উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব- আসর মাতালেন রশিদ খাঁ by আশীষ-উর রহমান ও হারুন আল রশীদ

‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে, ইয়ে দুখ সেহেনে না যায়ে’—জনপ্রিয় এই ঠুমরি গেয়ে আসর মাত করলেন ওস্তাদ রশিদ হোসেন খাঁ। গতকাল শুক্রবার বেঙ্গল-আইটিসি এসআরএ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের দ্বিতীয় দিনের প্রথম প্রহরটি নিজের করে নিয়েছিলেন তিনি অসাধারণ পরিবেশনা দিয়ে।
রশিদ খাঁ শুরু করেছিলেন রাত নয়টায়। বিলম্বিত একতাল ও দ্রুত তিনতালে পুরিয়া কল্যাণ রাগে খেয়াল শুনিয়েছেন প্রায় দেড় ঘণ্টা। এরপর তিনি শুনিয়েছেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর কালজয়ী ঠুমরি ‘ইয়াদ পিয়া কি...’। সঙ্গে ছিল পণ্ডিত জ্যোতি গুহের জাদুকরি হাতের হারমোনিয়াম এবং পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের তবলার বাদন। শীতের রাতে শহুরে দর্শক-শ্রোতারা নিমগ্ন হয়ে ছিলেন সুরের ইন্দ্রজালে।
শীতের সময়টি বহুকাল থেকেই এ দেশে উৎসবের মৌসুম বলে খ্যাত। আকাশের কুয়াশার চাদর, কনকনে হাওয়া, সন্ধ্যার পর গায়ে গরম কাপড় চাপিয়ে গান-বাজনার আসরে উপস্থিত হওয়ার রেওয়াজ লোকজীবনে চলে আসছে। সারা দেশেই শীতের সময় লোকগানের আসরের আয়োজন হয়ে থাকে। উচ্চাঙ্গসংগীতের ঐতিহ্যও আমাদের অনেক পুরোনো। হালে চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেই ঐতিহ্য ম্লান হয়ে পড়েছে। তবে ভালো আয়োজন হলে শ্রোতার যে অভাব হয় না, এই উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবে গত দুই দিনের অধিবেশনে তা দেখা গেছে।
রাতভর আর্মি স্টেডিয়াম-ভর্তি শ্রোতা-দর্শক গভীর আগ্রহে উপভোগ করেছেন শাস্ত্রীয় সংগীতসুধা।
এই উৎসব আয়োজনের প্রধান সহযোগী প্রথম আলো। এ ছাড়া সহযোগী হিসেবে আছে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার এবং মাছরাঙা টেলিভিশন।
গতকাল দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন শুরু হয় সন্ধ্যার পর। প্রথমে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। স্বাগত বক্তব্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নামে যেকোনো একটি মহাসড়কের নামকরণের দাবি করেন।
আলাউদ্দিন খাঁর নামে সড়কের নামকরণ করার প্রস্তাব সমর্থন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট পর্যন্ত মহাসড়কের নাম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নামে করা যেতে পারে। এ বিষয়ে সবাই একমত হলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে একসময়ে উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা ছিল। যেকোনো কারণেই হোক, সেই চর্চা কমে গেছে। আশা করা যায়, এই উৎসবের মধ্য দিয়ে সে চর্চার ধারা ফিরে আসবে। এই উৎসবের প্রথম দিন দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে যে মনঃসংযোগ দেখা গেছে, তা আশাবাদী হওয়ার মতো।
সংক্ষিপ্ত আলোচনা অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন আইটিসি এসআরএর নির্বাহী পরিচালক রবি মাথুর।
সংগীতপর্ব শুরু হয়েছিল এআরএ অন স্ট্রিংসের দলীয় যন্ত্রসংগীত পরিবেশনা দিয়ে। এরপর দেবর্ষি ভট্টাচার্য পরিবেশন করেন শুদ্ধ কল্যাণ রাগে খেয়াল। রাগের শেষের বন্দিশটি ছিল তিনতালে ‘বাজো বাজো রে...’।
গানের পরে তবলার বোল। শিল্পী যশোবন্ত বৈষ্ণব শুনিয়েছেন তিনতালের রেলা, লহরা বিভিন্ন কায়দা। তাঁর সঙ্গে সারঙ্গীতে সংগত করেন ওস্তাদ আল্লারাখা কলাবন্ত। সারঙ্গীর মূর্ছনা আর তবলার বোল মাতিয়ে তুলেছিল শ্রোতাদের।
বাদনের পর খেয়ালে রাগ কেদার শোনান সন্দ্বীপ ভট্টাচার্য। বিলম্বিত একতাল দিয়ে শুরু করে দ্রুত তিনতালে শেষ করেন বন্দিশটি। গানের পরে আবার বাদন। সরোদ পরিবেশন করেন রাজরূপা চৌধুরী। তাঁকে তবলায় সহযোগিতা করেন ওস্তাদ আকরাম হোসেন খাঁ। বাদন শেষে তাঁদের উৎসবের স্মারক তুলে দেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা।
ওস্তাদ রশিদ খাঁ মঞ্চে এলে তাঁকে শুভেচ্ছা জানান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। রশিদ খাঁর পরিবেশনার পর অধিবেশনে প্রথম পর্ব শেষ হয়। বিরতির পর সেতার বাজিয়ে দ্বিতীয় পর্ব শুরু করেন আদনান খান। অধিবেশনের পরের শিল্পীরা ছিলেন পণ্ডিত শিব কুমার শর্মা, ওস্তাদ মশকুর আলী খাঁ, পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও কৌশিকী দেশিকান।
উৎসবে আজ
আজ শনিবার উৎসব চলবে বিকেল পাঁচটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। আজকের দিনটি উৎসর্গ করা হয়েছে পণ্ডিত উদয় শঙ্করকে।
আজ উৎসব আলোকিত করবেন আরশাদ আলী খান (কণ্ঠ), এবাদুল হক (সেতার), শশাঙ্ক মাক্তেদার (কণ্ঠ), আবির হোসেন (সরোদ), প্রিয়াংকা গোপ (কণ্ঠ), কুমার মারদার (কণ্ঠ), পণ্ডিত কুমার বোস (তবলা), বিদুষী শুভ্রা গুহ (কণ্ঠ), পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায় (সেতার), বিদুষী গিরীজা দেবী (কণ্ঠ) ও পণ্ডিত বিরজু মহারাজ (কত্থক)।

No comments

Powered by Blogger.