তুরস্কের যুদ্ধাবস্থায় কুর্দিরা কোন পক্ষে? by পিত্‌র্‌ জালেভস্কি

দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের ৬০ হাজার মানুষের শহর সিরনাকের পুলিশ স্টেশন। প্রায় পুরোটাই নীল রঙের ত্রিপলে ঢাকা। কাছের একটি ফোনের দোকানের বিক্রেতা জানালেন, দুই মাস আগে কুর্দি মিলিট্যান্টরা চার পাশের রাস্তা থেকে রকেটচালিত গ্রেনেড দিয়ে হামলা চালিয়ে ভবনটি প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে।


সেই দোকানদার বললেন, আগস্টের ১৮ তারিখে কুর্দি বিদ্রোহীরা ওই হামলা চালিয়ে একটি বার্তা দিয়েছে। সেটা হলো, দীর্ঘ ২০ বছর আগে বিদ্রোহীরা যখন সিরনাক শহর নিয়ন্ত্রণে নিতে চেষ্টা করেছিল তখন তুরস্কের সেনাবাহিনী শহরটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের কুর্দি অধ্যুষিত সিরনাকের মানুষের কাছে যেকোনো দিবস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগস্টের সেই আক্রমণের দায়িত্ব স্বীকার করা কুর্দিশ ওয়ার্কার্স পার্টির (পি কে কে বলে সমধিক পরিচিত) কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। আমি যেদিন সিরনাকে পৌঁছালাম, তার আগের দিন গোটা শহরের সব দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ ১৪ বছর আগে এই দিন তুরস্ক সিরিয়াকে হুমকি দিয়েছিল দামেস্কভিত্তিক পি কে কে নেতা আবদুল্লাহ ওকালানকে বহিষ্কারের। এর কিছুকাল পর ওকালানকে গ্রেপ্তার করে বিচার করা হয়। তিনি এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে তুরস্কের দ্বীপ মারমারায় কারাগারে অবস্থান করছেন। বেশির ভাগ দোকানি নিজেদের ইচ্ছায় দোকানের ঝাঁপ নামিয়েছেন কুর্দিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে। সে কথাই জানালেন একজন দোকানি। যেসব দোকানি আশঙ্কায় ছিল যে পি কে কের সদস্যরা তাদের দোকানে বোমা হামলা চালাতে পারে, তারা রাস্তায় পাহারা দিয়েছে।
বছরখানেক ধরে সিরনাকের পুলিশ স্টেশনে হামলার মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে। এর তীব্রতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা গেছে এই গ্রীষ্মকালে, যখন পি কে কে ইরান ও ইরাকের সীমান্ত লাগোয়া সেমদিনলি ও তার আশপাশের এলাকা দখল করতে চেষ্টা করেছে। তুরস্কের সেনাবাহিনী তখন ভয়ানক শক্তি প্রয়োগ করেছে। আর্টিলারি, কোবরা হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক ব্যবহার করেছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তুরস্কের সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমন করেছে। অধিকাংশ হিসাব থেকে দেখা গেছে, এ ঘটনায় শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের তুরস্ক অফিসের প্রধান হিউজ পোপ কুর্দি প্রশ্নে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। তাতে দেখা গেছে, ২০১১ সালের জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৭৭৫ জন। এর মধ্যে ২৬২ জন নিরাপত্তা রক্ষী, ৪২৬ জন মিলিট্যান্ট ও ৮৭ জন বেসামরিক নাগরিক। ১৯৮৪ সালে পি কে কের বিদ্রোহের পর থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৪০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিযোগ মতে, পি কে কে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ। এ অভিযোগ পি কে কে অস্বীকার করলেও এবং সম্প্রতি তারা সেনাঘাঁটিতে আক্রমণ চালালেও তাদের হাতে বেসামরিক মানুষের রক্তের দাগ রয়েছে। আগস্টে সিরিয়ার সীমান্তের কাছে গাজিয়েনতেপে ১০ বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যার ব্যাপারে পি কে কের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। যদিও তারা তা অস্বীকার করেছে। তুরস্কের গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুসারে, অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে পি কে কের সমর্থকরা মোলোটভ ককটেল এবং বিকট শব্দের বোমা দিয়ে সিরনাক প্রদেশের আটটি স্কুলে হামলা চালায়। তাতে দুজন ছাত্র আহত হয়।
