শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন- এগিয়ে চলেছেন কামরুন্নাহার by মোহাম্মদ খায়রুল হক

‘আমরা এমন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে জনগণ সম্মান ও নিরাপত্তা নিয়ে বাস করবে, নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকবে।’ বলছিলেন কামরুন্নাহার লিপি (২৯)। শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন। এখন তিনি ‘নারী নেত্র কারুপণ্য’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। সংগ্রামী এই নারীর বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলার অনন্তপুর গ্রামে। তাঁর তৈরি শপিং ব্যাগ এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত দেড় শ মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠানে। কামরুন্নাহার বলেন, আত্মপ্রত্যয়ী আর পরিশ্রমী হলে যে কারও পক্ষে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। এই বিশ্বাসই যেন তাঁর সংগ্রামের মূলমন্ত্র।
সংগ্রামী জীবন: নয় ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম কামরুন্নাহার। এতগুলো ভাইবোনের সব চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল না স্কুলশিক্ষক বাবার পক্ষে। তাই ছোটবেলা থেকেই অভাবকে ভালোভাবে চিনেছিলেন। অভাবের সঙ্গে লড়াই করেই পাস করেন এইচএসসি। আর যেন এগোতে পারছিলেন না। জীবিকার তাগিদে ২০০৪ সালে তাই মাসিক ৬০০ টাকা বেতনে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ নেন। দিন-রাত কাজ করতেন। এভাবে দু-তিন বছর এমন পরিশ্রম করার পর বেতন বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার টাকা। কিন্তু কাজ করে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। বুঝতে পেরেছিলেন, এখানে কাজ করে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূরণ হবে না। তাই নিজেই কিছু করার কথা ভাবলেন। সেই মতো ২০০৮ সালে ছাড়লেন চাকরি। সঙ্গে পুঁজি হিসেবে ছিল একসময়ের নেওয়া সেলাই প্রশিক্ষণ।
সম্প্রতি এক সকালে অনন্তপুর গ্রামে কামরুন্নাহারের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মুখেই শোনা গেল সংগ্রামী জীবনের কাহিনি।
সেলাই প্রশিক্ষণ থাকলেও নিজের সেলাই মেশিন ছিল না কামরুন্নাহারের। তাই পরিচিত একজনের কাছ থেকে একটি মেশিন ধার নেন। সেই মেশিন দিয়ে আশপাশের পাঁচজন নারীকে সেলাইয়ের কাজ শেখান। একদিন কোনো এক কাজে জেলা শহরে গিয়ে দেখেন ফুটপাতে ছোট ছোট দোকানে কম দামে বাচ্চাদের হাফপ্যান্ট বিক্রি হচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে এক দোকানির কাছ থেকে জেনে নিলেন, কত টাকা দিয়ে কোথা থেকে প্যান্টগুলো আনানো হয়। সব জেনে আরও কম দামে সেই প্যান্ট তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। এতে দোকানিও রাজি হলেন। বাড়ি ফিরে কাজ শুরু করলেন। কিন্তু এভাবে প্যান্ট বিক্রি করে তেমন লাভ হতো না।
একসময় কামরুন্নাহার জানতে পারেন, ঢাকায় কেজিদরে কাপড় বিক্রি হয়। খোঁজ-খবর নিয়ে ঢাকায় গিয়ে সেই কাপড় কিনে আনলেন। ওই কাপড়ে প্যান্ট বানিয়ে মোটামুটি লাভ হতে থাকল। এমনি একবার ঢাকায় গিয়ে তাঁর চোখ পড়ে কাপড়ের তৈরি শপিং ব্যাগে। তিনি খেয়াল করলেন, প্যান্টের চেয়ে এই ব্যাগ বানানো সহজ। সঙ্গে সঙ্গে একটি ব্যাগ কিনে ফেললেন। বাড়িতে গিয়ে ব্যাগটি খুলে প্রথমে নিজে এটি তৈরির কৌশল শিখে নেন। পরে সেই পাঁচ নারীকে শেখান। এরপর শুরু করেন ব্যাগ তৈরির কাজ। স্থানীয়ভাবেই সেই ব্যাগ বিক্রি করে ভালোই লাভ হতে থাকল। ব্যাগের মধ্যে ফোন নম্বর থাকায় সেই নম্বরে ফোন করে অনেকে তা কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল বিক্রি।
