‘রানার মাঠে’ দাপুটে জয় by উৎপল শুভ্র

ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামটাতেই শুধু মিল। ২০০৭ বিশ্বকাপ হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে। আর এখানে প্রতিপক্ষের নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তার পরও কোথায় এসে ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ আর ২০১২-এর ৩০ নভেম্বর যেন বারবার মিলে যেতে চাইল! মিলিয়ে দিলেন মানজারুল ইসলাম রানা!
২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন সড়ক দুর্ঘটনায় রানার মৃত্যুসংবাদ উড়ে গিয়ে বিমূঢ় করে দিয়েছিল বাংলাদেশ দলকে। মাশরাফি বিন মুর্তজাকে সবচেয়ে বেশি। পরদিন ম্যাচে একটা দৃশ্য হূদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছিল। মাশরাফি উইকেট পান আর সজল চোখে আকাশের দিকে তাকান, যেন মেঘের মধ্যে খুঁজে বেড়ান প্রিয় বন্ধুকে!
কালও রানার নামটা উড়ে বেড়াল বাতাসে। দুপুরে ম্যাচের মাঝখানে বোর্ড সভাপতি মানজারুল ইসলাম রানার নামে স্টেডিয়ামের একটা গ্যালারি নামকরণের পুরোনো দাবি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেন। বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে জয় রানাকে উৎসর্গ করেছিল বাংলাদেশ দল। এখানেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ব্যাটে-বলে দাপুটে জয় রানাকেই উৎসর্গ করলেন মুশফিকুর রহিম। সঙ্গে স্মরণ করলেন আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে মৃতদেরও।
মিল তো আরও অনেকই আছে। ম্যাচে প্রথম উইকেট মাশরাফির, রাজ্জাকের ৩ উইকেট, তামিমের ঝোড়ো হাফ সেঞ্চুরি, মুশফিকুর রহিমের দলকে জিতিয়ে ফেরা...সাত সমুদ্র তের নদী ওপারের পোর্ট অব স্পেন যেন খুলনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বিশ্বকাপের ওই ম্যাচে আবহটা এমন ছিল, রানা যেন না থেকেও আছেন। মরণের ওপারের রহস্যজনক ওই জগৎ থেকে দেখছেন সব। কাল খুলনায় গ্যালারি উপচে পড়া দর্শক, অদৃশ্য হয়ে রানাও কি ছিলেন তাদের সঙ্গে!
তাহলে তো দেখেছেন, নয় বছর পর তাঁর কীর্তির পুনরাবৃত্তি করছেন বাংলাদেশের আরেক স্পিনার। চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেকে প্রথম ওভারের তৃতীয় বলেই উইকেট নিয়েছিলেন রানা। এত দিন একমেবাদ্বিতীয়ম্ হয়ে থাকা সেই কীর্তি আর রানার একার থাকতে দিলেন না সোহাগ গাজী। উইকেট নিয়ে নিলেন ওয়ানডেতে তাঁর দ্বিতীয় বলেই। সেটিও কী উইকেট!
গেইল তখন মাত্রই ‘গেইল’ হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। মাশরাফি ও হাসানের দুর্দান্ত বোলিংয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে হঠাৎই মাশরাফির পর পর তিন বলে ছয়, চার ও চার। একটু পর প্রথম ৪ ওভারে মাত্র ৯ রান দেওয়া আবুল হাসানকেও দিলেন একই উপহার। বেচারা হাসান! পঞ্চম ওভারের প্রথম বলেই যেখানে ওয়ানডেতে প্রথম উইকেট পেয়ে যান, উল্টো ওই লাঞ্ছনা! উইকেট না পাওয়ার দায়ও সোহাগ গাজীর। মিডঅনে লেন্ডল সিমন্সের যে ক্যাচটা ছেড়েছেন, সেটি ছাড়া বড় কঠিন ছিল।
কিন্তু এই ছেলেটাও বড় কঠিন ছেলে। শুধু নেতিবাচক অর্থেই ‘কঠিন কাজ’ করে বসে থাকবেন, এমন পাত্র তিনি নন। প্রথম ওভারটি উইকেট-মেডেন, বাংলাদেশের আর কোনো বোলারের যে কীর্তি নেই। দ্বিতীয় ওভারে তুলে নিলেন স্যামুয়েলসকেও। ওয়ানডেতে ১১টি বল করার পর সোহাগ গাজীর বোলিং বিশ্লেষণ ১.৫-১-১-২!
