ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উড়িয়ে দিয়ে স্বপ্নের মতো জয় by মাসুদ পারভেজ

ক্রিস গেইল যেন তামিম ইকবালে ভর করলেন! বাংলাদেশের ওপেনার বল মারলেন একদিকে কিন্তু গেল অন্যদিকে। তবে এমন জোরে মারলেন যে সেটি শেষ পর্যন্ত ছক্কাই হয়ে গেল।
আইপিএল কিংবা বিপিএলে গেইলের ব্যাটে এমন কত ছক্কা হতে দেখেছেন নিশ্চয়ই! গায়ের জোরে মিস হিটেও বল বাতাসে ভেসে সীমানাছাড়া হওয়ার ঘটনা গেইলের ব্যাটেই রচিত হতে দেখবেন বলে প্রস্তুতি ছিল পরম বাংলাদেশ-ভক্তেরও। আর বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শারীরিক শক্তির অভাব নিয়ে হাহাকারের মধ্যে গেইলের জোরটা কিনা উল্টো ক্ষণিকের জন্য চলে এলো তামিমেই!
খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ওলট-পালটের বিশাল ও বিস্তৃত ছবির এটি একটি সামান্য খণ্ডচিত্র মাত্র। বাংলাদেশের বিপক্ষেই যেসব ঘটবে বলে অনুমান ছিল, এর বেশির ভাগই ঘটল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্ষেত্রে। এই যেমন টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসার ঘটনায় সমালোচনা হয়েছে খুব। পরিস্থিতির দাবি বুঝে ব্যাটিং করার অক্ষমতার জন্য তাঁদের শূলে চড়ানোই বাকি ছিল কেবল। অথচ কাল ম্যাচের শেষে ঠিক এ কাজটাই করার জন্য নিজ দলের ব্যাটসম্যানদের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সহ-অধিনায়ক কিয়েরন পোলার্ড। উল্টো ঘটনার শেষ এখানেই নয়, আরো আছে।
নতুন নিয়মে ওয়ানডের ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার খৰ বাংলাদেশের ওপরই বেশি পড়বে বলেই মত ছিল সর্বাধিক। বাংলাদেশ যেহেতু স্পিন-নির্ভর দল, কাজেই তাদের স্পিনারদের ওপর দিয়ে ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা ঝড় বইয়ে দেবেন বলেও মনে করেছিলেন অনেকে। কিন্তু বাস্তবে ঘটল ঠিক বিপরীত। আশঙ্কার 'নন-পাওয়ার প্লে' ওভারেই বরং বাংলাদেশ শেষ করে দিল ক্যারিবীয়দের। দিলেন স্পিনাররাই। প্রতিপক্ষের ১০ উইকেটের আটটিই তো তুলে নিয়েছেন তাঁরা। সব মিলিয়ে অলআউট হওয়ার আগে ক্যারিবীয়রা ১৯৯ রান করেছেন বটে, কিন্তু তাঁদের সব উইকেটই পড়েছে নন-পাওয়ার প্লের ৩১.৫ ওভারে। তাও আবার মাত্র ১১২ রানে। এত কিছু উল্টে-পাল্টে যখন যায়, তখন অনুমানের ফলটাও ওল্টাতে বাধ্য। বাংলাদেশও তাই ৭ উইকেটের অনায়াস জয় দিয়ে ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আনন্দে ডুবল না শুধু, নিউজিল্যান্ডকে টপকে এই প্রথমবারের মতো আইসিসির ওয়ানডে র‌্যাংকিংয়ের আট নম্বরেও উঠে গেল!
সাতসকালে ক্যারিবীয় অধিনায়ক ড্যারেন সামি টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার পর আশঙ্কার মেঘ জমছিল আরো। তাঁরা না আবার সাড়ে তিন শ-চার শ করে ফেলে! কিন্তু ম্যাচ শুরু হতেই দেখা মিলতে লাগল ভিন্ন সব চিত্রের। ম্যাচ শেষে যে বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম জয়ের ভিত্তি গড়ে দেওয়ার কৃতিত্বটা দলের দুই পেসারকে দিচ্ছিলেন, সেটা তো আর এমনি এমনি দেননি। সকালে মাশরাফি বিন মর্তুজা আর অভিষিক্ত আবুল হাসান মিলে কেমন বোলিং করছিলেন, সেটি প্রথম ৩ ওভারে স্কোরবোর্ডে ক্যারিবীয়দের ৩ রান জমা হওয়াতেই পরিষ্কার। প্রথম পাওয়ার প্লেতে অবশ্য তাঁদের দুজনের খরুচে ওভারও আছে। মাশরাফির ১ ওভার থেকে দুটো বাউন্ডারি আর ছক্কায় গেইল তুলেছিলেন ১৪ রান। হাসানের আরেক ওভার থেকে ১৬। এ দুটো বাদ দিলে প্রথম পাওয়ার প্লের বাকি ৮ ওভারে তাঁরা দিয়েছেন মোটে ১৭ রান!
