাব, ঝিলিক নাট্য সংস্থা, মুখোশ ও বিদ্রোহী নাট্য গোষ্ঠী দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়ন করত টাউন হলে। ভেঙ্গে ফেলার আগ পর্যন্ত টাউন হলের প্রাঙ্গণ ছিল মুখর। ময়মনসিংহ পৌরসভা পরিচালিত এই টাউন হলটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত ও অব্যহৃত থাকার পর ২০০০ সালে ভেঙ্গে সংস্কার কাজ চললেও এখনও খুলে দেয়া হয়নি দর্শকদের জন্য। ফলে জায়গা ও চর্চার অভাবে বহুরূপী নাট্য সংস্থা ছাড়া বতর্মানে শহরে আর কোন নাট্য গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। কবে নাগাদ এই টাউন হলের সংস্কার কাজ শেষ করে দর্শক শ্রোতাদের জন্য খুলে দেয়া হবে নিশ্চিত করে বলতে পারছে না পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। ফলে নাটক ও সঙ্গীত চর্চায় এক ধরনের বন্ধ্যত্ব চলছে ময়মনসিংহে। টাউন হলের বাইরে ময়মনসিংহের অমরাবতী নাট্য মন্দির, ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন সাইদুল হক মিলনায়তন, কেওয়াটখালি নাট্য মঞ্চ, সেনবাড়ি মঞ্চ, মুসলিম ইনস্টিটিউট, পাবলিক হল ও জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা মঞ্চেও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করেছে। তবে এর অনেক মঞ্চের কোন অস্তিত্ব নেই এখন। ময়মনসিংহের প্রথম সিনেমা হল ছিল লক্ষ্মীনারায়ণ পিকচার প্যালেস। পরবর্তীতে এর নাম দেয়া হয় ছায়াবাণী সিনেমা হল। টাউন হল প্রতিষ্ঠার এক বছর আগে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত অমরাবতী নাট্য মন্দিরে এই সিনেমা হল পরিচালিত হয়ে আসছে।
অমরাবতী নাট্য মন্দিরের সঙ্গে ছায়াবাণী সিনেমা হলের চুক্তি অনুযায়ী নাটকের প্রয়োজনে সিনেমা বন্ধ রাখা হতো। ১৯৬৭ সালে সংস্কার কাজের পর বেশ কিছু নৃত্য নাটক মঞ্চায়ন করা হয়েছে। স্বাধীনতাপরবর্তী অমরাবতীতে তেমন কোন নাটক মঞ্চায়ন হয়নি বললেই চলে। অমরাবতী নাট্য মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা অমরাবতী নাট্য সমাজের নাট্যদল থাকলেও কার্যক্রমও নেই এখন। তবে আছে অমরাবতী কমিটি। এই নাট্য মন্দিরে অভিনয় করে গেছেন কলকাতার অহীন্দ্র চৌধুরী, পাহাড়ী সান্যাল ও ছবি বিশ্বাসের মতো খ্যাতিমান অভিনয় শিল্পী। এসবের নেপথ্যে ছিলেন মূলত ময়মনসিংহের সঙ্গীতপ্রিয় জমিদার পরিবার।
১৯৩৪ সালে মাধব রাও নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে অমরাবতী নাট্য মন্দির মঞ্চের উদ্বোধন করা হয়। দু’তলা দর্শক গ্যালারি, দু’তলা সেট, দৃশ্য সজ্জার বিশালসব উপকরণ ও বিশাল মঞ্চ ব্যবস্থাসহ সেই সময়ে এটিই ছিল আধুনিক রঙ্গমঞ্চ। তবে বর্তমানে এখানে নাটক মঞ্চায়ন না হলেও মাঝে মধ্যে রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশ চলে। এর বাইরে বছর জুড়ে সিনেমা চলে। ২০০৩ সালে ছায়াবাণীসহ এক যোগে চার সিনেমা হলে জেএমবি বোমা হামলায় প্রাণহানির সঙ্গে হলটির ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছিল। বোমা হামলার পর থেকে ময়মনসিংহের সংস্কৃতি চর্চা ও নাট্যঙ্গনে এক ধরনের বন্ধ্যত্ব চলছে।

-বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ

No comments

Powered by Blogger.