গার্মেন্টে আগুন এবং নানা প্রশ্ন by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

বাংলাদেশে আগুনে যত লোক প্রাণ দিয়েছে, তা নিশ্চয়ই গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা পেতে পারে। এই তো গত ২৪ নভেম্বর ১২৪ জন গার্মেন্টকর্মী আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেন। সব মৃত্যু বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। কিন্তু আগুনে পুড়ে মরার যন্ত্রণা অত্যন্ত কষ্টদায়ক।
এ প্রসঙ্গে আলোচনার আগে অল্প কিছু পূর্বকথা বলতে হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকারের ঘোষিত অর্থনীতি ছিল সমাজতান্ত্রিক। ব্যক্তিমালিকানার পাট ও বস্ত্রশিল্পকে জাতীয়করণ করা হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিল্প গড়ার উদ্যমে ভাটা পড়ে। ইতিমধ্যে ব্যাংক, বীমা ও শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। সেই সঙ্গে অন্যান্য বড় শিল্প-কারখানাও। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রের অর্থনীতির পরিবর্তন করা হয়। বেসরকারি খাতের জন্য সব শিল্প খুলে দেওয়া হয়। তবে প্রথম আগ্রহটা পরিলক্ষিত হয় বস্ত্রশিল্পে। পাটে আগ্রহ কমে আসছে। কেননা বিশ্ববাজারে পাটের বিকল্প চালু হওয়ায় পাট এবং পাটজাতদ্রব্য সংকুচিত হয়ে আসছিল। নইলে স্বাধীনতার পর সরকার পাটের ওপর বেশ গুরুত্ব দিয়েছিল এবং পাট মন্ত্রণালয় খোলা হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে wind fall gain-এর মতো এক অপূর্ব সুযোগ আসে। এটা আশির দশকের প্রথমের কথা। দক্ষিণ কোরিয়া একচেটিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আসছিল। কিন্তু কোটা আরোপিত হয়। বাংলাদেশের জন্য কোটার বালাই ছিল না। রপ্তানি করে না, তো কোটার প্রশ্ন ওঠে না। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের একটা যোগসাজশ হয়। এই সময়ে আমি দু-একটি কারখানার মোটামুটি দায়িত্বপূর্ণ পদে ছিলাম, এ জন্য কিছু খবর জানি। পোশাক তৈরি করতে কাপড়, বোতাম, সুতাসহ সব রকম পণ্যের প্রয়োজন। কোরিয়ায় এই লিংকেজ শিল্পেরও প্রভূত উন্নতি হয়েছে। ফলে কোরিয়া থেকে যখন কোনো export L/C আসত, তার বিপরীতে থাকত একটি import L/C। যাকে বলা হয় Back to Back L/C। এক লাখ ডলারের এক্সপোর্ট এলসির বিপরীতে ৭৫ হাজার ইম্পোর্ট এলসি থাকত, এমনকি অ্যাডহেসিভ টেপও আমদানি হয়ে আসত। সিএম অর্থাৎ কাটিং ও মেকিংয়ের জন্য ২৫ শতাংশ পাওয়া যেত; কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সরকারি তথ্যে পুরো ১০০ শতাংশ পরিসংখ্যানটি রপ্তানি হিসেবে দেখানো হতো। প্রণোদনাও সেই হিসেবে দেওয়া হতো। এখন লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি উন্নত হওয়ায় রপ্তানি পরিসংখ্যান বেড়ে গেছে। কথায় বলে- নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। দেশে শিল্পের বিকাশ নেই। এ অবস্থায় গার্মেন্ট শিল্পের এ বিকাশকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হয়। এই শিল্পে মেয়েদের ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান হতে লাগল। একদিকে মেয়েদের চাকরির প্রতি মায়াও যেমন বেশি, তেমনি চাকরি হারানোর ভয়ও বেশি। সব শ্রেণীর মেয়েদের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। একটি বাড়িতে গৃহপরিচারিকা হওয়ার চেয়ে গার্মেন্টশিল্পে কর্মী হওয়া সম্মানজনক নয় কি? ইতিমধ্যে প্রচুর গার্মেন্ট শিল্প গড়ে উঠল। গার্মেন্টকর্মীরা যথেষ্ট দক্ষতা দেখালেন। সকাল ৮টার আগে তাঁরা কর্মস্থলে আসেন। ছুটির পরে যান। রোদ-বৃষ্টি তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারে না। অনেক সময় রপ্তানি সময়মতো করার জন্য রাত ৮-১০টা পর্যন্ত ওভারটাইম করতে হয়েছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের পরদিন ঠিক যথাসময়ে অফিসে আসতে হয়েছে। এই যে তাঁদের আন্তরিক শ্রম, এর কিন্তু যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের দিকে একবারও তাকানো হয়নি। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত বিধান অনুযায়ী যে গ্র্যাচুইটি বা এ ধরনের আনুষঙ্গিক পাওনা থাকে, তা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হতো না। একটি কার্ড দেওয়া হতো- যেখানে ছবি, পদবি এবং ঠিকানা থাকত। কারখানায় ঢোকার সময় ওটা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়ে ঢুকতে হতো। যদি তার আর প্রয়োজন না থাকত, শূন্য হাতে ফিরতে হতো। আর কোনো প্রমাণ নেই যে এই কারখানায় কিছুদিন কাজ করেছেন, যার বিনিময়ে তিনি কিছু আর্থিক বেনিফিট পেতে পারেন। এত নিষ্ঠুর শোষণ বা বঞ্চনা মানুষ মানুষকে করতে পারে, এটা ভাবতে কেমন লাগে। এ নিয়ে অনেক আন্দোলন হয়েছে, আন্তর্জাতিক চাপও ছিল। ফলে এখন বোধ হয় নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক শিল্প বেশ সুনাম অর্জন করেছে। উদ্যোক্তারা তো লবিং করেছেন, গুণগতমান এবং সময়সূচির প্রতি লক্ষ রেখেছেন, তবে সেই সঙ্গে এটাও মেনে নিতে হবে যে আমাদের শ্রমিকরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে আসছেন। কয়েক দিন আগে থেকে একটি শক্তিশালী গার্মেন্ট শিল্পের প্রতিনিধি এসেছিলেন। তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব রেখেছেন। সব আমার মনে পড়ছে না। তবে কয়েকটির কথা মনে পড়ছে। যেমন অবকাঠামো উন্নতির কথা মনে পড়ছে। অবশ্য এ ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা বেশি। এরপর বোধ হয় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। বিজিএমইএ অবশ্য কিছু কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। তবে এটি যথেষ্ট নয়, তা তো প্রতিনিধি দলের বক্তব্য থেকে বোঝা গেল। আর সময়ানুবর্তিতার কথা বলা হয়েছে। এটির কী গুরুত্ব, তা বলার প্রয়োজন হয় না।
বাংলাদেশের নব্য ধনী যাঁরা, তাঁদের ৮০ শতাংশকে গার্মেন্টশিল্প অনেক কিছু দিয়েছে। তাঁরা অভিজাত এলাকায় প্রাসাদোপম অট্টালিকা বানিয়েছেন। বিএমডাবি্লউ গাড়ি ছাড়া চড়েন না। জটিল অসুখ তো দূরের কথা, সর্দি-কাশি হলে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক গিয়ে থাকেন। হ্নান্তে ছুটি কাটান কলকাতায়। ঈদের জন্য মালয়েশিয়া। তাঁরা সবাই ব্যাংক-বীমার শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক। অবশ্য ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট্য যে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়। এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ধনীর উদ্বৃত্ত সম্পদ চুইয়ে চুইয়ে গরিবের ঘরে আসবে। তা আসেনি। সাবেক আরেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন বিশ্বব্যাপী কাজ করছেন যে কিভাবে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে আনা যায়।
যাক, আজকের মূল কথায় ফিরে আসি। এই যে গার্মেন্ট শ্রমিক আগুনে পুড়ে মরছেন, এটা তো নিয়মিত ঘটনা। এ নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। একসময় দেখা গেল নির্গমন গেট কম, কাঁচি, সুতা ইত্যাদি চুরি হবে বলে গেটের সংখ্যা কম রাখা হয়। যাও বা দু-একটা থাকে, দারোয়ান সহজে খুলে দেয় না। বেশ বড় ধরনের আগুন লেগে শত শত কর্মী মারা গেছেন। জীবনের মূল্য তো ৫০ হাজার বা এক লাখ টাকা। এটা রোধ করার কি কোনো পথ নেই। প্রথমত, পর্যাপ্ত নির্গমন দরজা থাকতে হবে, যা তৎক্ষণাৎ খুলে দিতে হবে। এ ছাড়া অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র