খাদ্যে লাগামহীন ভেজাল by মো. শাহ আলম

খাদ্যে ভেজাল নিয়ে বহুদিন ধরে দেশের মানুষ ভুগছে। বলাবাহুল্য যতই দিন গড়াচ্ছে ততই ভেজালের তীব্রতা বাড়ছে। কিছুকাল আগেও বিশেষ কয়েকটি খাদ্যে ভেজালের কথা শোনা যেত; কিন্তু বর্তমানে প্রায় সব ধরনের খাদ্যেই ভেজাল মেশানো নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।


একজন ব্যবসায়ী সে যে শ্রেণীর বা মাপেরই হোক না কেন মুনাফা করাই তার মূল লক্ষ্য। তবে অতি মুনাফার আশায় খাদ্যে ভেজাল বা বিষয় জাতীয় পদার্থ মেশানো কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখব, প্রথমদিকে যে কোনো ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ মেশানো হতো খুবই সতর্কতা বা ভয়ভীতির মধ্যে। অসাধু ব্যক্তিরা আঁচ করতে পারল, কোনো পক্ষ থেকেই তেমন জোরালো কোনো আপত্তি বা প্রতিরোধ নেই। ফলে তারা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে ফরমালিনসহ অন্য সব ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার করতে লাগল। এভাবে চলার পর যখন লেখালেখি ও টিভি রিপোর্টিং হলো, তখনই দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হলো। মাঝে মধ্যে আমরা ভেজালবিরোধী অভিযানও দেখতে পেলাম, যা নেহাতই অকার্যকর বা অপ্রতুল। কার্যত কোনো প্রকার ফলপ্রসূ প্রতিকারই নেওয়া গেল না এসব অপবাদের বিরুদ্ধে।
একটি সভ্য দেশের মানুষ ভেজাল খাবার খেয়ে ধীরে ধীরে শারীরিক অসুস্থতা সর্বোপরি মেধাবিহীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হবে এটা সচেতন কোনো মানুষই মেনে নিতে পারে না। আমি ভালো করেই জানি খাদ্যে ভেজাল মেশানোর বিরুদ্ধে দেশে কঠিন আইন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন অধিদফতর/বিভাগ ও সংস্থা রয়েছে। এ বিষয়ে বাণিজ্য, খাদ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থাকে আরও তৎপর হতে হবে। এখনই ত্বরিত এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে গোটা জাতিই দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাষ্ট্রের সব গোয়েন্দা সংস্থাকেও যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। ভেজালবিরোধী অভিযানের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু জরিমানা বা ভেজাল খাদ্যদ্রব্য ধ্বংস করলেই প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে না। এ উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রেও ফরমালিন বা ক্ষতিকারক পদার্থ ব্যবহারের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে ওইসব দেশে আমাদের মতো নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ক্ষতিকারক পদার্থের ব্যবহার হচ্ছে না।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই যে, শুধু খাদ্যেই ভেজাল মেশানো হচ্ছে, তা নয়। যেমন_ কৃষি উপকরণ সারের মধ্যেও ভেজাল মেশানো হচ্ছে। ফলে কৃষক তার আশানুরূপ ফসল পাচ্ছেন না। তিনি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সে সঙ্গে দেশের খাদ্য ঘাটতিতেও ফলপ্রসূ প্রভাব ফেলতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। আমার প্রশ্ন, খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যদি সফল হয় তবে আমরা পারব না কেন? এর জন্য তো দেশের বাইরে থেকে অর্থ বা বিশেষজ্ঞ আনার প্রয়োজন নেই। আমাদের সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রযন্ত্রই যথেষ্ট। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, আগ্রহ, সততা ও দায়িত্ব পালনের পবিত্র মনোভাব।
সর্বক্ষেত্রে আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অধঃপতন ঘটেছে বলেই এসব অপরাধ করতে আমরা দ্বিধাবোধ করছি না। আগে সাধারণ মানুষ নিজের গরুর দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করত না। এখানে তার কাছে নৈতিকতার বিষয়টি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি মনে করতেন যে, এ জঘন্য কাজের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে বিপদ-আপদ আসতে পারে। সর্বোপরি এর জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই সেদিন সব ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পেতাম মানবিক গুণাবলির উদাহরণগুলো। আজ অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো অনুপস্থিত। যা হোক, এ মুহূর্তে আমরা ভেজালবিহীন বাজার ব্যবস্থা দেখতে চাই। ভেজালবিহীন খাদ্যদ্রব্য দেখতে চাই দেশের বড় বড় শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হোটেল, দোকান এবং বাজারগুলোতে। একটি জাতি ভেজাল খেয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে ধীরে ধীরে, এটা কি আমরা মানতে পারি? আর পারি না বলেই সর্বমহল থেকে এ জঘন্য কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে আরও তীব্রভাবে। কয়েকটি লেখা, টিভি রিপোর্টিং বা নামমাত্র ভেজালবিরোধী অভিযান চালালেই শুধু সুরাহা হবে না। চাই কার্যকর, দৃঢ় ও কঠিন পদক্ষেপ। তবে সবার আগে রাষ্ট্রযন্ত্রকেই সঠিক ও নির্ভুল পদক্ষেপ নিতে হবে। সে সঙ্গে বিরোধী দলসহ অন্য সব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী এবং সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। এখনই, এ মুহূর্তে ভেজাল নামক দানবকে আটকাতে হবে ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে। আর দেরি করা যাবে না। কারণ এ দানবের কাছে আমি, আপনি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের
সবাই বন্দি।

কর্নেল (অব.) মো. শাহ আলম পিএসসি :কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.