বিল্ডিং কোড- গরিব শ্রমিকদের জীবন রক্ষায় কিছু একটা করুন by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

ঢাকার কাছে সাভারে একটি গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগার ঘটনাটিতে দেশবাসী শোকস্তব্ধ। এই দুর্ঘটনায় ১১১ জন শ্রমিক মারা গেছেন। একটি দুর্ঘটনায় একসঙ্গে এত লোকের মৃত্যু নজিরবিহীন। তবে এ রকম দুর্ঘটনা নতুন নয়।
বছরে অন্তত কয়েকবার তৈরি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড বা শ্রমিক অসন্তোষে শ্রমিকের মৃত্যু বা কারখানার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েই থাকে। প্রতিবারই দুর্ঘটনার পর সরকার, বিজিএমইএ ও অন্যান্য সংস্থা থেকে নানা নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু তার বেশির ভাগই পূরণ হয় না। কখনো ‘দোষী ব্যক্তি’ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেয়েছে বলে শোনা যায়নি।
এবার আবার ভয়াবহ রকমের অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন শ্রমিকের মৃত্যুতেও সরকার ও বিজিএমইএর টনক নড়বে কি না জানি না। শ্রম মন্ত্রণালয় অবশ্য খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা হলো ‘কারখানা থেকে বের হওয়ার দুটি সিঁড়ি না থাকলে সেই কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাস্তবে তা কতটা কার্যকর হবে, সেটাই হলো প্রশ্ন। মিডিয়ার প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, অন্তত তিন মাস পর ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে মিডিয়ায় যেন এ ব্যাপারে রিপোর্ট করা হয়। তাহলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে, সরকারের নির্দেশ কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে।
তৈরি পোশাকশিল্প দেশের একটি অর্থনৈতিক স্তম্ভ। রেমিট্যান্সের পরেই তৈরি পোশাকশিল্পের অবস্থান। দেশের অর্থনীতির দুটি প্রধান ‘স্তম্ভ’ সম্পর্কেই সরকারের (সব আমলে) যে বিশেষ মনোযোগ ও গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। দূষিত রাজনীতিকবলিত ক্ষমতাসীন দল ও সরকার (সব আমলে) কিছু দলীয় ও ব্যক্তিগত এজেন্ডা পূরণ করার প্রতিই তাদের মনোযোগ বেশি থাকে। দেশের প্রধান প্রধান সমস্যা বা ইস্যু সম্পর্কে যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়ার সময় সরকার পায় না। বিভিন্ন আমলের সরকার মূল কাজের চেয়ে লিফ সার্ভিসেই বেশি আগ্রহী। তাতে ত্বরিত প্রচার ও বাহবা পাওয়া যায়। খুব কম ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম হয়েছে।
অনেক কাজ আছে, যেগুলোর জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। যেমন: কোনো চেম্বার বা বিজিএমইএ ব্যবসা এলাকায় অপরাধ বা সন্ত্রাস দমন করতে পারবে না। এ ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। তেমনি আবার কিছু কাজ আছে, যা কোনো প্রাইভেট কোম্পানি, চেম্বার বা বিজনেস ফোরাম নিজেরা উদ্যোগী হয়ে করে ফেলতে পারে। সরকারের সহায়তা খুব একটা প্রয়োজন হয় না।
তৈরি পোশাকশিল্প সম্পর্কে যেসব অভিযোগ রয়েছে, তার বেশির ভাগই বিজএমইএ নিজেরাই সমাধান করতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তারা করতে পারেনি। এ জন্য নেতৃত্বের দুর্বলতাকেই দায়ী করব।
পোশাক কারখানায় মাঝেমধ্যেই আগুন লাগে। শ্রমিকেরা তাড়াতাড়ি বের হতে পারেন না। অভিযোগ শোনা যায়, কারখানা চলার সময় প্রধান বা অপ্রধান সব গেট তালা মারা থাকে। বন্ধ থাকা আর তালা মারা এক কথা নয়। বিভিন্ন ফ্লোরে ওঠানামার সিঁড়িগুলো সরু। আগুন নেভানোর ব্যবস্থা অপ্রতুল। বিল্ডিং থেকে বাইরে বের হওয়ার পথ খুবই কম। ইত্যাদি।
আমাদের অনেক পোশাক কারখানা শহরের ভেতরে হওয়ায় স্থানাভাবে সেগুলো বহুতল বিল্ডিংয়ে স্থাপন করা হয়। বহুতল বিল্ডিংয়ের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকার তৈরি পোশাক কারখানার জন্য আলাদা ‘গার্মেন্টস পল্লি’ তৈরি করে দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে অনেক আগেই। এই ঘোষণা বাস্তবায়ন হলে গার্মেন্টস-সংক্রান্ত অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। সরকার যে অনেক জরুরি জিনিস যথাসময়ে বাস্তবায়ন করে না, এটা তারই একটা প্রমাণ।