থাকতে হবে, তার সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে ফ্লোরের আকৃতি এবং কর্মীর সংখ্যা অনুযায়ী। লোকদেখানো দু-একটা যন্ত্র দেখালে চলবে না। ফ্যাক্টরি থেকে বের হওয়ার জন্য সাধারণ সিঁড়ি ছাড়া জরুরি সিঁড়ির ব্যবস্থা থাকবে, যার সিস্টেম এ রকম হতে হবে যেন আগুন লাগলে সেটি ভেঙে বের হওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। আমি হয়তো সাদামাটাভাবে বলছি, আসলে বর্তমান উন্নত প্রযুক্তির যুগে অনেকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
এখন আসে ক্ষতিপূরণের কথা। যেহেতু ফ্যাক্টরির ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার জন্য এ রকম ঘটনা ঘটে। তাই ক্ষতিপূরণের বিষয়টা আরো গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। গার্মেন্ট শিল্পে অপেক্ষাকৃত তরুণ-তরুণীরা কাজ করেন। অকালে তাঁরা ঝরে পড়েন। তাঁদের মৃত্যুকালে যে বেতন পেতেন, সেই হিসাব করে কমপক্ষে ২০ বছরের বেতনের সমান টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে। আগেই বলেছি যে গার্মেন্টের মালিকরা অনেক পেয়েছেন। আপনারা ভালো থাকুন। তবে কিছু অর্থ হতভাগ্যদের জন্য ব্যয় করুন। আরেকটি কথা বলতে ভুলে গেছি। হংকংয়ের সেই দলটি আরেকটি কথা বলে গেছে। সময়মতো যেন তারা বেতন পায়। নিশ্চয়ই তাদের চোখে এ অনিয়মটা ধরা পড়েছে। আজকাল তো শ্রমিক ও অন্যান্যের জন্য করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব পালনের কথাটা খুব প্রচলিত হয়েছে। আপনারা প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে একটি ফাউন্ডেশন খুলতে পারেন, সেখান থেকে দুর্ঘটনাকবলিত শ্রমিকের পরিবারকে কিছু সাহায্য করতে পারবেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। তা তো আবার এক আমলার নেতৃত্বে। আমাদের আমলারা মূলত জনবিমুখ। তাঁরা এস্টাবলিশমেন্টপন্থী। অতএব সব সময় কর্তৃপক্ষের অনুকূলে প্রতিবেদন দিয়ে থাকবেন। তা ছাড়া আমরা অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে কোনো তদন্ত কমিটি বা কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০০১-০৬ মেয়াদে থাকা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর যে নিষ্ঠুর অত্যাচার চালানো হয়েছিল, তার পূর্ণ তদন্তের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছিল। যত দূর জেনেছি, অত্যন্ত সুন্দর একটি রিপোর্ট তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, রিপোর্টটি জনসমক্ষে প্রকাশ করার প্রয়োজনটা সরকার মনে করল না। শতবর্ষ ধরে এ ঐতিহ্য চলে এসেছে। ব্রিটিশরা যা শিখিয়েছে, তা থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারিনি আমরা। অতএব এই অগ্নিসংযোগের তদন্ত রিপোর্টও হবে বাখোয়াজ। সমস্যাটা সবার জানা।
শ্রমিকের জীবনের কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। যে পয়সা দিয়ে অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র কিনবে, তা দিয়ে ঢাকা ক্লাবের বিল দেওয়া যাবে।
সরকার যদি তাদের জনগণের সরকার মনে করে থাকে, তাহলে আগুনে পুড়ে মানুষ যেন আর না মরে, তার জন্য প্রকৃত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এর জন্য গার্মেন্ট মালিকের প্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি, স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা কার্যকর করা। অন্যথায় একটি দুর্ঘটনা ঘটবে আর সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ নেতারা বিবৃতি দেবেন। এরপর ঘটনার সব শেষ। কারো লিপ সার্ভিসে যে পরিবারের দুর্যোগ নামে, তার কি কোনো উপশম হয়?

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.