বিদেশে গেল ব্যাগ: এরই মধ্যে ভারত ও সৌদি আরবে এই শপিং ব্যাগ বিক্রি করছেন কামরুন্নাহার। ‘আমার তৈরি ব্যাগ নেত্রকোনার অধিকাংশ দোকানে পাওয়া যায়। প্রবাসী কেউ স্থানীয় দোকান থেকে পণ্য কিনলে তা দিয়ে আমার তৈরি ব্যাগে করে বিদেশে নিয়ে যান। ব্যাগের গায়ে আমার মুঠোফোন নম্বর রয়েছে। বিদেশ থেকে সেই নম্বরে ফোন করে আমার কাছে ব্যাগ চাওয়া হয়।’ বলেন তিনি। সৌদি আরব ও ভারতে কিছুদিন পর পর ১৫ থেকে ২০ হাজার ব্যাগ পাঠাচ্ছেন কামরুন্নাহার। ২০১০ সালে প্রথম বিদেশে ব্যাগ পাঠান তিনি। চাহিদা দেখে চটের ব্যাগও তৈরি করা শুরু করলেন। সম্প্রতি ইতালি থেকে চটের ব্যাগের অর্ডার পেয়েছেন। ১৫টি সাইজে (আকার) ব্যাগ তৈরি করছেন কামরুন্নাহার।
নারী নেত্র কারুপণ্য: প্রতিষ্ঠান গড়ার শুরুতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়ার সুবিধা পেতে উপজেলা সমবায় কার্যালয় থেকে ‘নারী নেত্র উন্নয়ন সমিতি’ নামে নিবন্ধন নেন কামরুন্নাহার। ধীরে ধীরে সেলাই প্রশিক্ষণ, স্ক্রিন প্রিন্টসহ নানা কার্যক্রম শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানটি আর সমিতি হিসেবেও নেই। গত বছর ‘নারী নেত্র কারুপণ্য’ নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালানো শুরু করেন।
কামরুন্নাহারের প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে অন্তত দেড় শ জন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছেন।
কামরুন্নাহার জানালেন, এখানে কাজ করতে আসা অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখন আবার পড়াশোনা শুরু করেছেন। তিনি নিজেও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ছেন।
নারী নেত্র কারুপণ্যে কর্মরত ইয়াসমীন জানালেন, প্রায় তিন বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। বেশ ভালোই চলছে তাঁর। এখানে ছয় মাস পর পর আনুপাতিক হারে পারিশ্রমিক বাড়ানো হয়। রেজিয়া বেগম (২১) শুরু থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। গত বছর এইচএসসি পাস করেছেন। পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন বলে জানালেন। মুনমুন আক্তার (১৭) বলল, ‘এখানে কাজ করে ভালো লাগছে। এখানে যা পাই, তা দিয়ে পরিবার নিয়ে চলতে পারতেছি। আমি প্রতিষ্ঠানের উন্নতি কামনা করি।’
শুধু ব্যবসা নয়, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস যেমন: স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, নারী দিবস পালন করে নারী নেত্র কারুপণ্য। এসব অনুষ্ঠানে অসহায় দরিদ্র নারীদের সম্পৃক্ত করা হয়।
তাঁদের কথা: নারী নেত্র কারুপণ্য সম্পর্কে স্থানীয় কাইলাটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নাজমুল হক বলেন, কামরুন্নাহার আত্মপ্রত্যয়ী। নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন। তাঁর মতো আত্মপ্রত্যয়ী হলে সমাজের চেহারা পাল্টে দেওয়া সম্ভব। নেত্রকোনা বিসিক শিল্পনগরের উপব্যবস্থাপক শাহ নূরুজ্জামান বলেন, ‘কামরুন্নাহারের প্রতিষ্ঠানটি দেখেছি। তাঁর উদ্যোগের সফলতা কামনা করি।’
স্বীকৃতি: সংগ্রামের স্বীকৃতিও পেয়েছেন কামরুন্নাহার। বিভিন্ন সময়ে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা তাঁকে পুরস্কৃত করেছে।

No comments

Powered by Blogger.