পরে যোগ করেছেন আরও ২ উইকেট। ড্যারেন ব্রাভোকে রান আউট করার কৃতিত্বও তাঁর। সব মিলিয়ে যাকে বলে হিরণ্ময় অভিষেক! ঢাকায় ৯ উইকেট নিয়ে টেস্ট অভিষেকে বাংলাদেশের পক্ষে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড গড়েছিলেন। ওয়ানডে অভিষেকে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটাও যোগ হলো এর সঙ্গে। ২৯ রানে ৪ উইকেটে এল ম্যাচসেরার স্বীকৃতিও। আরেকটি প্রথমের সঙ্গেও যুক্ত হলো সোহাগ গাজীর নাম। এই প্রথম ওয়ানডে অভিষেকেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার।
এই ম্যাচকে ঘিরে অস্বস্তির একটা বাতাবরণ ছিল। সাকিব আল হাসানের অপূরণীয় শূন্যতা ছিল, সঙ্গে টেস্ট যুগে প্রথমবারের মতো এক ম্যাচে চারজন নতুনকে নামিয়ে দেওয়া, ওয়ানডের নতুন নিয়ম, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে পাওয়ার হিটারের ছড়াছড়ি...শুধুই আবেগের চোখ দিয়ে খেলা দেখা ক্রিকেটানুরাগী ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশের জয়ের আশা করেছিলেন কি না সন্দেহ! আবদুর রাজ্জাক অবশ্য দাবি করছেন, তিনি আশাবাদীদের দলেই ছিলেন। উইকেটে বোলারদের জন্য তেমন কিছু আছে বলে মনে হলো না, তবে রাজ্জাক এর সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছেন চট্টগ্রামের উইকেটের। ৩৯ রানে ৩ উইকেট নিয়ে সোহাগ গাজীর সঙ্গে যোগ্য সংগত করেছেন, তাঁর কথা তাই উড়িয়েই বা দেন কীভাবে!
চট্টগ্রামের প্রসঙ্গ অবশ্য এমনিতেও আসত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বশেষ ওয়ানডে ছিল চট্টগ্রামেই। সেই যে গত বছরের নভেম্বরে ৬১ রানের সেই ম্যাচ। এটি তাই ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের টানা দ্বিতীয় জয়। এটি তো শুধু দ্বৈরথের হিসাব। তা না করে যদি সর্বশেষ চার ম্যাচের হিসাব নেন, সবিস্ময়ে দেখবেন, এর তিনটিতেই জয়ী দলের নাম বাংলাদেশ! সেটিও কী সব দলের বিপক্ষে—ওয়েস্ট ইন্ডিজের আগে শ্রীলঙ্কা ও ভারত! কালকের জয়ে নিউজিল্যান্ডকে ৯ নম্বরে নামিয়ে দিয়ে ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ উঠে এসেছে ৮-এ।
সেই জয়ে সোহাগ গাজী সূর্যের মতো আলো ছড়াতে পারেন, তবে তাঁর পাশে তারা হয়ে জ্বলেছেন আরও অনেকেই। রাজ্জাকের কথা তো বলাই হলো। এই উইকেটে ২০০ রান কোনো রানই নয় সত্যি, তবে তামিম-এনামুলের ৮৮ রানের উদ্বোধনী জুটির আগে কি আর তা এমন জোর দিয়ে বলা গেছে! তামিম যথারীতি ‘তামিম’, ৫১ বলে ৫৮ ওয়ানডেতে তাঁর টানা পঞ্চম হাফ সেঞ্চুরি। সঙ্গে গেইলকে আউট করতে লং অনে যে ক্যাচটি নিয়েছেন, তাতে ম্যাচসেরা হিসেবে সোহাগের প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁকে ভাবাই যেত। তিন নম্বরে নেমে অপরাজিত হাফ সেঞ্চুরিতে নাঈম করেছেন ইনিংসটা ধরে রাখার কাজ।
ম্যাচের ফল নিয়ে কোনো সংশয়ই তাই জাগেনি কখনো। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের মাঝামাঝি থেকেই তো এই ম্যাচে সম্ভাব্য বিজয়ী একটা দলই। ১৩৩ রানে ৮ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর রামপল-নারাইনের ৫৭ রানের জুটিটা গলায় ছোট একটা কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ম্যাচ শেষে অবশ্য সেটি আর উল্লেখযোগ্যই থাকল না। ৫৮ বল বাকি থাকতে ৭ উইকেটের জয়ে তা থাকেও না।
পুরস্কার বিতরণী শেষেই কোচ শেন জার্গেনসেনকে নিয়ে মুশফিকুর রহিম ছুটে গেলেন রোববার দ্বিতীয় ম্যাচের উইকেটের দিকে। পাঁচ ম্যাচের সিরিজ, এখনো লম্বা পথ বাকি। তবে সিরিজ জয়ের স্বপ্ন কেন দেখবেন না বাংলাদেশ অধিনায়ক! খুলনা থেকে ২-০ নিয়ে ঢাকায় যাওয়াও এখন আর আকাশকুসুম কল্পনা নয়। বড় একটা প্রেরণা তো আছেই। এই মাঠে তিন ওয়ানডের তিনটিতেই জয়।
রানার মাঠে বাংলাদেশ হারে না!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৪৬.৫ ওভারে ১৯৯
বাংলাদেশ: ৪০.২ ওভারে ২০১/৩
ফল: বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী

No comments

Powered by Blogger.