তবে গার্মেন্টস পল্লি হলেও আগুন লাগার বিষয়টি কিন্তু বন্ধ হবে না। কারণ, সেটা দুর্ঘটনা। কাজেই প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানা কী ডিজাইনে তৈরি হবে, সেটা একটা জরুরি প্রশ্ন। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ দুটো ফোরামই তাদের সদস্যদের ফ্যাক্টরি ভবন কী ডিজাইনে করতে হবে (বাধ্যতামূলক করতে হবে) সে ব্যাপারে টেকনিক্যাল সহায়তা দিতে পারে। কারখানা ছোট, মাঝারি ও বড় বিভিন্ন আকারের হতে পারে। বিজিএমইএ এ বি সি—তিন ক্যাটাগরির বিল্ডিং ডিজাইন তৈরি করে রাখতে পারে। প্রতিটি বিল্ডিং সর্বোচ্চ কয় তলা হতে পারবে, প্রতিটি ফ্লোর সর্বোচ্চ কত স্কয়ার ফুট (এ বি সি ক্যাটাগরি) হবে, কারখানা ভবনের সবকিছু ভবনের সাইজ অনুযায়ী ডিজাইনে উল্লেখ থাকবে। বিজিএমইএর প্রত্যেক সদস্যকে এই ডিজাইন (ভেতর ও বাহির) মেনেই কারখানা ভবন তৈরি করতে হবে। পোশাক তৈরির কারখানায় কাপড় ও সুতা নিয়ে কাজ। কাজেই পোশাক কারখানার জন্য যা যা দরকার তা ডিজাইনে উল্লেখ থাকবে।
কারখানার প্রতিটি ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা কেমন হবে (স্কয়ার ফুট অনুযায়ী) তাও বিল্ডিং ডিজাইনে উল্লেখ থাকবে। অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রাথমিক প্রশিক্ষণ, মাঝেমধ্যে ড্রিলিংয়ের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। প্রশিক্ষণ ও ড্রিলিং হচ্ছে কি না তা কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করতে হবে। দরকার হলে এ জন্য বিজিএইএর লোকবল, দক্ষতা, লজিস্টিকও বাড়াতে হবে। তাদের তো টাকার অভাব হবে না।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এমন দুটি ফোরাম, যারা বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করে। কারখানা ভবনের ডিজাইনের ব্যাপারে দেশি স্থপতিদের পাশাপাশি বিদেশি স্থপতি ও বিল্ডিং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও তারা নিতে পারে। এতে ডিজাইনের মান আরও উন্নত হবে।
কারখানা ভবনের ডিজাইন চূড়ান্ত করার আগে নানা গবেষণা ও মতবিনিময় করা দরকার। বিশেষ করে শ্রমিকদের সঙ্গে ও অগ্নিনির্বাপণ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। যাঁদের জন্য ‘ভবন’ বা যাঁদের জন্য ‘মঞ্চ’, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করার প্রবণতা আমাদের দেশে খুব কম। আমাদের দেশে সরকারি বা বেসরকারি ‘অফিসাররা’ নিজেদের বিশেষজ্ঞ ভাবেন। তাঁরাই সব জানেন। বিজিএমইএ যেন এই ভুল না করে।
প্রতিটা কারখানায় একটা গোডাউন থাকতেই হয়। কাঁচামাল বা তৈরি মাল রাখার জন্য এটা খুবই দরকার। এই গোডাউনটা কারখানা ভবনের বাইরেই করা শ্রেয়। গোডাউনে আগুন লাগলে বেশি ক্ষতি। একই ভবনের গোডাউনে আগুন লাগলে আগুন পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। আলাদা ভবন হলে অন্তত একটা রক্ষা করা যায়। কারখানা ভবনের ডিজাইনাররা এটা ভেবে দেখবেন আশা করি।
গেট তালা দেওয়া একটা বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। অভিযোগ শোনা যায়, কারখানার অনেক শ্রমিক নানা খুচরা জিনিস চুরি করে বাইরে গিয়ে রেখে আসেন। চুরি বন্ধ করতেই হবে। তাই বলে গেটে তালা দিয়ে নয়। কারখানার বিভিন্ন ফ্লোরে গোপন ক্যামেরা বসিয়ে বা শ্রমিকদের বিশেষ ইউনিফর্ম দিয়ে চুরি বন্ধ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। গেটের সিকিউরিটি আরও শক্ত করা যায়। কিন্তু গেটে তালা লাগানো যাবে না।
