বিজয়ের মাসে মনে এলো by শামসুজ্জামান খান

আমাদের বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রটির পিতৃপুরুষরা (Founding Fathers) আমাদের জাতীয় আত্মবিকাশের ইতিহাসকে তার মৌলিক ও যৌক্তিক স্বভাবে অনুভব করেই রাজনৈতিক সংগ্রামের কৌশল নির্ধারণ করেছিলেন। এটা তাঁদের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়েছিল।
একসময় সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের কূটকৌশল ও বিভেদনীতির শিকার হয়ে তাঁরাও তাঁদের পূর্ববর্তী রাজনীতিকদের মতো ধর্মীয় ও সাম্প্র্রদায়িক রাজনীতির আবর্তে আটকা পড়ে আমাদের সমাজ বিকাশের অসাম্প্রদায়িক ধারা ও স্বকীয় প্রবণতার কথা বিস্মৃত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক অদ্ভুত ও সম্ভাবনাহীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের। কিন্তু ধর্মীয় বাতাবরণে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে শাসিত পাকিস্তান নামের সামন্তবাদী রাষ্ট্রটির শোষণ, নির্যাতন ও জাতিগত নিপীড়নের নির্মমতায় তাঁদের চোখ খুলে যায়। ফলে তাঁরা নতুন করে তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ও কার্যক্রমকে বিন্যস্ত করতে থাকেন। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহাসিক বিকাশ-ধারায় যে পরধর্মসহিষ্ণু জীবনচর্যা অনুসৃত, যে অসাম্প্র্রদায়িক জীবনচেতনা লালিত- তারই অনুসরণে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র (Nation-state) নির্মাণের প্রক্রিয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই শুরু হয়ে যায়। তৎকালীন ছাত্ররাজনীতির তরুণ তুর্কিরা এ ধারার সূচনা করেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এই নবনির্মাণে সমবেত হয়। ১৯৪৮-১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে আমাদের এই ভৌগোলিক, অসাম্প্র্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রাথমিক কিন্তু মৌলভিত্তি নির্মিত হয়। পূর্ব বাংলার তরুণ সমাজের এই জাতি ও রাষ্ট্রচিন্তা ছিল আশ্চর্যজনকভাবে সজীব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানসম্মত। এই চিন্তাকে পাকিস্তান নামক সামন্ততান্ত্রিক ও সামরিকচক্রের সুদৃঢ় ব্যূহের ভেতর থেকে বের করে আনার জন্য ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হয়েছে। এ ধাপগুলো অতিক্রম করার জন্য বাঙালির রাজনৈতিক বোধের তীক্ষ্নতা ছাড়াও নানা ধরনের পন্থার সহায়তা নিতে হয়েছে। ইলা মিত্র, মণি সিংহ প্রমুখের নেতৃত্বে কৃষকদের নিয়ে তেভাগা, টঙ্ক আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহ প্রভৃতি ছাড়া অন্যগুলো ছিল প্রধান নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রাম, যেমন নির্বাচন। বাঙালি ২৫ বছরে মাত্র দুটি নির্বাচন হাতে পেয়েছে। এ দুটি নির্বাচনকেই পূর্ব বাংলার বাঙালি অমোঘ অস্ত্র হিসেবে পরিচ্ছন্ন দক্ষতায় ব্যবহার করেছে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জাতীয় ঐকমত্যের প্রধান তিনটি দলের যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে এ ধারার যুগান্তকারী সূচনা। এর মূলধারাটি ছিল মুসলিম লীগের ধর্মীয় রাজনীতি এবং সামন্তবাদী শোষণ ও বর্বরতাকে প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় বিকাশের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত ধারাবাহিকতাকে অর্থাৎ অসাম্প্র্রদায়িক ও সমন্বয়বাদী জীবনধারানির্ভর নতুন রাজনীতির সূত্রপাত। ১৯৫৪-৭০- এই ১৬ বছরে পূর্ব বাংলার পোড়-খাওয়া মানুষ আরো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। পাকিস্তানি শোষকদের পূর্ব বাংলাকে শোষণের জন্য লাগাতার সামরিক শাসন জারি রাখার বিপরীতে নানা অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে সিভিল সমাজ ও রাজনীতি গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। যুক্তফ্রন্টের তিক্ত অভিজ্ঞতা অনৈক্যের আশঙ্কা সম্পর্কে তাদের সচেতন করেছে। ওই সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার দিকে দৃষ্টি রেখে জোটের রাজনীতির বিপরীতে একক দলের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয় ঐক্যের উপযোগী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৬৬ সালে দেওয়া তাঁর ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব বাংলার বিপুল মানুষের স্বপ্নকল্পনাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। পাকিস্তানের শাসকচক্র ও তার এ দেশীয় দালালরা তখন শত নির্যাতন করেও শেখের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে পারছে না, তিনি তখন হয়ে উঠেছেন জনগণের নন্দিত নেতা, তাদের দেওয়া উপাধিতে ভূষিত 'বঙ্গবন্ধু'। এ সময় ছাত্রদের ১১ দফা এবং মওলানা ভাসানীর সংগ্রামী রাজনীতির ধারা এতে যুক্ত হয়ে '৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানকে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষ তাদের সব ক্ষমতা তাদের প্রিয় ও বিশ্বস্ত নেতা বঙ্গবন্ধুর হাতেই তুলে দিয়েছিল। আর তিনি ১৯৭০-এর নির্বাচনকে বলেছিলেন ছয় দফার পক্ষে রেফারেন্ডাম বা গণভোট। '৭০-এর নির্বাচনের আগে ১২ নভেম্বর যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়, তাতে পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের সীমাহীন ঔদাসীন্য বাংলার মানুষকে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার ব্যাপারে মরিয়া করে তোলে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে শাসকের অনুভব-অনুভূতির শীতল ও অমানবিক মানসিকতা শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এবং ১৯৭১-এ এই লড়াই করেই অর্জন করতে হয় বাঙালির প্রথম প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের পূর্ব অংশের বিলুপ্তি এবং বাংলাদেশের উদ্ভবের প্রধান কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তাঁর জীবনব্যাপী নিষ্ঠা, ত্যাগ, প্রজ্ঞা ও আপসহীন লড়াই করার ক্ষমতার জন্য জনগণের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি ছিল অতুলনীয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৯টি মাস তিনি পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি ছিলেন; কিন্তু তাঁর নামটি ছিল জনসাধারণের কাছে বিকল্পহীন আরাধ্য বস্তু। ওই নাম নিয়ে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করা ছিল নিতান্তই তুচ্ছ ঘটনা। তবে শুধু বঙ্গবন্ধু নন, বাংলাদেশের সৃষ্টিতে তাঁর পর যাঁর নাম উল্লেখ করতে হয় তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের ধীমান সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। এই নির্লোভ, নিষ্ঠাবান ও মেধাবী নেতার অসহযোগ আন্দোলনের সময় তৈরি নিপুণ নির্দেশমালা এবং অনৈক্য ও কোন্দলের জন্য খ্যাত বাঙালিদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন সফল মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসাধারণ নেতৃত্ব বাঙালি জাতি কোনো দিন ভুলতে পারবে না। মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ ও স্বাধীনতার পক্ষের অন্য নেতাদের নামও শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ্য। এরপর আসে সমবেতভাবে তরুণ ও ছাত্রসমাজ এবং বিশেষভাবে কৃষকসহ নানা স্তরে বিভক্ত নিম্ন পেশার সাধারণ মানুষের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা। পুলিশ, বিডিআরের ভূমিকা ২৫ মার্চের রাত থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর নামে যে ঘোষণা দেন, তাতে জনগণের মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে বাঙালি সৈনিকরাও মুক্তিসংগ্রামে শামিল হয়েছেন, অতএব মুক্তিযুদ্ধ জোরদার হবে। যুদ্ধের সময় খালেদ মোশাররফের বিক্রমের কথাও খুব শোনা গেছে। অবশ্য সবার ওপরে জনসাধারণ- বাংলাদেশের উদ্ভবে তাদের যুগ যুগ লালিত ইচ্ছা, আশা, ঐতিহাসিক স্বাধীনতার আর্তি ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাই মূর্ত হয়েছে। তবে সামরিক বাহিনীতে যেমন শহীদ 'বীরশ্রেষ্ঠরা' আছেন, জনগণের মধ্য থেকে মরণপণ যুদ্ধ করলেও এ ধরনের সম্মান কেউ পাননি। ফলে সুদূর ভবিষ্যতে এমন ধারণা হতে পারে যে মুক্তিযুদ্ধ করে শুধু বাঙালি সৈনিকরা, জনগণ নয়।
হাজার বছরের সংগ্রাম ও সাধনায় যে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে, বাঙালির ইতিহাসে তা সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। একটি জাতীয়, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্র্রদায়িক ও মুক্তবুদ্ধিভিত্তিক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন এবং তা বিপুল আত্মত্যাগে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন- এটাই পূর্ব বাংলার বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরবগাথা। ইতিহাসের বিচারে তাঁদের এই সাফল্য কোনো দিন ম্লান হবে না। নানা পর্যায়ে রাষ্ট্রের মূল চরিত্র পরিবর্তন করে একটি ইসলাম বা মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে রূপ দেওয়ার নানা কূটকৌশল ও চক্রান্ত চললেও শেষ পর্যন্ত স্বমহিমায় আবির্ভূত হবেই। বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করলেই স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবে।
দেশে নির্বাচিত গণসমর্থনপুষ্ট সরকার থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতাবিরোধী ও মৌলবাদী চক্র দেশে ভয়ংকর তৎপরতায় লিপ্ত। নৈরাজ্য ও ত্রাস সৃষ্টি করে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য। একটি বড় দল তাদের সহায়তা করছে। একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক দেশে এমন অবস্থার কথা কল্পনা করাও কঠিন। অথচ এই দুষ্টচক্র ভেঙে দিয়ে পুলিশ ও বিডিআর মাত্র দু-তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে দেশে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন স্বার্থের সমীকরণে এটা হচ্ছে না। বরং তারাই সন্ত্রাসীদের হাতে মার খাচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়েও সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাস চালাচ্ছে। সন্ত্রাসীরা অপরাধী, তাদের নির্মূল করা হবে- এটাই সরকারি নীতি হওয়া দরকার।
গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশ এবং স্বাধীনতাকে জনগণের জন্য প্রকৃতই অর্থবহ করে তুলতে হলে দরকার হবে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও পরমতসহিষ্ণুতার আবহ সৃষ্টি, খোলামেলা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ম প্রতিষ্ঠা, নিয়মিত ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলীয় কাউন্সিল ও নেতা নির্বাচন, দলীয় কোন্দল রোধ ইত্যাদি। নির্বাচনব্যবস্থা নিয়মিত, কলুষমুক্ত ও বিশ্বস্ত করার জন্য কয়েকটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে চালু রেখে ওই সময়ের মধ্যে সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও শক্তিশালী নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এভাবে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা জোরদার হবে এবং তা হলে স্বাধীনতাও হয়ে উঠবে তাৎপর্যময় ও জনগণের সাধনার ধন।

লেখক : মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমী

No comments

Powered by Blogger.