তুরস্কের সরকার এসব ঘটনাকে কোনো কো-ইনসিডেন্স বলে মনে করে না। সিরিয়ার পরিবর্তনের ব্যাপারে তুরস্ক অন্যতম প্রবক্তা। এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এখন সরাসরি শত্রুতায় পর্যবসিত হয়েছে। সিরিয়া পি কে কে'কে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তুরস্ক তাই মনে করে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমেট দেভুতগলু আগস্টে ঘোষণা করেছেন, 'আমরা সব ধরনের হুমকির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছি।' তুরস্কের একজন কর্মকর্তা টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছেন, পি কে কে'কে সিরিয়ার সমর্থন দেওয়ার প্রমাণ সরকারের হাত আছে। নব্বইয়ের দশকে সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ বিদ্রোহীদের ঘাঁটি গাড়তে দিয়েছিলেন বেশ কিছু তুর্কি ইস্যুতে। এখন তাঁর ছেলে বাশার আল আসাদও সেসব কারণেই সে সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন। এর মধ্যে দুটি প্রধান কারণ হলো, সিরিয়ার বিদ্রোহী ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে তুরস্কের মাটিতে আশ্রয় দেওয়ার কারণে এবং সিরিয়া আক্রমণের জন্য তুরস্কের যে আগ্রহ তা দমন করার জন্য।
একই রকম অভিযোগ রয়েছে ইরানের বিরুদ্ধেও। তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রীর ওপর দোষারোপ করে আসছেন গাজিয়েনতেপে বোমা বিস্ফোরণ ও সেমদিলনিতে পি কে কের অভিযানের ব্যাপারে। এক মাস আগে ইরান ও তুরস্কের ঝগড়া চরমে পৌঁছেছিল, যখন তুরস্ক টেলিভিশন একটি ফুটেজ প্রদর্শন করে। সে ফুটেজে দেখা গেছে, ইরানের পি কে কের সদস্যদের তুরস্কের অভ্যন্তরে মিলিটারি ও পুলিশ অবস্থানগুলোর ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছে।
এ সব কিছুর মধ্যেও তুরস্কের সরকার কঠোর হাতে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করছে। আট হাজার আন্দোলনকারীকে আটক রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ছাত্রসহ অনেকে। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে পি কে কের সঙ্গে জড়িত থাকার খুবই হালকা অভিযোগ রয়েছে। সিরনাকে তিনজন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের দুজনই রয়েছেন কারাগারে। তাঁরা প্রো-কুর্দিশ পিস অ্যান্ড ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিডিপি) সদস্য। পার্শ্ববর্তী সিজরে শহরের পার্টির পাঁচজন উপপ্রধানের মধ্যে তিনজনই রয়েছেন জেলখানায়।
বিডিপি অফিসের মধ্যে পুরু গোঁফের একজন মানুষ বসে আছেন। তিনি উপস্থিত সবার সঙ্গে করমর্দন করছেন। কক্ষের এক কোণে ওকালানের ছবি টাঙানো। তুর্কি প্রধানমন্ত্রী এরদগানের ছবি ভেঙে ওই ছাবি টাঙানো হয়েছে। এরদগানের ছবি টেলিভিশনের তরঙ্গে ভেসে আসছে। তিনি সবই ঘোষণা করেছেন, যা কুর্দিশ ভাষায় অপ্রচলনযোগ্য। তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তার সমালোচনা করলেন, যিনি সম্প্রতি নিহত পি কে কে সদস্যদের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখিয়েছেন।
মোটা গোঁফের ওই মানুষটির নাম এনক। তিনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, 'আমি দুই পক্ষের জন্যই উদ্বিগ্ন। আজ এখানে আবার নব্বইয়ের দশকের মতো কেউ নিরাপদ নয়। একজন সেনা বা পুলিশ সদস্য এখানে নিরাপদে হতে পারেন না, ঠিক যেমন আমরাও নিরাপদে হাঁটতে পারি না। এমন চাপের মধ্যে যদি আমাদের বসবাস করতে হয়, তাহলে সামনে আরো ভয়াবহ ঘটনার জন্ম নেবে।'

লেখক : টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক।
টাইম থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.