কেনাকাটার কমিটিতেই শুধু মন্ত্রীরা সক্রিয় by আশরাফুল হক রাজীব

যেখানে কেনাকাটা নেই, সেখানে বৈঠকও নেই। কেনাকাটা থাকলে বৈঠক হয় মাত্রাতিরিক্ত। সরকারের প্রথম তিন বছরে গুরুত্বপূর্ণ আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক হয়েছে মাত্র আটটি। অথচ ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক হয়েছে ১০৮টি।
গুরুত্বপূর্ণ অন্য মন্ত্রিসভা কমিটিগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে।
সরকারের প্রথম তিন বছরে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক হয়েছে ৪৩টি। অথচ দেশের অর্থনৈতিক বিষয়াদি পর্যালোচনার এটা অন্যতম ফোরাম। দেশে বিনিয়োগ কমেছে, সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতাবস্থায় রয়েছে- এ অবস্থায় অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত কমিটি আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত। বিষয়টি অনুধাবন করে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে আরো বেশি সক্রিয় করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
সাম্প্রতিক সময়ে রামু ধ্বংসযজ্ঞ, রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ ও অস্থিরতা, রোহিঙ্গাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো এবং সর্বশেষ পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের ধারাবাহিক হামলার পরও আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেনি। হলমার্ক এবং ডেসটিনি কেলেঙ্কারির পরও অনেকটাই নিশ্চুপ অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। অথচ ব্যাংক, বীমা ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নীতি পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের দায়িত্ব এ কমিটির।
প্রথম তিন বছরে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য দূর করার জন্য গঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক হয়েছে মাত্র দুটি। অথচ সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে বেতন স্কেলের ব্যত্যয় ঘটছে। জুডিশিয়াল সার্ভিসের বেতন নিয়ে অচলাবস্থা চলছে। অর্থসচিবকে কয়েকবার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় পুরস্কারসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ১৪টি এবং প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের বদলিসংক্রান্ত কমিটির ছয়টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আবার সম্ভাবনাময় পর্যটন নিয়ে গত এক বছরে কোনো বৈঠকই হয়নি।
সামাজিক নিরাপত্তাবলয় কর্মসূচির সার্বিক তত্ত্বাবধানসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি, বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি, ড্যাপ বাস্তবায়নসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিও রয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে। ইস্যুভিত্তিক এসব মন্ত্রিসভা কমিটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার মাধ্যমে তাদের কাজ শেষ করে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সাবেক মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক হাফিজউদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের জন্য মন্ত্রীদের তাগিদ থাকে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক স্বার্থ থাকে। অনেক সময় সচিবদেরও স্বার্থ থাকে। এ ছাড়া স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট গ্রুপ তো রয়েছেই। তাঁদের বিভিন্ন কেনাকাটা ক্রয় কমিটিতে আটকে থাকে। এসব সামাল দিতে ঘন ঘন ক্রয় কমিটির বৈঠক ডাকা হয়। কারণ যত বেশি কেনাকাটা, তত বেশি লাভ। কেনাকাটা না করতে পারলে লাভ হবে না। এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এখানে আরো একটি বিষয় যোগ করা উচিত তা হলো, উন্নয়নকাজ করার জন্যও এ কমিটির বৈঠক দরকার হয়।'
আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করা হবে এ কমিটিতে। যেসব কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে সে কারণগুলো পর্যবেক্ষণ ও চিহ্নিত করে এগুলো দূর করার সুপারিশ করবে এ কমিটি। হরতাল, ধর্মঘটসহ যেসব ঘটনা জনগণের সাধারণ জীবনযাত্রা ব্যাহত করতে পারে সেগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এজেন্সির করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেবে। এ ছাড়া জনজীবনে দুর্ভোগ ডেকে আনতে পারে যেসব বিষয় সে সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়াও এ কমিটির কাজ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সারা দেশে জামায়াতে ইসলামী পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রাজতৈক অস্থিরতাও আছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বৈঠক করে এ-সংক্রান্ত এজেন্সিগুলোকে পরামর্শ দিতে পারে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ আমলে নেয় না। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভা কমিটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সরকারের প্রথম বছরের তুলনায় দ্বিতীয় বছরে খুন, ডাকাতি, এসিড নিক্ষেপ, অস্ত্র বা বিস্ফোরকসংক্রান্ত অপরাধ হ্রাস পেলেও ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন, রাহাজানি বেড়ে যায়। সরকারের প্রথম বছরের তুলনায় দ্বিতীয় বছর ধর্ষণ বাড়ে ৩৭৫টি, অগ্নিসংযোগ বাড়ে ৫৪টি, নারী নির্যাতন বাড়ে চার হাজার ২৮৬টি এবং রাহাজানি বাড়ে ৪০টি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রামুতে যে কাণ্ড ঘটেছে সে জন্যই আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির একটি বিশেষ সভা হতে পারত। এর ওপর সারা দেশে পুলিশের ওপর স্বাধীনতাবিরোধীদের যে তাণ্ডব, তা থামানোরও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ভারতে রামুর মতো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক ডাকা হতো। এ ধরনের বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাও উপস্থিত থাকেন। আর আমাদের দেশে এ কমিটির বৈঠকই হয় না।'
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা'দত হুসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক হবে কি না, তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতির ওপর। তাঁরা হয়তো বা টেলিফোনেই আলাপ সেরে নেন!
সরকারি ক্রয় এবং অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার উভয় কমিটির প্রধান হচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ ছাড়া পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান উভয় কমিটির সদস্য। তাঁদের বাইরে ক্রয় কমিটিতে রয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, খাদ্যমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক ও রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক। অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. এস এ সামাদ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে ঘুরেফিরে এ মন্ত্রীরাই রয়েছেন। তাঁদের বাইরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুও আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্য।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেন, রামুর ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক না হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজর রয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটির দেওয়া প্রতিবেদন নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। শিগগিরই আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকও হবে বলে তিনি জানান। অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত এবং সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উভয় মন্ত্রিসভা কমিটির সদস্য পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, বৈঠক হয় প্রয়োজন অনুযায়ী। ক্রয় কমিটির বৈঠক একটু বেশি হবে- এটাই স্বাভাবিক।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিসভা কমিটির আরো বেশি বৈঠক হয়তো হতে পারত। অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক আরো বাড়ানোর নির্দেশনাও রয়েছে। মন্ত্রিসভা কমিটি পুনর্বিন্যাস হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.