প্রতিটি বড় কারখানায় একটা পাবলিক অ্যাডড্রেস সিস্টেম থাকা দরকার। যাতে প্রতিদিন অফিসের প্রয়োজনীয় নানা ‘ঘোষণা’ কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়া যায়। (মধ্যাহ্ন বিরতির সময় গানও শোনানো যেতে পারে।) প্রতিদিন হয়তো এটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে না কিন্তু দুর্ঘটনার দিন এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সাভারে কদিন আগে যে পোশাক কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে দেখা যায় আগুন সম্পর্কে কারখানার ভেতরের নানাজন নানা কথা বলেছেন। (সূত্র: টিভি ও সংবাদপত্র) এসব কথাবার্তা ও মন্তব্যে শ্রমিকেরা দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র পাননি। আগুন যখন পুরোদমে সব ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়েছে, তখনই একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আগুন নিভে গেছে, এখন কাজে যাও।’ নানা রকম বিভ্রান্তিকর কথাবার্তায় শ্রমিকদের মধ্যে বেশি করে আতঙ্ক ছড়ায়। তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে হুড়োহুড়ি করে বিল্ডিং থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন ও অনেকে পদদলিত হয়েও মারা যান। কারখানার একটি ‘কেন্দ্রীয় ঘোষণা’ এসব বিভ্রান্তি ও ভুল খবর থেকে শ্রমিকদের রক্ষা করতে পারে।
আগুন লাগা একটা পরিচিত দুর্ঘটনা। তবে নাশকতামূলক কারণেও কেউ আগুন লাগাতে পারে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তদন্তের আগেই সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা ঘটনার ‘কারণ’ ও ‘আসামি’ কে তা প্রায় নিশ্চিত করে বলে দেন, যা ইদানীং একধরনের রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ রকম অবাঞ্ছিত ঘোষণা যে তদন্তকাজকে প্রভাবিত করতে পারে। (নাকি জেনেশুনে তদন্তকাজ প্রভাবিত করতে চান!) দু-একজন সরকারি লোকের কথা শুনে বড় বড় দুর্ঘটনার ‘কারণ’ ও ‘আসামি’ নির্ণয় করা যায় না। তদন্তের কাজটা অনেক বড় ও ব্যাপক।
নাশকতার অভিযোগটি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাই আমরা প্রস্তাব করব: পোশাকশিল্পের দুই ফোরাম মিলে প্রতিটা কারখানার মধ্যে একটা গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাও তাদের মতো কাজ করবে। এ ব্যাপারে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিদেশি সহায়তাও নেওয়া যায়। আগুন লাগার পর ‘নাশকতা’ বা ‘ঘটনাটি পরিকল্পিত’ বললে কী লাভ? নাশকতার পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের আগেই রোধের চেষ্টা নিতে হবে।
আর নাশকতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে কোনো লাভ নেই।
এখন সবার সম্মিলিত দাবি হাওয়া উচিত, ২০১৩ সালের মধ্যে একাধিক গার্মেন্টস পল্লির ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে বিভিন্ন স্থানে যাঁর যাঁর খুশিমতো তৈরি পোশাকশিল্প বসাতে না পারেন। গার্মেন্টস পল্লির প্রতিটি বিল্ডিং ডিজাইন, গোডাউন, আগুন নির্বাপণব্যবস্থা, শ্রমিক কলোনি, খালি জায়গা, বিনোদনের স্থান, হবে সুপরিকল্পিত। বিজিএমইএ কেন্দ্রীয়ভাবে এই ডিজাইন পরিকল্পনা করবে। সরকার কোনো অজুহাতেই যেন গার্মেন্টস পল্লি স্থাপন বিলম্বিত করতে না পারে, সে ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। ২০১৩ সালের মধ্যে গার্মেন্টস পল্লি স্থাপন কি একেবারেই অসম্ভব?
সাভারের পোশাক কারখানায় ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ও এর ফলে ১১১ জনের মৃত্যু বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে বিষয়টি ভালোভাবে পর্যালোচনা ও কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটা উপলক্ষ এনে দিয়েছে। আশা করি, তাঁরা শুধু বিবৃতি দিয়ে, ক্ষতিপূরণ, বিমার টাকা গুনে তাঁদের দায়িত্ব শেষ করবেন না। ভবিষ্যতে এ রকম লাশের সারি যেন আমাদের আর দেখতে না হয় তার একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করা খুবই প্রয়োজন। ‘অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা’ ইস্যুতে যৌথভাবে দিনব্যাপী একটি আলোচনার আয়োজন করুন। বিশেষজ্ঞদের ডাকুন। সমাধান বের করুন ও তা প্রতিটি কারখানায় বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিন। আল্লাহ আপনাদের অনেক অর্থের মালিক করেছেন। দুর্ঘটনা থেকে গরিব শ্রমিকদের জীবন রক্ষার জন্য কিছু একটা করুন।
 মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.