এ সময়ের মধ্যে হাসানের বলে ওপেনার লেন্ডল সিমন্স জীবন ফিরে পেয়েছেন একাধিকবার। পরাস্ত হয়েছেন আরো বহুবার। সেই সিমন্সকে (১৩) এলবিডাবি্লউ করে ক্যারিবীয়দের প্রতি প্রথম আঘাতটা হানেন মাশরাফিই, যাঁর প্রথম স্পেলটা এখানে না তুলে দিলে হচ্ছেই না : ৭-২-২৪-১!
আক্রমণে এসে দ্বিতীয় বলেই আঘাত হানেন সোহাগ গাজীও। টেস্টে দুবার এ অফ স্পিনারের বলে আউট হওয়া গেইল (৩৫) এবারও তাঁর শিকার। লং অনের ওপর দিয়ে তুলে মারতে যাওয়া মারকাটারি ব্যাটসম্যান সীমানা দড়ির ঠিক আগে তামিমের অসাধারণ এক ক্যাচ হয়েছেন। যে ধরনের ক্যাচ নেওয়ার সুখ্যাতি তামিমের নেই বললেই চলে। পরের ওভারে মারলন স্যামুয়েলসকে (০) স্লিপে মাহমুদ উল্লাহর ক্যাচ বানিয়ে সোহাগ ক্যারিবীয়দের ওপর চেপে বসার পথ খুলে দেন আরো। ১৬ বলের মধ্যে ২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা ক্যারিবীয়দের বিপদ আরো বাড়তে থাকে বাঁহাতি স্পিনার আবদুর রাজ্জাক আক্রমণে আসতেই। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতেই থাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর গেইল-স্যামুয়েলসদের ব্যর্থতার দিনে দলের ত্রাতা হতে ব্যর্থ পোলার্ড-আন্দ্রে রাসেলরাও। তাঁদের দুজনকে ফেরানো রাজ্জাক ৩৯ রান খরচায় নিয়েছেন ৩ উইকেট। তবে টেস্টের পর ওয়ানডে অভিষেকেও সবাইকে ছাড়ানো পারফরম্যান্স সোহাগ গাজীর। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে রুবেল হোসেনের ৩৩ রানে ৪ উইকেট নেওয়াই এত দিন ওয়ানডে অভিষেকে কোনো বাংলাদেশির সেরা বোলিং ছিল। কাল ২৯ রানে ৪ উইকেট নেওয়ার পথে সোহাগ ফিরিয়েছেন 'পথের কাঁটা' হয়ে থাকা সুনীল নারিনকেও (৩৬); ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ ইনিংসে যিনি দলকে প্রায় ২০০ ছোঁয়া স্কোরে নিয়ে যেতে রেখেছেন সবচেয়ে বড় ভূমিকা। না হলে ১৩৩ রানে ৮ উইকেট খুইয়ে বসা ক্যারিবীয়দের তো আরো আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
লক্ষ্য যখন সাধ্যের মধ্যে, তখন একটু উচ্চাভিলাষী হতেও খুব একটা বাধা নেই। তামিম তাই চালাতে শুরু করলেন। কেমার রোচের বলে যেমন একদিকে মেরে অন্যদিকে ছক্কা পেলেন। ৪৬ বলে ফিফটিতে পৌঁছে যাওয়া এ বাঁহাতি ওপেনার শেষ পর্যন্ত ৫১ বলে ৫৮ করে আউট হওয়ার সময় বাংলাদেশের সহজ জয়ের ভিত গড়া হয়ে গেছে। বিসিবি একাদশের হয়ে জাতীয় দল এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুটো প্রস্তুতি ম্যাচে বড্ড নড়বড়ে দেখানো এনামুল হকও (৪১) অভিষেকে দারুণ সঙ্গ দিলেন তামিমকে। ওপেনিংয়েই তাই ৮৮ উঠে যাওয়ার পর অন্যদের কাজটা ছিল সাবধানে বাকি পথটা পেরোনোর। নাসির হোসেনের (২৮) বিদায়ের পর তিন নম্বরে ব্যাট করা নাঈম ইসলাম (৫০*) আর অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম (১৬*) মিলে নিরাপদেই গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন দলকে।
এরপর পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে ম্যাচ সেরার প্রতীকী চেক হাতে সোহাগ গাজী! ওলট-পালটের সবচেয়ে বড় ছবিও বোধ হয় দিনের শেষে এটাই!

No comments

Powered by Blogger.